কাজিরবাজার ডেস্ক :
পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যার তুলনায় করোনা শনাক্তের হার বাংলাদেশে বেশি। এদিক দিয়ে করোনা আক্রান্ত বিশ্বের প্রায় তিন চতুর্থাংশ দেশকেও পেছনে ফেলে দিয়েছে বাংলাদেশ। আর শনাক্ত হওয়া রোগীর সংখ্যার তুলনায় বাংলাদেশ খুবই কম নমুনা পরীক্ষা করছে। বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে নমুনা পরীক্ষা কয়েক গুণ বাড়ানো দরকার বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। বর্তমানে দেশে মোট পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যার ভিত্তিতে করোনা রোগী শনাক্তের হার ১২ শতাংশ। তবে এই হার ১৩ থেকে ১৭ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে থাকে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই হার অনেক কম। আর বাংলাদেশ বর্তমানে শনাক্তকৃত রোগী সংখ্যার তুলনায় ৯ গুণ বেশি নমুনা পরীক্ষা করছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশে এই হার আরও অনেকগুণ বেশি। ওয়ার্ল্ডোমিটার থেকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে বাংলাদেশে করোনার পরিস্থিতির এই চিত্র পাওয়া গেছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনা সংক্রমণ চতুর্থ ধাপের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনাভাইরাস সংক্রমণের চতুর্থ ধাপটি হলো ‘মহামারী’। এই ধাপে অসংখ্য মানুষ আক্রান্ত হয়। বাহক ও আক্রান্তের নির্দিষ্ট হিসাব রাখা সম্ভব হয়ে উঠে না। করোনা সংক্রমণের তৃতীয় পর্যায় ‘কমিউনিটি ট্রান্সমিশন’ ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে , যা মহামারী ধাপের পূর্ব মুহূর্ত। কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের শেষ পর্যায়ে এসে দৈনিক করোনা টেস্ট করার সক্ষমতা বর্তমান অবস্থার চেয়ে অনেক গুণ বাড়ানো না হলে দেশের করোনা পরিস্থিতির প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না। পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাওয়া না গেলে করোনা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমও সঠিক পথে পরিচালনা করা সম্ভব হবে না। আক্রান্তের সংখ্যা হঠাৎ বিস্ফোরিত হয়ে অস্বাভাবিক অবস্থার সৃষ্টি করবে, যা সামাল দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।
বাংলাদেশের করোনা পরিস্থিতি ॥ দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৬০টিতে করোনা শনাক্ত হয়েছে। চলতি বছরের গত ৮ মার্চ প্রথম রোগী শনাক্তের পর থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে দেশের করোনা রোগী ও মৃতের সংখ্যা। এ পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ৫৪১৬ এবং মোট নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে ৪৬৫৮৯টি। করোনায় মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪৫ জনে। বর্তমানে দেশে মোট পরীক্ষিত নমুনা সংখ্যার ভিত্তিতে করোনা রোগী শনাক্তের হার ১২ শতাংশ। তবে এই হার ১৩ থেকে ১৭ শতাংশের মধ্যে ওঠানামা করে থাকে। আর বাংলাদেশ বর্তমানে শনাক্তকৃত রোগী সংখ্যার তুলনায় ৯ গুণ বেশি নমুনা পরীক্ষা করছে। বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছে ৫১৪৯ জন করোনা রোগী। মোট আক্রান্তের ৮৫ শতাংশ করোনা রোগী ঢাকা বিভাগে। দেশের সব ক’টি বিভাগেই করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে।
বিশ্ব প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের পরীক্ষিত নমুনা ও রোগী সংখ্যা ॥ উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের স্পেন, ফ্রান্স ও যুক্তরাজ্যসহ আরও কয়েকটি দেশে গণহারে নমুনা পরীক্ষা করা হয়ে থাকে। শনাক্তকৃত রোগী সংখ্যার তুলনায় ৯ গুণ বেশি নমুনা পরীক্ষা করছে বাংলাদেশ। আর শনাক্তকৃত রোগীর তুলনায় জার্মানিতে ১৩ গুণ, রাশিয়ায় ৩৬ গুণ, কানাডায় ১৫ গুণ, ভারতে ২৪ গুণ, পর্তুগালে ১৪ গুণ, পেরুতে ৮৬ গুণ, সৌদি আরবে ১২ গুণ, অস্ট্রিয়ায় ১৫ গুণ, জাপানে ১১ গুণ, পাকিস্তানে ১১ গুণ, পোল্যান্ডে ২৫ গুণ, দক্ষিণ কোরিয়ায় ৫৬ গুণ, বেলারুশে ৭ হাজার গুণ, ডেনমার্কে ১৬ গুণ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৭২ গুণ, নরওয়েতে ২৯ গুণ, অস্ট্রেলিয়ায় ৭৪ গুণ, মালয়েশিয়ায় ২২ গুণ, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩৭ গুণ, মিসরে ২১ গুণ, থাইল্যান্ডে ৪৯ গুণ, কাজাখস্তানে ৬৯ গুণ, বাহরাইনে ৪৩ গুণ, উজবেকিস্তানে ১১২ গুণ, আজারবাইজনে ৭৫ গুণ, নিউজিল্যান্ডে ৮২ গুণ, ভিয়েতনামে ৭৬৩ গুণ, ভেনিজুয়েলায় ১৩১১ গুণ, দক্ষিণ এশিয়ার ভারতে ২৪ গুণ, পাকিস্তানে ১১ গুণ, শ্রীলঙ্কায় ৩০গুণ, মালদ্বীপে ৩০গুণ, নেপালে ১ হাজার গুণ ও ভুটানে ১২০০ গুণ বেশি নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে।
রোগী শনাক্তের ভিত্তিতে দক্ষিণ এশিয়া ও ইউরোপে বাংলাদেশের অবস্থান ॥ দক্ষিণ এশিয়ায় নমুনার সংখ্যার বিপরীতে করোনা রোগী শনাক্তের হার বাংলাদেশে ১২ শতাংশ, ভারতে ৪ শতাংশ, পাকিস্তানে ৯ শতাংশ, শ্রীলঙ্কায় ৪ শতংশ, মালদ্বীপে দশমিক ৩৫ শতাংশ, নেপালে দশমিক ১০ শতাংশ এবং ভুটানে দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ। ইউরোপের ইতালিতে ১২ শতাংশ, জার্মানিতে ৮ শতাংশ, পর্তুগালে ৭ শতাংশ, অস্ট্রিয়ায় ৭ শতাংশ, নরওয়ে ৫ শতাংশ।
রোগী শনাক্তের ভিত্তিতে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশ ॥ দক্ষিণ এশিয়ায় নমুনার সংখ্যার বিপরীতে করোনা রোগী শনাক্তের হার বাংলাদেশে ১২ শতাংশ, কম্বোডিয়ায় শূন্য দশমিক ৮৮ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ায় ১৩ শতাংশ, মালয়েশিয়ায় ৫ শতাংশ, ফিলিপিন্সে ৯ শতাংশ, সিঙ্গাপুরে ১১ শতাংশ, থাইল্যান্ডে ২ শতাংশ, ভিয়েতনামে দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, মিয়ানমারে ২ শতাংশ, তিমুরে ৭ শতাংশ।
অন্যান্য দেশে রোগী শনাক্তের হার ॥ রাশিয়ায় ৩ শতাংশ, কানাডায় ৭ শতাংশ, সৌদি আরবে ৭ শতাংশ, জাপানে ৯ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩ শতাংশ, মিসরে ৫ শতাংশ, কাজাখস্তানে ১ শতাংশ, বাহরাইনে ২ শতাংশ, উজবেকিস্তানে ১ শতাংশের নিচে, নিউজিল্যান্ডে ১ শতাংশ, হংকংয়ে ১ শতাংশের নিচে, ভেনিজুয়েলায় ১ শতাংশের নিচে।
রোগী শনাক্ত ও নমুনার সংখ্যা ॥ শনাক্তকৃত রোগী ও পরীক্ষিত নমুনার সংখ্যা বাংলাদেশে যথাক্রমে ৫৪১৬ ও ৪৬৫৮৯ , জার্মানিতে ১৫৬৫১৩ ও ২০৭২৬৬৯, রাশিয়ায় ৭৪৫৮৮ ও ২৭২১৫০০, কানাডায় ৪৫৩৫৪ ও ৬৮৪২৭১, ভারতে ২৬৪৯৬ ও ৬২৫৩০৯, পর্তুগালে ২৩৩৯২ ও ৩৩০৫১২, পেরুতে ২৫৩৩১ ও ২১৮১৯৫, সৌদি আরবে ১৬২৯৯ ও ২০০০০০, অস্ট্রিয়ায় ১৫১৪৮ ও ২২১০৯৮, জাপানে ১৩২৩১ ও ১৪৭৪৫৬, পাকিস্তানে ১২৭২৩ ও ১৪৪৩৬৫, পোল্যাল্ডে ১১২৭৩ ও ২৭৮৯৯৪, দক্ষিণ কোরিয়ায় ১০৭২৮ ও ৫৯৮২৮৫, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৯৮১৩ ও ১০২২৩২৬, বেলারুশে ৯৫৯০ ও ১৩৯২৯৫, ডেনমার্কে ৮৪৪৫ ও ১৩৬৭৩৮, নরওয়ে ৭৪৯৯ ও ১৫৫১২৫, অস্ট্রেলিয়ায় ৬৭১০ ও ৪৯৯০০০, মালয়েশিয়ায় ৫৭৪২ ও ১২৬৯৭০, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৪৩৬১ ও ১৬১০০৪, মিসরে ৪৩১৯ ও ৯০০০০, থাইল্যাল্ডে ২৯০৭ ও ১৪২৫৮৯, কাজাখস্তানে ২৬০১ ও ১৮০৫০২, বাহরাইনে ২৫৮৮ ও ১১০৩৭৯, উজবেকিস্তানে ১৮৬২ ও ২১০০০০, আজারবাইজানে ১৬১৭ ও ১২০৪৭৯, নিউজিল্যান্ডে ১৪৭০ ও ১২০৯৮১, ভিয়েতনামে ২৭০ ও ২০৬২৫৩, পাকিস্তানে ১২৭২৩ ও ১৪৪৩৬৫, শ্রীলঙ্কায় ৪৬০ ও ১৩৮৫০, মালদ্বীপ ১৭৭ ও ৫২৯৬, নেপালে ৪৯ ও ৪৯৩৩৬ এবং ভুটানে ৭ জন শনাক্ত ও নমুনার সংখ্যা ৮৯৫৩টি।
নমুনার সংখ্যা বাড়াতেই হবে ॥ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালর ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডাঃ সাইফ উল্লাহ মুন্সী বলেন, বাংলাদেশ ইতোমধ্যে করোনা সংক্রমণের চতুর্থ ধাপের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। সংক্রমণের বর্তমান অবস্থাকে কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের ক্লাস্টার বলে চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা ঠিক হবে না। সংক্রমণের কমিউনিটি ট্রান্সমিশন অনেক আগেই শুরু হয়ে ক্লাস্টার অতিক্রম করে ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে। ইউরোপের করোনা আক্রান্ত প্রতিটি দেশে শত শত নমুনা টেস্ট সেন্টার স্থাপিত হয়েছে। ইউরোপের কথা বলতে হবে না, দক্ষিণ কোরিয়াতেই রয়েছে প্রায় ৬শ’টি নমুনা টেস্ট ল্যাবরেটরি। আগামী ১০ দিনের মধ্যে ন্যূনতম ৫০ হাজার নমুনা টেস্ট করার লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করতে পারলে দেশের করোনা পরিস্থিতির আরও পূর্ণাঙ্গ চিত্র বেরিয়ে আসবে।
সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডাঃ জাহিদুর রহমান বলেন, দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশে সংস্পর্শে আসা সবাইকে পরীক্ষার আওতায় আনা হয়নি। আইইডিসিআর এ কাজটি করতে পারেনি। পরীক্ষা তো পরের কথা, তারা কন্টাক্ট ট্রেসিংয়ের কাজটাই একেবারে দায়সারা গোছের করেছেন। এমনকি লক্ষণ প্রকাশের পরও তারা সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের পরীক্ষা করতে গড়িমসি করেছেন। এখন ল্যাবরেটরির সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় নমুনা পরীক্ষায় এখনও পেছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। দেশের বর্তমান করোনা পরিস্থিতির পূর্ণাঙ্গ চিত্র পেতে ব্যাপক হারে নমুনা পরীক্ষার বিকল্প নেই।