কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনা ভাইরাসের প্রভাবে অর্থনীতির অন্যান্য খাতের মতো ক্ষতির মুখে পড়েছে দেশের ব্যাংক খাতও। এরই মধ্যে সব ব্যাংকের আয়ও কমে গেছে। অর্থনৈতিক মন্দার কবলে পড়ে কোনও ব্যাংক যাতে বন্ধ হয়ে না যায়, সেজন্য কৌশল খুঁজছেন ব্যাংকের মালিকরা। তারা ব্যাংকের কর্মী ছাঁটাই না করে কর্মীদের বেতন কমানোর উদ্যোগ নিতে যাচ্ছেন।
রবিবার (১৪ জুন) ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশঅ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি) এ বিষয়ে একটি জরুরি সভাও করেছে। সভায় বেশিরভাগ উদ্যোক্তা ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় কমিয়ে এই মন্দায় কোনও মতো টিকে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে বিএবি চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার বলেন, ‘গত রবিবার আমরা উদ্যোক্তারা বসেছিলাম। সভায় কর্মী ছাটাই না করে কীভাবে ব্যাংক বাঁচানো যায়, সে ব্যাপারে সবাই পরামর্শ দিয়েছেন। সভায় একটি ড্রাফট প্রস্তাবনা আকারে তুলে ধরা হয়। করোনার কারণে দেশের অর্থনৈতিক মন্দার পরিস্থিতিতেও কোনও ব্যাংক যাতে কোনও কর্মী ছাঁটাই না করে, সে ব্যাপারে সবাইকে অনুরোধ জানানো হয়। তবে কোনও ব্যাংক তাদের কর্মীদের বেতন কমিয়ে বা বাড়িয়ে দিলে বিএবি কিছুই বলবে না।’ তিনি জানান, কোনও ব্যাংককে বেতন কমানোর কোনও নির্দেশনা বা চিঠি ইস্যু করা হয়নি, হবেও না। কারণ, ব্যাংক কীভাবে চলবে সেটা ব্যাংকের নিজস্ব ব্যবস্থাপনা নির্ধারণ করবে। এ ক্ষেত্রে বিএবি কোনও হস্তক্ষেপ করবে না।
তিনি বলেন, ‘ব্যাংকের ব্যয় কমাতে কর্মীদের বেতন কিছুটা কমিয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন কেউ কেউ। এরই মধ্যে দু-একটি ব্যাংক কর্মীদের বেতন কমানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন বলেও সভায় জানানো হয়। তবে সভায় কর্মী ছাঁটাই না করার ব্যাপারে সবাই একমত হয়েছেন।’
নজরুল ইসলাম মজুমদার জানান, আমার ব্যাংকের (এক্সিম ব্যাংক ) যারা ৪০ হাজার টাকার বেশি বেতন পান, আগামী দেড় বছরের জন্য তাদের ১৫ শতাংশ বেতন-ভাতা কমিয়ে দিয়েছি।
বিএবির সভায় উপস্থাপন করা প্রস্তাবনার ড্রাফট কপি কোনও ব্যাংকের জন্য নির্দেশনা বা পালনীয় বিষয় নয় বলেও জানান তিনি।
যা আছে প্রস্তাবনা ড্রাফটে
কোভিড-১৯ উদ্ভুত অর্থনৈতিক মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে কর্মী ছাঁটাই না করে ব্যাংককে সচল রাখার জন্য এই বছরের ১ জুলাই থেকে ২০২১ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেসব পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, তা হলো
১. সব গ্রেডের কর্মকর্তা ও নির্বাহী, যাদের মাসিক মূল বেতন ৪০ হাজার টাকার বেশি তাদের সবার ১৫ শতাংশ হ্রাস করা।
২. আগামী দেড় বছর সব ধরনের পদোন্নতি, ইনক্রিমেন্ট ও ইনসেনটিভ বোনাস দেওয়া বন্ধ রাখা।
৩. ব্যাংকের চলমান নিয়োগসহ সব নিয়োগ বন্ধ রাখা।
৪. নতুন শাখা, এজেন্ট ব্যাংকিং শাখা এবং সাব-ব্রাঞ্চ বন্ধ রাখা।
৫. সব ধরনের স্থায়ী সম্পদ কেনা থেকে বিরত থাকা।
৬. লোকাল ও ফরেন ট্রেইনিং আপাতত বন্ধ থাকবে।
৭. সব বিদেশি ট্যুর বন্ধ রাখতে হবে।
৮. সব ধরনের সিএসআর, ডোনেশন, চ্যারিটি বন্ধ রাখতে হবে।
৯. ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রিন্ট ও অনলাইন পত্রিকা এবং টেলিভিশনে সব ধরনের বিজ্ঞাপন বন্ধ রাখতে হবে।
১০. সব গ্রাহক ‘গেট টু গেদার’ বন্ধ রাখতে হবে।
১১. অফিসার ও এক্সিকিউটিভ ‘গেট টু গেদার’ ও ম্যানেজার কনফারেন্স বন্ধ থাকবে। প্রয়োজনে ভার্চুয়াল পদ্ধতিতে করতে হবে।
১২. বড় ধরনের ব্যয় যেমন আইটি রিলেটেড, সফটওয়্যার, হার্ডওয়্যার কেনা আপাতত সীমিত পর্যায়ে রাখা।
১৩. অন্য সব ব্যয় সীমিত পর্যায়ে রাখতে হবে।
সভায় উপস্থাপিত প্রস্তাবনার ড্রাফট কপিতে বলা হয়েছে, উদ্ভূত অর্থনৈতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাংকিং খাত বিভিন্ন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো ব্যাংকের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। সুদের হার কমেছে। আদায় প্রায় শূন্যে নেমেছে। আমদানি-রফতানি উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। বিশ্বব্যাপী বৈদেশিক বাণিজ্য কমার কারণে আনুষঙ্গিক আয় একেবারে কমেছে। বৈদেশিক রেমিট্যান্স কমেছে। ক্রেডিট কার্ডে আদায় ও আয় কমেছে। এপ্রিল ও মে মাসের সুদ এক বছরের জন্য ব্লক করে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্দেশিত প্রণোদনা বাবদ দুই মাসে করোনায় ব্যাংকিং সেবা দেওয়ায় বিপুল অঙ্কের ব্যয় নির্বাহ করতে হয়েছে। এছাড়া করোনা প্রতিরোধের জন্য স্যানিটাইজার ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি পরিপালন করার জন্য বাড়তি খরচ হচ্ছে। করোনায় আক্রান্তদের চিকিৎসা ও মারা যাওয়া কর্মীদের স্বাস্থ্য বিমা বাবদ বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। ব্যাংকের আয় কমে যাওয়ার জন্য ব্যাংকের নেগেটিভ গ্রোথ হচ্ছে।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের গত ডিসেম্বর ভিত্তিক তথ্য অনুযায়ী, দেশে সক্রিয় ৫৯টি ব্যাংকে বর্তমানে জনবল রয়েছে এক লাখ ৭৮ হাজার ৪৩০ জন। এর মধ্যে বেসরকারি ব্যাংকে আছেন এক লাখ ৯ হাজার ১২৭ জন। বিদেশি ব্যাংকে তিন হাজার ৮৫৮ জন। আর সরকারি ব্যাংকে ৬৫ হাজার ৪৪৫ জন।