কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেখতে দেখতে আল কুরআন নাজিলের স্মৃতিধন্য মাহে রমজানের রহমতের দশকের শেষ পর্যায়ে আমরা এসে পৌঁছেছি। আগামীকাল শেষ হবে রহমতের দশকের। আজ পবিত্র কুরআনুল কারিমের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ সুরা নিয়ে কথা বলব। আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালার পাক কালাম কুরআনুল মাজিদের পঞ্চম সুরা হলো ‘সুরা আল মায়েদা’। এটি পবিত্র মাদানী সুরার অন্তর্ভুক্ত। মহানবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মদিনা জীবনের বিভিন্ন সময় এ সুরা নাজিল হয়েছিল। ষোলো রুকু বিশিষ্ট এ সুরার আয়াত বা বাক্য সংখ্যা ১২০।
আল মায়েদা অর্থ-দস্তরখানা, খাদ্যপাত্র, খাদ্যধার, খাদ্যভর্তি খাঞ্চা ইত্যাদি। সুরাটির পঞ্চদশ রুকুতে এ শব্দটি উল্লেখিত হয়েছে এবং তা থেকেই পূর্ণ সুরাটির নামকরণ। আমরা জানি মহান পয়গাম্বরে খোদা হযরত ঈসা (আ. যীশুখৃস্ট)’র বেশ কিছু অলৌকিকত্ব প্রকাশ পেয়েছিল। তাকে এবং তার জাতিকে আল্লাহতায়ালা অশেষ অনুগ্রহ দান করেছিলেন। কিন্তু এক পর্যায়ে ঈসা (আ.)-র অনুসারীগণ আল্লাহর দেয়া অনুগ্রহের অপব্যবহার করে। শিরক করে, কপটতা প্রদর্শন করে, দুনিয়ার পাওনাকে প্রধান্য দেয়, অমান্য করে নবীর হুকুম। যার কারণে বিভিন্নভাবে তাদের ওপর গজব নাজিল হয়। ইরশাদ হচ্ছে : ঈসা ইবনে মরিয়াম বললেন : ‘হে আল্লাহ, আমাদের পালনকর্তা! আমাদের প্রতি আকাশ থেকে খাদ্যভর্তি খাঞ্চা অবতরণ করুন। তা আমাদের জন্য অর্থাৎ আমাদের প্রথম ও পরবর্তী সবার জন্য আনন্দোৎসব (ঈদ) হবে এবং আপনার পক্ষ থেকে হবে একটি নিদর্শন। আপনি আমাদের রুজি দিন। আপনিই শ্রেষ্ঠ রিজিকদাতা।’
ঈসা নবীর (আ.) উক্ত প্রার্থনার পরে আকাশ থেকে খাদ্যদ্রব্য অবতীর্ণ হয়েছিল। তিরমিজী শরীফের হাদিসে সাহাবী হযরত আম্মার ইবনে ইয়াসির (রাদি.) থেকে বর্ণিত আছে যে, খাদ্যাধার আকাশ থেকে নাযিল হয়েছিল এবং তাতে রুটি এবং গোস্ত ছিল। তাদের কিছু সংখ্যক লোক বিশ্বাসভঙ্গে লিপ্ত হয়েছিল এবং পরবর্তী দিনের জন্য সঞ্চয় করে রেখেছিল। অথচ এ বেহেশতী আসমানী খানাপিনা সঞ্চয় করে না রাখার আগেই তাগিদ দেয়া হয়েছিল। আল্লাহ প্রত্যেক বেলাতেই আল্লাহ ও নবী বিশ্বাসী বান্দাদের সমাবেশে এ পবিত্র খাদ্য দান করার কথা। কপট বনী ইসরাঈল জাতি একবেলার বিতরণকৃত খাদ্য শরীরের বিভিন্ন কাপড় চোপড় ও ঝুলির বিভিন্ন অংশে খাবার লুকিয়ে রেখে অতিরিক্ত খাবার পাওয়ার জন্য মিথ্যা কাড়াকাড়ি করত। দয়াময় ন্যায়পরায়ন আল্লাহ তাদের এ অভ্যাস ও ইমানের কমজোরীকে পছন্দ করেননি। তিনি তাদের প্রতি অসন্তুষ্ট হন। ফলে তারা বানর ও শুকরে পরিণত হয়ে যায়।’-(বয়ানুল কুরআন)।
রুহুল মা’আনী গ্রন্থে সাহাবী হযরত আবু ওবায়দা, হযরত হামযা ইবনে হাবীব এবং আতীয়া ইবনে কায়স (রাদি.) বর্ণিত হাদিসে বলা হয়েছে : সুরা মায়েদা কুরআন অবতরণের শেষ পর্যায়ে নাযিল হয়েছে। এতে যা হালাল করা হয়েছে সেগুলোকে চিরকালের জন্য হালাল এবং যা হারাম করা হয়েছে চিরকালের জন্য হারাম মনে করো।’ ইবনে কাসীর এমনি ধরনের একটি বর্ণনা হযরত জোবাইর ইবনে নুফাইর (রাদি.) হতে বর্ণিত রয়েছে যে, তিনি একবার হজের পর হযরত আয়েশা সিদ্দিকার (রাদি.) কাছে উপস্থিত হলে তিনি বললেন : জোবাইর! তুমি কি সুরা মায়েদা পাঠ করো? তিনি আরজ করলেন : জি হ্যাঁ, পাঠ করি। উম্মুল মোমেনীন হযরত আয়েশা (রাদি.) বললেন : এটি কুরআন পাকের সর্বশেষ সূরা। এতে হালাল ও হারামের যেসব বিধিবিধান বর্ণিত আছে তা অটল, এগুলো রহিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। কাজেই এগুলোর প্রতি যত্নবান থেকো।’
সুরা মায়েদাতেও সুরা নিসার মতো বিভিন্ন বিষয়ের মাসলা-মাসায়েল, লেনদেন, পারস্পরিক চুক্তি অঙ্গীকার ইত্যাদি বিধিবিধান বর্ণিত হয়েছে। এ কারণেই রুহুল মায়ানীর গ্রন্থকার বলেন : বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে সুরা বাকারা ও সুরা আলে ইমরান অভিন্ন। কেননা এ দুটি সুরায় প্রধানত মৌলিক বিষয়সমূহ (কানুন, আকাঈদ) যথা তাওহীদ, রিসালাত, কিয়ামত ইত্যাদির কথা উল্লেখিত হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে অনেক খুঁটিনাটি বিষয়ও বর্ণিত হয়েছে। পক্ষান্তরে সুরা নিসা ও সুরা মায়েদা বিষয়বস্তুর দিক দিয়ে অভিন্ন। কেননা এ দুটি সুরায় প্রধানত বিভিন্ন বিধিবিধানের বিস্তারিত আলোচনা স্থান লাভ করেছে এবং মৌলিক বিধিসমূহ প্রসঙ্গক্রমে বর্ণিত হয়েছে। সুরা নিসার পারস্পরিক লেনদেন ও বান্দার হকের ওপর জোর দেয়া হয়েছে। স্বামী স্ত্রীর হক, এতিমের হক, পিতা-মাতা ও অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের প্রাপ্য অধিকারের বিস্তারিত বিবরণ পেশ করা হয়েছে। সুরা মায়েদার প্রথম আয়াতেও এসব লেনদেন চুক্তি- অঙ্গীকার মেনে চলা ও পূর্ণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। যেমন : ইয়া আইয়্যুহাল লাযিনা আমানু উফু বিল উকুদ।-হে মুমিনগণ, তোমরা ওয়াদা অঙ্গীকার পূর্ণ কর। এ কারণে অবশ্য সুরা মায়েদার অপর নাম সুরা ওকুদ। অর্থাৎ ওয়াদা অঙ্গীকারের সুরা-(বাহরে মুহীত)।
সুরা মায়েদা তিলাওয়াত করে আমরা যেমন অশেষ সাওয়াব অর্জন করতে পারি তেমনি এর অন্তর্নিহিত ব্যাখ্যা অনুধাবন করে আমরা সমাজ ও দেশের বহু সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে পারি।