স্পেনে কয়েক হাজার বাংলাদেশি কর্মহীন, দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা

8

স্পেন থেকে সংবাদদাতা  :
স্পেনে লকডাউনের দুই মাস পূর্ণ হয়েছে। এই দুই মাসের করোনা মহামারি পরিস্থিতি স্পেনকে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে স্মরণকালের ভয়াবহ বাস্তবতার সামনে। গত দুই মাসের হিসেব ও পরিসংখ্যানের নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি স্পেন তার অতীত ইতিহাসের ২০০ বছরেও হয়নি। এই মহামারি কেড়ে নিয়েছে দেশটির ২৭ হাজারেরও বেশি মানুষের জীবন।
এই মৃতের মধ্যে বেশিরভাগই ছিলেন জীবন সায়াহ্নে সহানুভূতি প্রত্যাশী বয়স্ক মানুষ। তাদের অনেককেই বাসায় রেখে সরে পড়েছিলো তাদের পরিষেবার দায়িত্বে নিয়োজিত মানুষরা। মহামারির ভয়াবহতা এভাবে অনেক ক্ষেত্রে স্বার্থপর করে তুলেছে মানুষকে। তবে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে যাচ্ছে অনেক মানবিকতারও। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অনেকে নিজের জীবন বিপন্ন করে আলো জ্বালিয়েছেন এই ভূখন্ডে। গত দুই মাসে রেজিস্ট্রি করা হয়েছে দুই লক্ষ ৩০ হাজারেরও বেশি আক্রান্তের। গড়ে প্রতিদিন আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় চার হাজার মানুষ।
রাষ্ট্রের বাকি সব কার্যক্রম স্থবির করে দিয়ে কার্যত দেশটির পুরো কাঠামোকেই আক্রান্ত করেছে করোনা মহামারি। করোনাকালের এই কঠিন সময়ে সাহায্য প্রার্থীর লাইন দীর্ঘ হচ্ছে প্রতিনিয়ত। রাস্তায় বাড়ছে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা। প্রতিদিন বাড়ছে বেকারত্ব। প্রায় ৯ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষের আয়ের উৎস থেমে গেছে। ৩০ লক্ষ কর্মজীবী মানুষ জরুরি পরিস্থিতিতে বাধ্যতামূলক ঘরবন্দী হয়ে রাষ্ট্রের অনুদান ঊজঞ এর ওপর নির্ভর হয়ে পড়েছেন। মহামারি কাটলেও প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার কারণে এদের অনেকে চাকরি হারাবেন। কারণ, আশঙ্কা করা হচ্ছে, অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাবে।
গত দুই মাসে স্পেনের জিডিপি কমেছে ৫ দশমিক ২ শতাংশ। স্পেনের ইতিহাসে গত ১ শতাব্দীতে এই হারে জিডিপির পতন ঘটেনি। স্পেনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এই পতনের হার ভয়াবহ হয়ে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ পর্যন্ত নেমে যাওয়ার আশঙ্কা করছে।
সামাজিক জীবনে মানুষ চলাফেরার স্বাধীনতা হারিয়েছে। সংকটকালে হোম কোয়ারেন্টাইন ভেঙে স্পেনের গর্বের পতাকা প্রদর্শনীর কারণেও মানুষ জরিমানার শিকার হয়েছে। তারপরও স্পেনের রাষ্ট্রযন্ত্র প্রতিদিন গড়ে ৪৫০ জন মানুষের মৃত্যুর হিসাব বুঝে নিচ্ছে। দিকভ্রান্ত মানুষকে ঘরে আটকে রেখে, প্রয়োজনীয় অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে আর্থিক সহায়তা দিয়ে দেশটি সর্বশক্তিতে লড়ে যাচ্ছে এই দানব মহামারির বিরুদ্ধে।
করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত স্পেনের পর্যটন ব্যবসাও পড়েছে চরম বিপর্যয়ের মুখে। বিশাল আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়েছে দেশটির ছোট-বড় দুই লাখের বেশি হোটেল, গেস্ট হাউজের মালিকরা। বন্ধ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে এসব প্রতিষ্ঠান। এসব কারণে ইতোমধ্যেই পর্যটক খাতে সংশ্লিষ্ট কয়েক হাজার বাংলাদেশি কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। শতাধিক বাংলাদেশি ব্যবসায়ী রয়েছেন চরম উৎকণ্ঠা ও দুশ্চিন্তার মধ্যে। আনুষঙ্গিক ব্যয় মিটিয়ে ব্যবসা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না বলে মনে করছেন অনেকে।
জানা গেছে, দেশটির সরকার হোটেল কিংবা গেস্ট হাউজ আনুষ্ঠানিকভাবে বন্ধ ঘোষণা করেনি। করোনার কারণে স্পেনের সঙ্গে অন্যান্য দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে। এমনকি এক শহর থেকে আরেক শহরে দেশটির নাগরিকদের ভ্রমণেও নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। পুরো স্পেন যখন পর্যটক শূন্য তখন একপ্রকার বাধ্য হয়েই প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখতে হয়েছে ব্যবসায়ীদের।
রাজধানী মাদ্রিদের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী বাংলদেশি জাকির হোসেন বলেন, স্পেনে ব্যবসার ঠিক শুরুতেই করোনাভাইরাস হানা দেয়, যেটি ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলোর মাসিক ভাড়াই আছে ১০ লাখ টাকার বেশি। কর্মচারী এবং অন্যান্য আনুষঙ্গিক মিলিয়ে মাসিক ব্যায় কোটি টাকার ওপরে। এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলাতে যে ক্ষতি হচ্ছে তা কাটিয়ে উঠতে অনেক বেগ পেতে হবে। এসব প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি চরম দুশ্চিন্তায় রয়েছে রেস্টুরেন্ট এবং টুরিস্ট সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। কয়েক হাজার বাংলাদেশি প্রবাসী এসব ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং হাজার হাজার প্রবাসীর কর্মসংস্থান এসব প্রতিষ্ঠানে। ইতোমধ্যে কর্মহীন এসব প্রবাসীরা উদ্বেগেরে মধ্যে দিনাতিপাত করছেন।
দেশটিতে হোটেলে কাজ করেন বাংলাদেশি প্রবাসী নিজাম উদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, দু’মাস কর্মহীন হয়ে বাসায় অলস সময় কাটাচ্ছি। আর্থিক ও মানসিকভাবে বেশ দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছি। বিশ্বব্যাপী করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে স্পেনে পর্যটক আসতে পারছে না। আর পর্যটক না আসতে পারলে হোটেলে কাজ শুরু করার কোন লক্ষণ দেখছি না।
তিনি আরও বলেন, রাজধানী মাদ্রিদ এবং বার্সেলোনায় শতাধিক বাংলাদেশি প্রবাসী পর্যটক খাতের বিভিন্ন ব্যবসার সাথে জড়িত। কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি। সবকিছু ঠিক মতোই চলছিল। হঠাৎ করোনার আঘাতে সবকিছু ওলটপালট করে দিয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার এসব ব্যবসায়ীদের সুদবিহীন ১০ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ২৫ হাজার ইউরো লোন দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, এসব লোন সাময়িকভাবে সহায়ক হবে। তবে পুরো দেশ করোনা মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসা স্বাভাবিক হবে না।
বার্সেলোনার রেস্টুরেন্ট ব্যবসায়ী বনি হায়দার মান্না বলেন, আমাদের ব্যবসা সম্পূর্ণ পর্যটকনির্ভর। বিশ্বের যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তা স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা দেখছি না। চলতি বছর ব্যবসা আর হবে না। আর্থিক যে বিশাল ক্ষতি সেটা কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লেগে যাবে। সত্যিকার অর্থে ব্যবসা টিকিয়ে রাখাই মুশকিল হয়ে যাচ্ছে।
স্পেনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ইতোমধ্যে জানিয়েছে, দেশটির মোট জনসংখ্যার শতকরা পাঁচ শতাংশ মানুষ এই মহামারির সংক্রমণের শিকার হযেছেন। বাকি ৯৫ শতাংশ মানুষ পরোক্ষভাবে মহামারির শিকার হলেও প্রাণঘাতী ভাইরাস তাদের স্পর্শ করতে পারেনি। এটি সরকারের জরুরি রাষ্ট্রীয় সতর্কতা, কঠোর আইন নিয়ন্ত্রণ ও মানুষকে বুঝিয়ে ঘরে আটকে রাখারই ফল। আর এখন পর্যন্ত শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষকে এই ভয়াবহ সংক্রমণ প্রবণ ভাইরাস থেকে মুক্ত রাখতে পারার জন্য দেশটির সরকার সাধুবাদ পেতেই পারে।