কাজিরবাজার ডেস্ক :
ওফাত দিবসে ভুবনজয়ী চিকিৎসক ইবনে সিনাকে স্মরণ। রহমত মাগফিরাত ও নাজাতের মাস রমজানুল মুবারকের আজ চতুর্থ দিবস। আজকের এ দিনটি এলেই আমদের মনে পড়ে বিখ্যাত চিকিৎসা বিজ্ঞানী ইবনে সিনার কথা। তাদের মতো মহান দার্শনিকের এ করোনা পরিস্থিতিতে কত না জরুরী ছিল। আজ থেকে এক হাজার বছর আগে ৪ রমজান এ মহান চিন্তাশীল ভুবনজয়ী চিকিৎসককে আমরা হারিয়েছিলাম। যারা জ্ঞান সাধনার সর্বোচ্চ চূড়ায় আরোহণ করেন তারা দেশ, কাল ও ধমের গন্ডির বহু উর্ধে-মানুষ মাত্রেই তাদের আপনজন ভেবে গর্ববোধ করে। প্রায় হাজার বছর আগে এমনই এক অসামান্য জ্ঞান সাধক ধরাধামে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আজ তাকে ইরানী ও তুর্কীরা, আফগানী ও বলশেভিকরা আপন আপন জাতীয় বীর হিসেবে দাবি করছে। কিন্তু আমরা বলি, এ ধরনের মহামনীষীর কোন বিশেষ নাগরিকত্বেও ছাপ নেই। তারা যেখানেই ভূমিষ্ঠ হোন না কেন মানবকুল মাত্রেই তাদের অনন্ত উত্তরাধিকার। আবু আলী হোসাইন ইবনে সীনা ছিলেন সেই বিশ্ববরেণ্য জ্ঞানবীর। ‘তারিখুল হুকামা’ নামক দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিকদের জীবনীমূলক গ্রন্থে ইবনে সীনার ২১ খানি সুবৃহৎ ও ২৪টি ক্ষুদ্র গ্রন্থের বিশদ বর্ণনা আছে। তাছাড়া আরও পুস্তিকার সংখ্যা একত্র করলে ইবনে সীনার গ্রন্থসংখ্যা ৯৯টি হবে। তিনি দর্শন বিজ্ঞান, চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতিষ, অলঙ্কার শাস্ত্র, ভাষাতত্ত্ব, সঙ্গীত প্রভৃতি বিষয়ে গ্রন্থ রচনা করেছেন। তন্মধ্যে আঠারো খন্ডে সম্পাদিত ‘কিতাবুশ শিফা’ বা রোগ নিরাময়, আন্-নাজাহ’ বা মুক্তি লাভ, ওঢুনুল হিকমত বা দর্শনশাস্ত্রেও চক্ষুরাজি, এবং ‘কানুন-ফি-ত্ত্বিব’ নামক সুবৃহৎ চিকিৎসা বিজ্ঞান তার শ্রেষ্ঠ অবদান। এক কথায় তার ‘কানুন’ যেমন তাকে অসামান্য চিকিৎসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে তেমনই তার ‘শিফা’ তাকে বিশ্বের প্রথম শ্রেণীর দার্শনিকের মর্যাদা দান করেছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী কালস্রোত মিশে যাচ্ছে, কিন্তু গ্রন্থ দুটি ইবনে সিনার অক্ষয় কীর্তি হিসেবে তাকে অমর করে রেখেছে।
তিনি ছিলেন সুগভীর জ্ঞান ও উদার চিন্তার অধিকারী। তার দার্শনিক মতবাদের ব্যাখ্যার প্রাঞ্জলতা ও পূর্ণতার কাছে আল ফারবীর মতো শ্রেষ্ঠ দার্শনিকের খ্যাতিও মøান হয়ে যায়। এরিস্টটলের মতবাদকে সুসংঘবদ্ধ করে তার চিন্তাধারায় স্রষ্টা ও সৃষ্টির (আল্লাহ ও মানুষের) মধ্যকার শূন্যতাকে ইবনে সীনা তার ‘মাফলাত’ বা সৃষ্টি ম-লের জ্ঞানের বৈজ্ঞানিক ধারণা শক্তি দিয়ে পূরণ করেন। তিনি কেবল প্রাক্তন দার্শনিকদের মতবাদেরই পূর্ণ ব্যাখ্যা করেননি, গ্রিসের সমস্ত দার্শনিক চিন্তাধারাকে নিজের জ্ঞানের আলোকে সুশৃঙ্খলভাবে সাজিয়ে তিনি সভ্য জগতের সম্মুখে তুলে ধরেন এবং অধ্যাপক হিট্টির ভাষায়Ñ ইসলামের শিক্ষার সঙ্গে গ্রীক দর্শনের সামঞ্জস্য বিধানের যে সূচনা আলকিন্দি করেছিলেন ইবনে সিনা পাকা ওস্তাদের মতো তা সূচারুরূপে সম্পন্ন করেন।
এ মহান মনীষীর জন্ম হিজরি ৩৭০ খৃ. ৯৮০ সালে, রাশিয়ার আফসানা নামক এক পল্লীতে। তার বাবা আবদুল্লাহ ছিলেন একজন রাজকর্মচারী। এ সুবাদে বাল্যকাল হতেই তিনি, অনুকূলে পরিবেশে যোগ্য শিক্ষকম-লীর তত্ত্বাবধানে দ্বীনি ইলম ও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। আঠারো বছর বয়স পর্যন্ত তিনি দিন-রাত লেখা-পড়ায় ব্যাপৃত থাকেন। এমনকি নিদ্রাকর্ষণ যাতে তার লেখা-পড়ায় কোন রকম ব্যাঘাত ঘটাতে না পারে এ জন্য নিদ্রা প্রতিরোধক কিছু পান করতেন। ইবনে সিনার বয়স তখন ষোলো হতে আঠারোর কোটায়। সে সময় কুখারার শাসনকর্তা নুহ ইবনে মানসুর কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। কিছুতেই আরোগ্য লাভ করেননি। পরিশেষে ইবনে সিনার হাতেই তিনি সুস্থতা ফিরে পেয়েছিলেন। তার সফল চিকিৎসায় মুগ্ধ হয়ে বাদশাহ তাকে কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারিক নিযুক্ত করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য! তার এ সুখের দিন বেশি সময় দীর্ঘ হয়নি। তার পিতা ও বাদশাহ নুহ মৃত্যুবরণ করলে রাজ্যে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। যার দরুন তিনিও দেশ ত্যাগে বাধ্য হন।
১০০১ খ্রিস্টাব্দে তিনি খাওয়ারিযম পৌঁছেন। সেখানে তিনি আলী ইবনে মামুনের দরবারে মহাজ্ঞানী আল বিরুনী, আবু নসর, আবুল খায়ের প্রমুখ আলিম ও সুফির সঙ্গে সাক্ষাত করার সুযোগ লাভ করেন। ১০১৫ খ্রিস্টাব্দ জুরজান হতে ‘রায়’ এযাত্রাকালে ‘দায়লামে’ বুয়াইহী রাজত্বের অবসানে সে সমস্ত ছোট ছোট রাজ্যের উৎপত্তি হয়েছিল- সে অঞ্চলে অনেক কষ্ট ভোগ করেন। এ সময় তিনি কখনও মন্ত্রী, কখনও দার্শনিক, কখনও চিকিৎসক, কখনও বা উপদেষ্টার কাজ করতেন, আবার কখনও তাকে রাজনীতিমূলক অপরাধী রূপে গণ্য করা হতো। ১০২২ খ্রি তিনি আমির আলাউদ দৌল্লাহর সাহায্য লাভ করেন। ইনি স্বাধীন চিন্তা ও মতবাদের পোষক এবং জ্ঞানী ব্যক্তি ছিলেন। ইবনে সিনাকে তিনি সর্বদা নিজের কাছে কাছে রাখতেন এবং তারই সংস্পর্শে থাকাকালে ১০৩৭/৪২৮ সালের ৪ রমজান আল্লামা ইবনে সিনা ইন্তেকাল করেন।