কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশে নতুন করোনা রোগীর সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলোতে আইসিইউ, ভেন্টিলেটর, অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ (সচল) প্রয়োজনীয় তাৎক্ষণিক জীবন বাঁচানোর চিকিৎসা উপকরণের সঙ্কট হয়ে উঠছে প্রকট। করোনাভাইরাসের সংক্রমণ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানী এবং বিভাগীয় শহরের বাইরে বেড়ে চলেছে গুরুতর রোগীর সংখ্যা। আর জেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত সরঞ্জাম না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে তাদের চিকিৎসা ব্যবস্থা। কোভিড ও নন-কোভিড রোগীর জন্য এসব চিকিৎসা উপকরণ সামাল দিতে গিয়ে অসহায় হয়ে পড়ছে চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানগুলো।
চিকিৎসকরা বলছেন, করোনার পাশাপাশি শ্বাসকষ্টসহ জটিল রোগে আক্রান্তদের জন্য ভেন্টিলেটর ও আইসিইউ অত্যাবশ্যকীয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসংখ্যার অনুপাতে দেশে করোনা মোকাবেলায় কমপক্ষে সাড়ে ৩ হাজার আইসিইউ ও ৫ হাজার ভেন্টিলেটর দরকার।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা বলছে, কোভিট-১৯ এ আক্রান্ত মোট রোগীর ৮০ থেকে ৮২ শতাংশ সাধারণ চিকিৎসাতেই সুস্থ হয়ে ওঠেন। বাকি ১৮ থেকে ২০ শতাংশ রোগীর চিকিৎসা নিতে হয় হাসপাতালে। এদের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ রোগীর জন্য প্রয়োজন হতে পারে কৃত্রিম শ্বাসপ্রশ্বাস সুবিধা বা ভেন্টিলেটর। আর জটিল ৫ শতাংশের জন্য লাগতে পারে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউ।
স্বাস্থ্য অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর সরকারী হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ শয্যা রয়েছে ১৩৭টি। এছাড়া ঢাকা বিভাগের ১৩ জেলা হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা রয়েছে ৪৭টি, চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলা হাসপাতালে ৩৪টি, ময়মনসিংহ বিভাগের ৪টি জেলা হাসপাতালে ৭টি, বরিশাল বিভাগের ৬টি জেলা হাসপাতলে ১৮টি, সিলেট বিভাগের ৪টি জেলা হাসপাতালে ১৬টি, রাজশাহী বিভাগের ৮টি জেলা হাসপাতালে ২৮টি, খুলনা বিভাগের ১০টি জেলা হাসপাতালে ১৮টি এবং রংপুর বিভাগের ৮টি জেলা হাসপাতালে আছে ১৩টি আইসিইউ শয্যা। সবমিলিয়ে সারাদেশে সরকারী পর্যায়ে আইসিইউ শয্যা রয়েছে মাত্র ৩১৮টি। এছাড়া ঢাকায় বেসরকারী পর্যায়ে কোভিড নির্ধারিত হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ শয্যা আছে ৮১টি। সরকারী ও বেসরকারী মিলিয়ে সারাদেশে আইসিইউ শয্যা আছে ৩৯৯টি। অথচ সারাদেশে ১২ জুন পর্যন্ত করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৮১ হাজার ৫২৩ জনে। এদের মধ্যে ২০ শতাংশ ধরা হলেও ১৬ হাজারের বেশি করোনা রোগী হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। বাকি ৮০ শতাংশ রোগী বাসায় চিকিৎসাধীন। মোট রোগীর ৫ শতাংশের বেশির আইসিইউ’র প্রয়োজন হয়। এতে আইসিইউ সাপোর্ট লাগবে এমন রোগীর সংখ্যা কয়েক হাজার। অথচ সারাদেশে আছে মাত্র ৩৯৯টি। এর মধ্যে করোনার বাইরে অন্য রোগে আক্রান্তদেরও নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র প্রয়োজন। সবমিলে এ ধরনের শয্যার তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। একই সঙ্গে অক্সিজেন সরবরাহও প্রকট আকার ধারণ করেছে।
এদিকে ঢাকার বাইরে দেশের মাত্র ৫টি হাসপাতালে কেন্দ্রীয়ভাবে অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া বাকি সব হাসপাতালে সিলেন্ডারের মাধ্যমে রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। দেশে করোনা প্রাদুর্ভাবের শুরুর দিকে হাসপাতালগুলো অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিলেও বর্তমানে সেই অবস্থা নেই বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু বাস্তব অবস্থা ভিন্ন। মানুষ অক্সিজেন সিলিন্ডার কিনতে গিয়ে ফিরে আসছে। এ সুযোগে দুই-তিনগুণ বেশি দামে বিক্রি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত ঢাকার বাইরে অধিকাংশ হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকলেও রোগীদের জন্য তা সরবরাহে পর্যাপ্ত সুবিধা নেই। ৯০ শতাংশ জেলা হাসপাতালে নেই এবিজি (আর্টেরিয়াল ব্লাড গ্যাস এনালাইজার) মেশিন। অক্সিজেন সিলিন্ডার থাকলেও ৮৯ শতাংশ হাসপাতালে নেই অক্সিজেন কনসেনট্রেটর। ৯৫ ভাগ হাসপাতালে নেই বিপাপ ও সিপাপ (প্রেসার দিয়ে ফুসফুসে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ করার যন্ত্র)। এমনকি অক্সিজেন মাস্কের ঘাটতি রয়েছে ৩০ শতাংশ হাসপাতালে। এসব সামগ্রী না থাকায় সিলিন্ডার তেমন কাজে আসছে না।
কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসায় আইসিইউ শয্যার সঙ্কট দেখা দিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের সব জেলায় আইসিইউ স্থাপনের নির্দেশ দেন। সম্প্রতি একনেক সভা শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান সাংবাদিকদের বলেন, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী প্রত্যেক জেলা সদর হাসপাতালে একটা করে আইসিইউ ইউনিট স্থাপন করার নির্দেশ দিয়েছেন। প্রত্যেক হাসপাতালে আইসিইউ ইউনিট, ভেন্টিলেটর স্থাপন এবং উচ্চমাত্রার পর্যাপ্ত অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা আরও বৃদ্ধির কথা বলেছেন। এ জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি কেনার নির্দেশও প্রধানমন্ত্রী দিয়েছেন।
বারডেম আইসিইউ বিশেষজ্ঞ ডাঃ ফাতেমা আহমেদ বলেন, যদি কিডনি ড্যামেজ হয়। তাহলে রোগী ডায়ালাইসিস থেরাপি দিতে লাগে। মডেরেটর কিংবা নিউমোনিয়া রোগীর রেসপারেটরি ফেইলর হয় এবং এআরডিএস হতে পারে। এসব রোগী শ্বাস সাপোর্ট ভেন্টিলেটর দরকার হয়। সেহেতু তাদের অবশ্যই আইসিউতে থাকতে হবে। এই গ্রুপে রোগীর হার্টের সমস্যা হতে পারে।
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার সাবেক উপদেষ্টা অধ্যাপক ডাঃ মাজহারুল বলেন, দেশে ৩ হাজার ৪০০ আইসিইউ বেড প্রস্তুত রাখা দরকার। কমপক্ষে ৫ হাজার ভেন্টিলেটর দরকার। এ জায়গায় কম্প্রোমাইজ করার কোন সুযোগ নেই। সরকারী-বেসরকারী আইসিইউর দায়িত্বে থাকা নার্সদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং সরকারী-বেসরকারী হাসপাতালগুলোর আইসিইউ ও ভেন্টিলেটরগুলো এক জায়গায় এনে সমন্বয় করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিকসমূহ) ডাঃ আমিনুল হাসান বলেন, গত ফেব্রুয়ারি থেকেই জেলা হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ স্থাপন এবং মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ শয্যা বাড়াতে কাজ শুরু হয়েছে। এই সংক্রান্ত কার্যক্রম অধিদফতরের পরিচালকের (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) দফতর থেকে পরিচালিত হচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল কবির বলেন, ফেব্রুয়ারি থেকে দেশের জেলা হাসপাতালগুলোয় আইসিইউ স্থাপনে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আসছে অর্থবছরে এটি বাস্তবায়ন করা হবে। এতে জেলা হাসপাতালগুলোয় ৫টি করে আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা হবে। মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোয় ১০টি করে অতিরিক্ত আইসিইউ শয্যা সংযুক্ত হবে। পাশাপাশি আইসিইউ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক লোকবল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে বলেও জানান অধ্যাপক ডাঃ ইকবাল কবির।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডাঃ আবুল কালাম আজাদ জানান, বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদফতরের নজরে রয়েছে। আইসিইউ, ভেন্টিলেটর ও অক্সিজেন বাড়ানোর প্রক্রিয়া অব্যাহত রয়েছে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আন্তরিক প্রচেষ্টার কমতি নেই।