ফ্লাইট বন্ধ থাকায় অনেক এয়ারলাইন্স দেউলিয়ার পথে ॥ এমিরেটস এর ৩০ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা

19

কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনা তান্ডবে দুনিয়াব্যাপী বন্ধ রয়েছে ফ্লাইট চলাচল। বিগত তিন থেকে চারমাস ধরে বন্ধ থাকায় অনেক এয়ারলাইন্স দেউলিয়ার পথে। ছাঁটাইয়ের ঢেউ লেগেছে এমিরেটসসহ দুনিয়ার শীর্ষ এয়ারলাইন্সে। শুধু এমিরেটসই আগামী মাসে ৩০ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের ঘোষণা দেয়ায় অন্যরাও ঘাবড়ে গেছে। এভিয়েশন বোদ্ধাদের মতে, যদি আর দুমাস এভাবে চলতে থাকে, তাহলে আর কখনই দাঁড়ানো সম্ভব নয় কোন এয়ারলাইন্স। প্রশ্ন উঠেছে, করোনা তান্ডন চলবে ততদিনই কি অচল থাকবে আকাশপথ? বিশ্ব স্বাস্থ্য যাই বলুক, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা মেনে নতুন নিয়মেই এমিরেটসসহ শীর্ষ এয়ারলাইন্সগুলো খুব শীঘ্রই ফ্লাইট চালানোর পক্ষে মত দিয়েছে। করোনার মাঝেই নয়া আঙ্গিকে, নয়া নিয়মে ফ্লাইট চালানোর কৌশলও বের করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে আইকাও বেঁধে দিয়েছে ধরাবাধা নিয়ম। মূলত তারপরই যুক্তরাষ্ট্্রসহ টার্কিশ কাতার এমিরেটসসহ অনেক এয়ারলাইন্সই ফ্লাইট চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। লকডাউন ওঠে গেলে আগামী মাস থেকে ফ্লাইট চালানোর ঘোষণা দিয়েছে ভারতের এভিয়েশন কর্তৃপক্ষ। টার্কিশ ঢাকায় আসতে প্রস্তুত আগামী মাসেই। সৌদি এয়ারও ফ্লাইট চালুর পক্ষে। ইউরোপের অনেক দেশেই সীমিত আকারে চলাচল শুরু করেছে এয়ারলাইন্সগুলো। এ অবস্থায় প্রশ্ন ওঠেছে, বাংলাদেশে কবে চালু হচ্ছে ফ্লাইট। এ বিষয়ে সিভিল এভিয়েশন সূত্র জানিয়েছে, চলতি লকডাউন ৩১ মে শেষ হবার পর, আর যদি নতুন করে ছুটি বাড়ানো না হয়, তাহলে নতুন নিয়মে সীমিত আকারে জুনেই শুরু হতে পারে। এজন্য ইতোমধ্যে সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিয়ে রাখার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সিভিল এভিয়েশন থেকে।
জানা গেছে, অন্যান্য দেশের মতো ঢাকায়ও চাপ বেড়েছে ফ্লাইট চালুর। সিভিল এভিয়েশনও সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে। এখন সেটা নির্ভর করছে-সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার বেসরকারী বিমান পরিবহন ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী এডভোকেট মাহবুব আলী এমপি বলেছেন, আমরা ফ্লাইট চালাতে প্রস্তুত। কারণ করোনায় দেশে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমার মন্ত্রণালয়। করোনার জন্য আমাদের পর্যটনের সাড়ে ১১ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। বিমানের শুধু এপ্রিল মাসেই বেতন, কিস্তি এবং অন্যান্য ব্যয়ের জন্য প্রয়োজন ৬২৮ কোটি টাকা। সেজন্য আমি অপেক্ষায় আছি, যতো দ্রুত সম্ভব ফ্লাইট চালুর জন্য।
জানতে চাইলে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, টার্কিশসহ অনেক এয়ারলাইন্সই ঢাকায় ফ্লাইট চালানোর জন্য অনুমতি চেয়েছে। সিভিল এভিয়েশনের প্রস্তুতিও রয়েছে। কিন্তু পাবলিক পরিবহন যদি চালু না করা যায় তাহলে যাত্রী আসবে কি করে? টেন পার্সেন্ট যাত্রীর প্রাইভেট কার আছে। এ দিয়ে তো আর ফ্লাইট ভরবে না। এ ছাড়া বিদেশী কয়েকটি এয়ারলাইন্স জুন থেকে ঢাকায় ফ্লাইট চালানোর অনুমতি চেয়েছে। আমরা সেটা দেয়ার আাগে দেখছি কারা কোন দেশ থেকে আসবে। বিপরীতে বাংলাদেশ থেকে যাত্রী অন্য দেশে যেতে পারবে কিনা সেটাও দেখতে হবে। কেননা ঠিক এই মুহূর্তে বাংলাদেশে করোনার প্রাদুর্ভাব ঊর্ধ্বমুখী। এ রকম পরিস্থিতিতে বিদেশীরা বাংলাদেশীদের গ্রহণ করতে চাইবে কিনা সেটাও দেখতে হবে।
জানা গেছে, বাংলাদেশে লকডাউনের দীর্ঘ ছুটি থাকলেও আন্তর্জাতিক রীতিনীতি মেনে আইকাও গাইডলাইন অনুযায়ী সীমিতাকারে ফ্লাইট চালুর সবধরনের প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার ঢাকায় হয়ে গেছে আইকাও-এর সঙ্গে যুক্ত ব্রিফিং। এতে করোনা পরিস্থিতির মাঝে পুনরায় বিমান চলাচলের বিষয়ে আলোচনা করেছেন এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের সিভিল এভিয়েশন খাতের শীর্ষ ব্যক্তিরা। দীর্ঘ সাড়ে তিন ঘণ্টাব্যাপী অনলাইনে এই সভায় করোনা পরিস্থিতিতে নেয়া পদক্ষেপ, মোকাবেলা পদ্ধতি পরিস্থিতির উত্তরণ নিয়ে আলোচনা হয় আন্তর্জাতিক বেসামরিক বিমান চলাচল সংস্থার (আইকাও) অন্তর্ভুক্ত ‘কোলাবেরেটিভ এ্যারেজমেন্ট ফর প্রিভেনশন এ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অব পাবলিক হেলথ ইভেন্ট ইন সিভিল এভিয়েশন (সিএপিএস সিএ)’ এর এশিয়া প্যাসিফিকের আঞ্চলিক অফিস ব্যাঙ্ককের সার্বিক ব্যবস্থাপনায় এই ভিডিও সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বর্তমানে বিশ্বে উদ্ভূত মহামারী করোনাভাইরাসের কবল হতে বিশ্ব কীভাবে উত্তরণ ঘটাতে পারে এবং করোনা পরবর্তী অবস্থা কীভাবে মোকাবেলা করা যায়, সে বিষয়েও আলোচনা হয়। ভিডিও কনফারেন্সে আইকাও-এর এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের আঞ্চলিক পরিচালক অরুণ মিশ্র সূচনা বক্তব্য রাখেন। এরপর সিএপিএসসিএ-এর বর্তমান চেয়ারপার্সন ও বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোঃ মফিদুর রহমান উদ্বোধনী বক্তব্য দেন। শুরুতে করোনায় মৃত্যুবরণকারীদের স্মরণে এক মিনিট নিরবতা পালন করা হয়। মফিদুর রহমান অংশগ্রহণকারী ২৩টি সদস্য রাষ্ট্র, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, আইকাও এবং সিএপিএসসিএ’র সহযোগী সংস্থাগুলোর প্রতিনিধিদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য ধন্যবাদ জানান। তিনি করোনা মহামারী পরিস্থিতি হতে উত্তরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব এবং দিক নির্দেশনার কথা উল্লেখ করে সাম্প্রতিক সময়ে গৃহীত সব ধরনের পদক্ষেপ বিস্তারিত তুলে ধরেন। একই সঙ্গে সিএপিএসসিএ এর সব সদস্য দেশকে সম্মিলিতভাবে করোনার এ দুর্যোগময় পরিস্থিতি সাহসের সঙ্গে মোকাবেলা করার জন্য সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানান। এছাড়ও করোনা মোকাবেলায় বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থা এবং আইকাও দিক নির্দেশনা মোতাবেক সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান। এতে আইকাও এভিয়েশন মেডিসিন সেকশনের প্রধান এবং সিএপিএসসিএ এর গ্লোবাল প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডাঃ আনসা জর্দান আইকাও-এর সদর দফতর থেকে বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি ফ্লাইট চালুর জন্য আইকাও প্রদত্ত পাবিলিক হেলথ করিডোর কনসেপ্ট নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। এভিয়েশন সেবা প্রদানকারী সবার স্বাস্থ্য সুরক্ষা করে কীভাবে যাত্রীদের স্বাস্থ্যসম্মত সেবা প্রদান করা যায়, সে ব্যাপারে আলোচনা করেন। পরবর্তীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট এ্যাসোসিয়েশন এবং এয়ারপোর্ট কাউন্সিল ইন্টারন্যাশনালের প্রতিনিধিরা বিশ্বে এভিয়েশন কমিউনিটিকে রক্ষাকল্পে এই রোগের বিষয়ে বিভিন্ন প্রতিকারমূলক দিক নির্দেশনা প্রদান করেন, যাতে রোগ অতি সহজে ও সফলতার সঙ্গে প্রতিরোধ করা যায়। এছাড়া, সভায় চীন, জাপান, সিঙ্গাপুর এবং দক্ষিণ কোরিয়া করোনা মোকাবেলায় তাদের নিজ নিজ দেশের এভিয়েশন সেক্টরের গৃহীত পদক্ষেপ এবং বিশেষ করে পুনরায় ফ্লাইট চালুর বিষয়ে তাদের গৃহীত পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করেন।
এদিকে প্রতিবেশী ভারতে আগামী মাস থেকেই সীমিত আকারে ফ্লাইট চালুর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে মোদি সরকার। সেখানে বর্তমানে করোনাভাইরাস সংক্রমণ প্রতিরোধে ৩১ মে পর্যন্ত চলবে লকডাউনের চতুর্থ দফা। আর এরপরেই উড়ানের অনুমতি মিলে যেতে পারে। এমন আশায় অনেক বেসরকারী বিমান সংস্থাই জুন মাসের টিকিট বুকিং শুরু করে দিয়েছে। সংবাদ সংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, এখন থেকেই দেশের মধ্যে সফরের টিকিট বুকিং শুরু করে দিয়েছে ইন্ডিগো এবং ভিস্তারা। তবে কিছু বেসরকারী বিমানসংস্থা এখন থেকেই টিকিট বুকিং শুরু করলেও সরকারী সংস্থা এয়ার ইন্ডিয়ার বুকিং এখনও বন্ধ রয়েছে। এয়ার ইন্ডিয়া আগেই জানিয়েছে, অসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রকের নির্দেশ আসার আগে তারা বুকিং নেবে না। কিন্তু অন্য সংস্থা টিকেট বুকিং শুরু করলেও যাত্রীদের এ ব্যাপারে সতর্ক থাকা উচিত বলে জানিয়েছে, এয়ার প্যাসেঞ্জার এ্যাসোসিয়েশন অব ইন্ডিয়া (এপিএআই)। সংগঠনের সর্বভারতীয় সভাপতি সুধাকর রেড্ডি বলেন, অনেক সংস্থাই জুন থেকে উড়ান চালু হওয়ার আশা করছে। তবে টাকা খরচ করার আগে যাত্রীদের সতর্ক থাকা দরকার।
এছাড়া করোনার কারণে বিশ্বের অন্যান্য বিমানসংস্থার মতো টার্কিশ এয়ারারলাইন্সও তাদের ফ্লাইট স্থগিত করেছিল। এক বিবৃতিতে তুরস্কের বিমান সংস্থা টার্কিশ এয়ারলাইন্স জানিয়েছে যে, পুনরায় তারা তাদের ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করতে যাচ্ছে। টার্কিশ এয়ারলাইন্স কর্তৃপক্ষ বলেছে আগামী ৪ জুন থেকে তারা অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা শুরু করবে এবং ১০ জুন থেকে তারা আন্তর্জাতিক গন্তব্যে ফ্লাইট চলাচল শুরু করতে পারে।
একইভাবে আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইট পরিচালনার জন্য টিকিট বিক্রি শুরু করবে সৌদি এয়ারলাইন্স। আগামী ১ জুন থেকে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনার জন্য টিকেট বুকিং শুরু করবে সৌদি এয়ারলাইন্স। কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১ জুন থেকে যাত্রীরা সৌদি এয়ারলাইন্সের অভ্যন্তরীণ রুটের টিকেট বুকিং করতে পারবে।
এ অবস্থায় ঢাকায় কবে নাগাদ ফ্লাইট শুরু সম্ভাবনা রয়েছে প্রশ্ন করা হলে বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ারভাইস মার্শাল মফিদুর রহমান বলেন, যদিও ফ্লাইট চালুর সব প্রস্তুতি রয়েছে আমাদের তবুও অনেকগুলো ফ্যাক্টর বিবেচনা করা হচেছ। প্রথত-অপেক্ষায় রয়েছি পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চালুর জন্য। ফ্লাইট চালুর করা হলে সাধারণ যাত্রীরা আসবে কিভাবে? অপরদিকে ঠিক এই মুহূর্তে বিদেশীরা আমাদেরকে ভিসা দেবে কিনা কিংবা বাংলাদেশীদের তাদের দেশে এলাউ করবে কিনা। যদি ঢাকা থেকে যাত্রী বিদেশে না যেতে পারে তাহলে শুধু বিদেশী এয়ারলাইন্সকে এলাউ করার সার্থকতা কোথায়। আমাদের সব দেখতে হবে। তারপরও আমি এ সপ্তাহটা অবজার্ব করব। দেশের পরিস্থিতি কেমন তা দেখতে হবে। যদি লকডাউন আর না বাড়ে, তাহলে জুনের প্রথমদিকে সীমিতকারে ফ্লাইট চালু শুরু করা যেতে পারে। এজন্য আমরা সব প্রস্তুতি নিয়েছি।