স্পোর্টস ডেস্ক :
এ খেলা রাজার খেলা! এ খেলা জেন্টালম্যানের! শেষ বল অবধি টানটান উত্তেজনা। কেউ জানে না, কোথায় শেষ হতে চলেছে। সেই খেলাই এখন তাবড় ব্যাটসম্যানদের জিম্মায়। যে ব্যাটসম্যান যত বোলারকে যত বেশি জব্দ করতে পারবেন– ম্যাচ পকেটে পুড়ে নিয়ে চলে যাবেন তিনিই। একটা সময় ছিল যখন ক্রিকেট সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রিত হত বোলারদের জাদুকরিতে।
বর্তমান সময়ে দুনিয়ার সেরার সেরা বোলারদের দেখছি ঝুড়ি-ঝুড়ি ওয়াইড, নো-বল করতে। কিন্তু এই ক্রিকেটই এমন সব জাদুকর বোলারদের উপহার দিয়েছে যাঁরা নিজের ক্যারিয়ারে একটাও ওয়াইড বল করেননি। তাঁদেরই বোলিং জাদুকরির কিছু তথ্যে চোখ রাখা যাক।
রিচার্ড হ্যাডলি
বিশ্ব ক্রিকেট ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে নিউজিল্যান্ডের অলরাউন্ডার রিচার্ড হ্যাডলির নাম। বিশ্বের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডারদের একজন রিচার্ড। ১৭ বছর ধরে নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটকে খ্যাতির শিখরে নিয়ে যাওয়ার অন্যতম কারিগর হ্যাডলি। ৮৬টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ৪৩১টি উইকেট নিয়েছিলেন রিচার্ড হ্যাডলি। তার বোলিং এমনই নিখুঁত করতেন যে, জীবনে কখনও ভুল করেও একটি ওয়াইড বল করেননি রিচার্ড। অন্যদিকে ১১৫টি একদিনের ম্যাচ খেলে ১৫৮ উইকেট নিয়েছেন এই অলরাউন্ডার।
ল্যান্স গিবস
ক্রিকেট ইতিহাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ল্যান্স গিবসকে বিশ্বের অন্যতম সফল স্পিনার হিসেবে গণ্য করা হয়। খুবই অল্পসংখ্যক কিছু বোলার রয়েছেন যাঁদের ইকোনমি রেট প্রতি ওভারে মাত্র ২ রান। ল্যান্স তাঁদেরই একজন। ইংল্যান্ডের ফ্রেড ট্রুম্যানের পর গিবসই একমাত্র বোলার যিনি টেস্টে ৩০০ উইকেট নিয়েছিলেন খুবই অল্প সময়ে। আর স্পিনার হিসেবে তিনিই প্রথম। ৩৯ বছর বয়সে এক দিনের ম্যাচ খেলতে নামেন ল্যান্স। তাই সেখানে উল্লেখযোগ্য কিছুই ছাপ রেখে যেতে পারেননি। ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে মাত্র তিনটি একদিনের ম্যাচ খেলেছিলেন এই ধুরন্ধর স্পিনার। দলের জার্সি গায়ে মোট ৭৯টি টেস্ট ম্যাচ খেলে ৩১১ উইকেট নিয়েছিলেন গিবস। ১৮টি ৫ উইকেট নেওয়ার রেকর্ডও রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। আর এই ল্যান্স গিবস নিজের গোটা ক্রিকেট কেরিয়ারে একটাও নো বা ওয়াইড বল করেননি।
ক্ল্যারি গ্রিম্মেট
জন্ম তাঁর নিউজিল্যান্ডে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া দলের হয়েই ক্রিকেট খেলতেন বিধ্বংসী বোলার ক্ল্যারি গ্রিম্মেট। বিশ্বজুড়ে ক্রিকেট শুরু হওয়ার সময়ে ক্ল্যারিকেই দুনিয়ার সেরা স্পিন বোলার হিসেবে মনে করা হত। আজ যে স্পিন বোলিংয়ে ফ্লিপার নামক শব্দটি খুব শুনে থাকি, সেই ফ্লিপারের স্রষ্টা আদতে এই ক্ল্যারিই। ওয়েলিংটনে ১৭ বছর বয়সে ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটে নাম লেখান তিনি। কিন্তু সেই সময়ে নিউজিল্যান্ডে ক্রিকেট খেলার এত চল ছিল না বলেই ১৯১৪ সালে ক্ল্যারি অস্ট্রেলিয়ায় এসে খেলা শুরু করেন আবার। ৩৭টি টেস্ট খেলেছেন। মোট বল করেছেন ১৪,৪৫৩টি। ২১৬ উইকেট নিয়েছেন, যার মধ্যে ৫ উইকেট রয়েছে ২১ বার। কিন্তু হাত ফসকে কখনও একটা ওয়াইড বল বেরোয়নি ক্ল্যারির হাত থেকে।
ডেরেক আন্ডারউড
প্রাক্তন ইংল্যান্ড বাঁ হাতি বোলার ডেরেক আন্ডারউড ক্রিকেট ছাড়ার পর ম্যারিলিবোন ক্রিকেট ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হয়ে যান। মূলত ভিজে মাটিতেই তিনি জাদু দেখাতেন। তাঁর ইনস্যুউং ছিল আরও জনপ্রিয়। আইসিসি টেস্ট বোলার র্যাঙ্কিং অনুযায়ী, ১৯৬৯ সাল থেকে অগাস্ট ১৯৭৩ সাল অবধি বিশ্বের এক নম্বর বোলার ছিলেন ডেরেক। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে ৮৬টি টেস্ট খেলে তুলে নিয়েছিলেন ২৯৭ উইকেট। তবে গোটা ক্যারিয়ারে একটাও ওয়াইড বল করেননি ডেরেক আন্ডারউড।
গ্যারি সোবার্স
প্রায় দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে ক্যারিবিয়ান ক্রিকেট দাপিয়েছেন স্যার গ্যারি সোবার্স। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে প্রথমেই নাম আসবে সোবার্সের। স্যার ডন ব্র্যাডম্যান তো গ্যারি সোবার্সের কে বলতেন, এই একজনের মধ্যেই পাঁচ ক্রিকেটারের গুণাবলী রয়েছে! এমনকি উইকেটকিপিংয়েও চমক দেখানোর সমস্ত ক্ষমতাই ছিল গ্যারির। সবমিলিয়ে যেন নিজেই একটা প্যাকেজ ছিলেন সোবার্স। ক্যারিয়ারে একটা ওয়াইড বল করেননি।
ইমরান খান
এখন তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। দুরন্ত বোলিং, অধিনায়কত্বের অন্যতম সেরা ছন্দ– এই সব মিলিয়ে পাকিস্তান ক্রিকেটের ভোল বদলে দিয়েছিলেন ইমরান খান। ১৯৮২ সাল থেকে পাকিস্তানের অধিনায়কত্ব করেন ইমরান। দলকে খ্যাতির শিখরে পৌঁছে দেন বেশ কয়েক বছরের মধ্যেই। পাকিস্তানের একমাত্র বিশ্বকাপ জয় এসেছিল তাঁর অধিনায়কত্বেই। জরুরি উইকেট তুলে নেওয়ার পাশাপাশিই সে বার ৭২ রানের একটি দুর্দান্ত ইনিংস খেলেছিলেন ইমরান। পাকিস্তানের হয়ে ৮৮টি টেস্ট ম্যাচ এবং ১৭৫টি একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন খান। পর্যায়ক্রমে নিয়েছেন ৩৬২ এবং ১৮২টি উইকেট। কিন্তু জীবনে কখনও একটা ওয়াইড বল করেননি ইমরান খান।
ইয়ান বোথাম
বিশ্বের সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার হিসেবে নাম জ্বলজ্বল করবে প্রাক্তন ইংল্যান্ড ক্রিকেটার ইয়ান বথামের। ১৯৮০ সালের দিকে ব্যাটিং এবং বোলিং দুই দিকেই ইংল্যান্ডকে বহু ম্যাচ জেতানোর অন্যতম কান্ডারি ছিলেন ইয়ান। প্রথম কোনও ক্রিকেটার হিসেবে একটি টেস্টে সেঞ্চুরি এবং ১০ উইকেট নেওয়ার নজিরও গড়েছিলেন বোথাম। টেস্টে ৩৮৩ এবং ওয়ানডে ১৪৫ উইকেট নিয়েছেন তিনি। হাত থেকে কখনও একটা ওয়াইড বলে বেরিয়ে যায়নি বোথামের।
ডেনিস লিলি
বিশ্বের সর্বকালের সেরা কয়েকজন ফাস্ট বোলারের নাম নিলেই প্রথমে ডেনিস লিলির কথা মাথায় আসবে। ১৯৭০-৮০ সাল অবধি অস্ট্রেলিয়া দলের হয়ে দাপটের সঙ্গে বোলিং করে গিয়েছেন লিলি। ১৩ বছরের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ারে টেস্টে ৩৫৫ উইকেট এবং ওয়ানডে ১০৩ উইকেট রয়েছে ডেনিস লিলির। ২৩টি ৫ উইকেট এবং ৭টি ১০ উইকেট নেওয়ার নজির রয়েছে তাঁর। তবে কখনও একটাও ওয়াইড বা নো বল করেননি ডেনিস লিলি।
বব উইলিস
১৯৭১ সাল থেকে ১৯৮৪ সাল অবধি ইংল্যান্ড বোলিং অ্যাটাকের তুরুপের তাস ছিলেন বব উইলিস। ১৯৮১ সালে ইংল্যান্ডকে অ্যাশেজ জেতানোর অন্যতম কারিগর ছিলেন উইলিস। ৯০ টেস্ট ম্যাচ খেলে ৩২৫টি উইকেট নিয়েছেন তিনি। অন্যদিকে ওয়ানডে-তে ৬৪ ম্যাচ খেলে ৮০ উইকেট রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। তবে জীবনে কখনও একটা ওয়াইড বল করেননি তিনি।
ফ্রেড ট্রুম্যান
শুরু সেই ১৯৪৮ সাল থেকে। তারপর দুই দশক ইংল্যান্ডের হয়ে বোলিং করেছেন জাঁদরেল বোলার ফ্রেড ট্রুম্যান। ১৯৫০ সালে ফ্রেড ট্রুম্যান এবং ব্রায়ান স্টাথ্যামের বোলিং জাদু যেন প্রতিপক্ষের কাছে আতঙ্কের বিষয় ছিল। ফার্স্ট ক্লাস ক্যারিয়ারে ৬০৩ ম্যাচ খেলে ২৩০৪টি উইকেট নিয়েছিলেন ফ্রেড। অন্যদিকে, ৬৭টি টেস্ট ম্যাচে তাঁর সংগ্রহ ৩০৭ উইকেট। সেরা ৩১ রান দিয়ে ৮ উইকেট। সে সময় এই পারফরম্যান্স যেন কল্পনাতীত ছিল। এক সিজনে মোট ১২টি ম্যাচ খেলে ১০০ উইকেট নেওয়ার নজিরও গড়েছিলেন ফ্রেড। তবে জীবনে ভুলবশতও কখনও একটা ওয়াইড বল করে রান দেননি ফ্রেড ট্রুম্যান।