আতিকুর রহমান নগরী :
আরবি বারো মাসের মধ্যে রমজান হচ্ছে নবম মাস। আসমানী রহমতের বার্তা আর অফুরন্ত মাগফিরাতের আহবান নিয়ে এ মোবারক মাহিনা আমাদের মাঝে হাজির হয়েছে। বছরের বাকি এগারো মাসের তুলনায় এ মাসটির ফযিলত ও বরকত অনেক বেশী।
মানবজাতিরা যখন সারাটি বছর খোদার নাফরমানি আর উল্টোমি করে কাটিয়ে দেয়, ঠিক তখনই সেসব ভূলের মাশুল দিতে ক্ষমার শ্লোগান নিয়ে মানুষকে নিস্পাপ আর পাপরাশিকে ভস্ম করার জন্য আগমন করেছে মাহে রমজান।
“রমজান” আরবি শব্দ। যা বিভিন্ন অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে। কিন্তু মূলত: এর অর্থ হচ্ছে ভষ্ম করে দেয়া, ঝলসে দেয়া। এ মাসটির নামকরনের কারণ হচ্ছে, সর্বপ্রথম রোজার বিধান যে মাসে এসেছিল সে মাসটি ছিল প্রচন্ড গরমের। ঝলসে দেয়ার মত গরম,তাই এর নাম রাকা হয়েছে ‘রমজান’। তবে আলিমগন বলেন,‘বান্দা যেহেতু এ মাসের বিধানাবলি সুচারুরূপে পালন করে বিধায় আল্লাহ তালা তাঁর সমস্ত পাপকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ভষ্ম করে দেন।
তাই এ মাসকে ‘রমজান’ বলা হয়।
আমরা সাধারণত: মনে করে থাকি রমজান মাসের বৈশিষ্ট্য শুধু ‘রোজা রাখা আর তারাবিহ পড়া। এগুলো রমজানের প্রধান দুটি ইবাদত বটে। এছাড়াও এ মাসটির রয়েছে ভিন্ন এক উদ্দেশ্য। যেমন আল্লাহ পাক মহাগ্রন্থ আল ক্বোরআনে ইরশাদ করেন,“আমি তোমাদের উপর রোজা ফরজ করেছি যেমনিভাবে করেছিলাম তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর যাতে তোমরা মুত্তাক্বি হতে পার’’। সুতরাং রমজানের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে তাক্বওয়া বা খোদাভীতি অর্জন। বিগত বছরের সকল পাপাচার থেকে মুক্ত করে তোলাই হচ্ছে এ মাসের প্রধান পয়গাম। এ মাসটির ফযিলত বর্ণনা করতে গিয়ে হযরত সালমান ফারসি (রা.) বলেন, একবার নবিয়ে করিম (সা.) শাবানের শেষ তারিখে আমাদেরকে সম্বোধন করে বলেন,“হে মানবজাতি! তোমাদের মধ্যে এমন একটি মোবারক মাস উপস্থিত হয়েছে যে মাসটির মাঝে এমন একটি রাত রয়েছে যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম।
মানবজাতির ধর্মীয়গ্রন্থ আল্-ক্বোরআন যে মাসে নাজিল হয়েছে এটা অবশ্যই কারো অজানা নয়। আর অজানাদের জন্য আল্লাহ পাকের ঘোষনা রয়েছে “রমজান সেই মাস যে মাসে নাজিল করা হয়েছে মানুষের জন্য হেদায়ত এবং পথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্যকারী”। (সুরা:১,আয়াত:১৮৫)
ক্বোরআন নাজিলের ব্যাপারে আল্লাহ পাক সুরা বাকারার ১৮৪ নং আয়াতে বলেন.‘আইয়্যামাম মাদূদাত’ এ বাক্যটি ছিল সংক্ষিপ্ত। তারই ব্যাখ্যা করা হয়েছে উল্লেখিত আয়াতে। এ মাসটির অন্যতম ফযিলত হল ‘একে আল্লাহ পাক স্বীয় ওহি এবং আসমানি কিতাব নাজিল করার জন্য নির্বাচিত করেছেন। সুতরাং রমজান মাসই হচ্ছে ক্বোরআন নাজিলের মাস। পবিত্র ক্বোরআনের ৩০নং পারার সূরা ক্বদরে আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন, “নিশ্চয় আমি তা নাজিল করেছি ক্বদরের রাতে”। আর ক্বদরের রাত হল রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত। উপরোল্লেখিত আয়াতের ভাষ্যানুযায়ী বুঝা গেল যে,‘রমজান ক্বোরআন নাজিলের মাস’।
এ পর্যায়ে আমাদের করণীয় সম্পর্কে মুখতাসার ভাবে আলোচনা করবো যা ভালভাবে অনুধাবন করলে এ মাসের করণীয় কী তা বুঝা মুশকিল হবে না।
মুসলমান হিসেবে যেমন ইসলামি শিক্ষা অর্জন করা সকলের উপর ফরজ। ঠিক তেমনিভাবে মুসলমানিত্ব বজায় রেখে যুগ চাহিদার কোরাক যোগাতে কলেজ-ভার্সিটিতেও পড়া সওয়াবের কাজ। রমজান ছাড়া প্রায় এগারোটি মাস আমরা সবাই স্কুল-কলেজ, ভার্সিটির লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাই। ক্বোরআন তেলাওয়াত বা ক্বেরাত চর্চার তেমন একটা সুযোগ মিলে না। রমজান মাসে খোদার তরফ থেকে যে বরকত প্রদান করা হয় তা ভাষায় প্রকাশ করার মত নয়।
শরিয়তের দৃষ্টিকোন থেকে ক্বোরআন তেলাওয়াত: ক্বোরআন তেলাওয়াত শিখা ফরজে কিফায়া আর তাজবিদ সহকারে তেলাওয়াত করা ফরজে আইন। আর এ ফরজে আইনের শিক্ষাকে অর্জন করলে বিশুদ্ধভাবে তেলাওয়াত করা যাবে,আর অন্যকে শেখানোও সম্ভব হবে।
তাজবিদ সংকলনের প্রেক্ষাপট: ক্বোরআন তেলাওয়াতে ভুল হওয়া এটা কোন নতুন ব্যাপার নয়, বরং হযরত ফারুক্বে আযমের যামানায় এক গ্রাম্য ব্যক্তি লোকমহলে ক্বোরআন ভুল পড়েছিল। ঘটনাটি হযরত উমর (রা.) জানতে পেরে তাকে ডেকে এনে ভুলটি শুদরিয়ে দেন।
লক্ষ্য করুন হাল যামানায় আমাদের চারদিকে আলিম-উলামা, মুফতি-মুহাদ্দিস, ইমাম-মুয়াজ্জিন বিশুদ্ধভাবে ক্বোরআনের খেদমত করার জন্য প্রণপন চেষ্টা অব্যাহত রেখেছেন। তা আমাদেরকে ফারুক্বে আযমের সেই যুগকে স্মরণ করিয়ে দেয়।
বিশুদ্ধভাবে ক্বোরআন তেলাওয়াতে যে কেমন সুওয়াব তা আমাদের কারো অজানা নয়, তদুপরি স্মরণ করিয়ে দেয়াকে আমি ঈমানি দ্বায়িত্ব মনে করি। ক্বোরআন শিখা আর শিখানো যে কত মর্যাদা এবং ফজিলতের কাজ। এসম্পর্কে মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন,“তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সেই ব্যক্তি যে নিজে ক্বোরআন শিখে আর অন্যকে শিখায়”। অন্য রেওয়ায়তে বর্ণিত আছে যে, “ক্বোরআন তেলাওয়াই হচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত”। উপরোক্ত হাদিসের দ্বারা বিশুদ্ধ তেলাওয়াতই উদ্দেশ্য।
মোবারক এ মাহিনায় বেশি বেশি করে ক্বোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার, তাসবিহ-তাহলিল, তাহাজ্জুদ-নফল সালাত আদায় করা একান্ত জরুরী। আমাদের কি কারো ইচ্ছে করে না যে আমিই সর্বোত্তম ব্যক্তি বিবেচিত হই। আর তা ঠিক তখনই সম্ভব হবে যখন নিজে বিশুদ্ধভাবে ক্বোরআন শিখে অন্যকে শিখাবো। অতএব; আমাদের করণীয় হবে, আমরা নিজ জিম্মায় নিজেদের ছেলেমেয়ে, ভাইবোন নিকটাত্মিয়দের পাঠিয়ে আল্-ক্বোরআনের মহান শিক্ষা অর্জন করে দুনিয়া ও আখেরাতের অফুরন্ত নেয়ামত এবং অশেষ কামিয়াবি হাসিল করুন।
আল্লাহ যেনো আমাদের সবাইকে ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করার তৌফিক দান করুন। আমিন।