সংসদ টিভি ও অনলাইন ক্লাসে ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী অংশ নিচ্ছে না, মারাত্মক সংকটে শিশু শিক্ষার্থীরা

115

কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রাণঘাতী করোনার ছোবলে তিন মাস ধরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের মধ্যে শিশু শিক্ষার্থীদের মারাত্মক সঙ্কটের চিত্র উঠে এসেছে বেসরকারী সংস্থা ব্র্যাকের এক জরিপে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের শিশুদের একটি অংশ স্বাস্থ্যবিধি মেনে ঘরে অবস্থান করলেও লকডাউন পরিস্থিতির মধ্যেও ঘরের বাইরে যাচ্ছে ১৮ শতাংশ শিশু। তিন কোটি ১০ লাখ শিশুর মধ্যে ১৮ শতাংশ একটি বিশাল সংখ্যা-মন্তব্য করে জরিপ রিপোর্টে উদ্বেগের সঙ্গে বলা হয়েছে, করোনায় আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে শিক্ষার্থীদের মধ্যে। বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ভয়াবহ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। শিশুর প্রতি সহিংসতার হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। সংসদ টিভি ও অনলাইনে ক্লাস অধিকাংশ শিশুকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থীই ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে না।
শনিবার বিকেলে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে করোনাকালে শিশু শিক্ষার্থীদের ওপর চালানো জরিপের ফলাফল তুলে ধরে ব্র্যাক। সংস্থাটি বলেছে, দেশের সব বিভাগের প্রতিনিধিত্বশীলতা নিশ্চিত করতে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে প্রত্যেক বিভাগ
থেকে দুটি করে জেলা অর্থাৎ মোট ১৬টি জেলা বাছাই করে এই জরিপটি পরিচালনা করা হয়। মে মাসের ৪-৭ তারিখে এই জরিপটি পরিচালনা করা হয়। গবেষণার গুরুত্বপূর্ণ ও গুণগত দিক বিবেচনা করে বাস্তব ও মূল তথ্য প্রদানকারীদের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক স্টেকহোল্ডারদেরও সাক্ষাতকার নেয়া হয়েছে।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ মহামারীর সংক্রমণ ঠেকাতে গত ১৭ মার্চ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। মহামারী পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরাও বর্তমানের এই নতুন সাধারণ জীবনের সঙ্গে খাপখাইয়ে নিতে চেষ্টা করছে। শিক্ষার্থীদের জীবনে নতুন এই পদ্ধতিতে শেখা ও শেখানোর প্রক্রিয়াটি কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে সেটি জানতেই ব্র্যাক একটি ‘র্যাপিড’ এ্যাসিসমেন্ট করে। প্রায় সকল উত্তরদাতা (চারজন বাদে) জানিয়েছেন, শিক্ষার্থীরা করোনাভাইরাস সম্পর্কে অবগত আছে। মাঠ পর্যায়ের তথ্য বলছে প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী সাবান দিয়ে হাত ধোয়া বা হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করে এবং ৮২ শতাংশ শিক্ষার্থী সারাক্ষণ ঘরে থাকে।
যদিও শতাংশের হিসাবে এ তথ্যগুলো আশার আলো দেখায় তথাপি অন্যদিকে একটা উদ্বেগজনক অংশ চোখে পড়ে যেটি হলো ১৮ শতাংশ শিক্ষার্থী এই লকডাউনের মধ্যেও বাইরে যাচ্ছে এবং ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী করোনাভাইরাস সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পেতে সঠিক স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করছে না।
ব্র্যাক বলছে, সমীক্ষার তথ্য এমন একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ‘শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্কজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী মহামারী নিয়ে আতঙ্ক প্রকাশ করেছে। এই শতাংশ দেখে কম মনে হলেও বাস্তব দিক বিবেচনা করলে অবহেলা করার মতো বিষয় নয় এটি। বরং এটি বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী ভয়াবহ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যা বলেই প্রমাণ দিচ্ছে। কারণ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে মোট অধ্যয়নরত তিন কোটি ৩১ লাখ শিক্ষার্থীর থেকে যদি আতঙ্কিত শিক্ষার্থীর মোট সংখ্যা বা সমীকরণটি বের করা হয় তবে সংখ্যাটি কিন্তু বেশ বড় হবে।’
সবথেকে বেশি আতঙ্কিত বিশেষভাবে সক্ষম শিশু (শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন শিশু ২৯ শতাংশ), মেয়ে শিক্ষার্থী ১৭ শতাংশ, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ১৭ শতাংশ, গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত শিশু ১৭ শতাংশ আর মাদ্রাসার শিক্ষার্থী ১৭ শতাংশ। শিক্ষার্থীরা যেভাবে তাদের আতঙ্ক প্রকাশ করে তা হলো, সারাক্ষণ মন খারাপ থাকে ৩৪ শতাংশ, পড়ালেখা বা খেলাধূলায় অনীহা ২৮ শতাংশ, অপরিচিত কাউকে দেখে ভয় পাচ্ছে ২৮ শতাংশ, কথা বলায় অনাগ্রহ ২৫ শতাংশ, একা থাকতে ভয় পাওয়া ২০ শতাংশ শিশু।
লকডাউন পরিস্থিতিতে শিশুর প্রতি সহিংসতার হার আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে উল্লেখ করে জরিপে বলা হয়েছে, ‘তিন শতাংশ শিশু লকডাউনে সহিংসতার শিকার। এর মধ্যে ৮২ শতাংশ মানসিক নির্যাতনের শিকার, এছাড়াও রয়েছে শারীরিক নির্যাতন, যৌনহয়রানি, জোর করে আটকে রাখা এবং জোর করে কাজ করানো। এই হিসাবটা যদি প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের মোট শিক্ষার্থীদের নিয়ে করা হয় তবে তিন শতাংশ একটা বিশাল সংখ্যায় পরিণত হবে। যেমন সবচেয়ে খারাপ সহিংসতার উদাহরণ হলো, প্রচ-ভাবে ভীত থাকা, যার শিকার ১৬ শতাংশ বিশেষভাবে সক্ষম শিশু (শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধকতাসম্পন্ন শিশু)। শতকরা ২ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থী সহিংসতার শিকার, যা সাধারণের তুলনায় অনেক কম। টেলিফোনের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করায় অনেক মেয়েশিশু স্পর্শকাতর বিষয়ে খুব একটা নাও জানাতে পারে বলে মনে হয়। তাই প্রকৃত হারের তুলনায় কম হার আসার সম্ভাবনা রয়েছে।’
পড়াশোনা বাদেও এই লকডাউনের সময়ে শিক্ষার্থীরা আরও নানাবিধ কাজে সময় দিয়েছে। যদিও বেশিরভাগ শিশুই (৫৫ শতাংশ) গৃহস্থের কাজে বাড়ির সদস্যদের সহায়তা করেছে, কিন্তু তারপরও একটা বড় অংশ সময় কাটিয়েছে আপাত অর্থহীন কাজে। যেমনÑ পরিবারের সদস্য, আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে (২৭ শতাংশ), মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট বা অনলাইনে গেম খেলে (১৯ শতাংশ) ইত্যাদি। মেয়ে শিক্ষার্থীরা ছেলে শিক্ষার্থীর তুলনায় ঘরের কাজে বেশি সম্পৃক্ত (৪৪ শতাংশ মেয়ে শিক্ষার্থীর তুলনায় ছেলে শিক্ষার্থীর হার যেখানে ৩২ শতাংশ)। অন্যদিকে ছেলে শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক বেশি সময় কাটিয়েছে আড্ডায় (২১ শতাংশ), ইন্টারনেট আর অনলাইন গেমসে (১৭ শতাংশ), খেলাধুলায় (১০ শতাংশ) এবং টিভি দেখায় (১০ শতাংশ)।
করোনাভাইরাসের এই মহামারী লেখাপড়ায় আরও অনীহা জাগিয়েছে ১৩ শতাংশ শিশুর। যার ফলে ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী পড়াশোনা ছাড়াই ঘরে দিন কাটাচ্ছে। এই ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর প্রায় কিছু না করা বা একেবারেই অলস সময় কাটানোর পেছনে কিছু কারণ রয়েছে। এদের মধ্যে ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থী জানিয়েছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তারা কোনরকম নির্দেশনাই পাচ্ছে না। তাদের বেশিরভাগই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী এবং গ্রামে বাস করে।
২২ শতাংশের ক্ষেত্রে পরিবারে খাদ্য সমস্যাই বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এদের বেশিরভাগই মাদ্রাসার শিক্ষার্থী এবং শহরে বাস করে। আরও কিছু কারণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, পরিবারের কাছ থেকে সহযোগিতা না পাওয়া (১৯ শতাংশ), দুর্বল মানসিক অবস্থা (১৮ শতাংশ), ঘরে পড়াশোনার পরিবেশের অভাব (১১ শতাংশ) ইত্যাদি। দুর্বল মানসিক অবস্থার তথ্য জানানো বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই শহরে বাস করে।
সংসদ টিভি বা অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমে দূরশিক্ষণ ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের এখনও তেমন আকৃষ্ট করতে পারেনি। ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থীই ক্লাসে অংশগ্রহণ করছে না। দূরশিক্ষণে কম অংশগ্রহণের তালিকায় রয়েছে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী (২৫ শতাংশ), মাদ্রাসা শিক্ষার্থী (৩২ শতাংশ), বিশেষভাবে সক্ষম শিশু (৩৯ শতাংশ) এবং গ্রামে বসবাসকারী শিক্ষার্থী (৪০ শতাংশ)।
কম অংশগ্রহণের কিছু কারণ জানা গেছে জরিপে। মূল কারণ-প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার অভাব, যেমন (টেলিভিশন, ইন্টারনেট, বিদ্যুত ব্যবস্থা, ডিশ কানেকশন ইত্যাদি)। ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর শিক্ষার্থীরা কম অংশগ্রহণ করছে কারণ ভাষাগত বাধা এবং তথ্য আদানপ্রদানে ব্যাঘাত হওয়া।
বেশিরভাগ উত্তরদাতা (৫৪ শতাংশ) স্কুল শুরু হওয়ার পর অতিরিক্ত ক্লাস নেয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। যদিও করোনাভাইরাস সংক্রামণ বাড়ছে তবু ৪৯ শতাংশ উত্তরদাতা কিছুদিনের মধ্যেই স্কুল খোলার পক্ষে মত দিয়েছেন।
অংশগ্রহণকারী উত্তরদাতাদের ৩৫ শতাংশ সিলেবাস কমিয়ে আনার পক্ষে পরামর্শ দিয়েছেন এবং ২৬ শতাংশ উত্তরদাতা শিথিল পরীক্ষার পক্ষে ভোট দিয়েছেন। শিক্ষার্থীদের মনস্তাত্ত্বিক ট্রমা থেকে বের করতে অংশগ্রহণকারীরা কিছু সুপারিশ করেছিলেন, যার মধ্যে স্কুল শুরু হওয়ার পর বিনোদন কার্যক্রম শুরু, উপহার প্রদান বা উপবৃত্তির পরিমাণ বৃদ্ধি, অনলাইন বা দূরশিক্ষণ কার্যক্রম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।