কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনা ভাইরাসের অর্থনৈতিক সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশের প্রতিটি স্তরের মানুষ প্রণোদনা পাবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে অনুদান গ্রহণকালে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অর্থনীতির চাকা যাতে সচল থাকে সেজন্য ইতোমধ্যে আমরা প্রণোদনা ঘোষণা দিয়েছি, সেটা সর্বস্তরের মানুষ পাবে। শিল্প কলকারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্য যাতে সচল থাকতে পারে সেই ব্যবস্থাও নিয়েছি। আমরা আমাদের জিডিপির ৩.৩ শতাংশ এই বিশেষ প্রণোদনা খাতে এবার ব্যয় করব, সেই সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি।
এই প্রণোদনা শুধু এখনকার জন্য নয় জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের এখনকার যেই সমস্যা সেটা সমাধান করা, মধ্যমেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি অর্থাৎ আগামী তিন অর্থবছর মেয়াদি যে পরিকল্পনা, আমরা সেটাই নিচ্ছি। যাতে প্রত্যেকেই করোনাভাইরাসের এই দুঃসময়টা পার করে যেন মানুষ আবার ব্যবসা-বাণিজ্য বা কার্যক্রম ভালোভাবে চালাতে পারেন সেই লক্ষ্য সামনে রেখেই আমরা তিন বছর মেয়াদি এই প্রণোদনার ঘোষণা দিয়েছি।
করোনাভাইরাস মহামারিতে পুরো বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেওয়ার আশঙ্কার কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আজকে শুধু বাংলাদেশ বলে না, পুরো বিশ্বেই কিন্তু এর একটা প্রভাব পড়বে। কিন্তু বাংলাদেশকে আমরা সুরক্ষিত রাখতে চাই। সেজন্য আমাদের কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি করা, খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা এবং খাদ্যের নিরাপত্তাটা নিশ্চিত করার জন্য আমরা বিশেষভাবে জোর দিচ্ছি, যাতে মানুষ কষ্ট না পায়। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছি।
রেশন কার্ডে ৫০ লাখ মানুষের ১০ টাকা কেজি দরে চাল সংগ্রহের যে তালিকা সরকারের কাছে রয়েছে, তার পাশাপাশি যারা তালিকার বাইরে আছেন তাদের জন্যও কার্ড তৈরির উদ্যোগের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। প্রতিটি মানুষ যেন সহায়তাটা পায় সেটা আমরা নিশ্চিত করতে চাই, যাতে প্রত্যেকের ঘরে ত্রাণ সহযোগিতাটা পৌঁছে যায়।
ভাইরাস সংক্রমণ এড়াতে রাতে মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দেওয়ার কথা উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, আমরা রাত্রের বেলা প্রতিটা বাড়িতে বাড়িতে খাবার পৌঁছে দিচ্ছি, যাতে করে কেউ ভিড় না করে, একসাথে জমা না হয়। করোনাভাইরাসটায় কেউ যাতে সংক্রমিত না হয় সেদিকে লক্ষ রেখে এই পদক্ষেপ নিচ্ছি।
বিচ্ছিন্নভাবে জনসমাগম করে ত্রাণ বিতরণ না করে প্রশাসনের মাধ্যমে সমন্বিতভাবে ত্রাণ বিতরণ করারও পরামর্শ দেন সরকার প্রধান। তবে দরিদ্র মানুষের জন্য পাঠানো এই ত্রাণ বিতরণে কোনো অনিয়ম করলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে হুশিয়ার করে দেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, এই রিলিফ দেওয়া নিয়ে যদি কোনো রকম সমস্যা হয় সাথে সাথে আমরা কার্যকর আইনগত ব্যবস্থা নিচ্ছি। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটা জায়গায় সমস্যা পেয়েছি। খুব বেশি না এইটা। আমরা যদি তুলনা করি আমাদের প্রায় ৬৮ হাজারের উপরে নির্বাচিত প্রতিনিধি রয়েছে বিভিন্ন এলাকায়। আমাদের ৪ হাজার ৫০০ এর উপরে ইউনিয়ন, আমাদের উপজেলা। সব হিসেব করে দেখা গেল হয়ত ৫-৭টা জায়গায় কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছে। যে-ই এর সঙ্গে জড়িত সে যে দলেরই হোক তাদের বিরুদ্ধে আমরা যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছি, ব্যবস্থা নেব। কারণ গরিবের জন্য আমরা যেটা দেব সেটা কেউ কোনো রকম অপব্যবহার করবে, এটা আমরা বরদাস্ত করব না। সেটা আমার দলেরই হোক বা অন্য দলেরই হোক আমরা এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
ত্রাণ বিতরণে ‘অনিয়ম’ নিয়ে যারা উচ্চকণ্ঠ তাদেরও সমালোচনা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি অনেকে অনেক কথা বলে বেড়াচ্ছেন, অনেক দল, অনেক সুধী সমাজ বা অনেকেই। কিন্তু তারা মানুষের সাহায্যে কিন্তু এগিয়ে আসছে না। সমালোচনা করতেই ব্যস্ত। ৬৮ হাজার জায়গায় যদি আমরা দিতে পারি আর সেখানে যদি ৫-৬টা জায়গায় সমস্যা হয় সেটা নিয়েই তারা চিৎকার করে যাচ্ছেন। তারা কিন্তু একটা মানুষকে একটি পয়সা দিয়েও সাহায্য করছেন না বা তাদের পাশে দাঁড়াচ্ছে না। তারা কথা বলেই যাচ্ছেন। সব সমাজেই এমন কিছু কথা বেচা লোক থাকে। তারা কথা বেচেই যাবে। এটাই তাদের প্রফেশন। সেটাই তারা করে যাচ্ছেন।
সমালোচকদের উদ্দেশে শেখ হাসিনা বলেন, কথা না বলে মানুষকে সাহায্য করেন। এই দুঃখের সময় মানুষের পাশে দাঁড়ান। এত কথা না বলে মানুষকে নিজে কতটুকু দিলেন, সে হিসেবটা দেন মানুষের কাছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা আমাদের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন এবং সেটা আমরা কার্যকর করে যাচ্ছি। চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য কাজ করে যাচ্ছি। চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতিটি সদস্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। সমস্ত বাংলাদেশে আমাদের যে নেতা-কর্মী তাদেরকেও আমরা নির্দেশ দিয়েছি। তারাও মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন। সরকারিভাবে যা দেওয়া হচ্ছে পাশাপাশি যে যতটুকু পারছেন সাহায্য করে যাচ্ছেন।
ত্রাণ দিতে আসা বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, মানুষের সেবায় যারা এগিয়ে এসেছেন তাদের সবাইকে আমি আন্তরিক ভালোবাসা জানাচ্ছি। করোনাভাইরাসের কারণে সরাসরি উপস্থিত থেকে আপনাদের কাছ থেকে দরিদ্র মানুষের সেবায় দেওয়া অনুদান গ্রহণ করতে পারলাম না। যেহেতু আমরা নিজেই বলেছি সকলকেই ঘরে থাকার নির্দেশ, সেটা ভঙ্গ করা উচিত না।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় সরকারের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথাও তুলে ধরেন সরকার প্রধান। ভাইরাস সংক্রমণ থেকে সুরক্ষায় লোকসমাগম এড়িয়ে চলার পাশাপাশি সবার ঘরে থাকার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন শেখ হাসিনা। বলেন, পরিবার নিয়ে একসঙ্গে থাকুন সেটা ঠিক আছে, কিন্তু বাইরের লোকের সঙ্গে না মেশা। যেখানে লোক সমাগম সেখানে না যাওয়া, নিজেকে সুরক্ষিত করা এবং নিজেকে সুরক্ষিত করার সঙ্গে সঙ্গে অপরকেও সুরক্ষিত করা। সেই দায়িত্ব সকলকে পালন করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা এটাই চাই, আজকের যে দুঃসময় সেই দুঃসময়টা কাটিয়ে উঠতে পারব। বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাবে এবং বাংলাদেশকে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ হিসেবেই ইনশাআল্লাহ আমরা গড়ে তুলব।
আজ যারা অনুদান প্রদান করেছে—যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগ, ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বিইউপি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এভিয়েশন এন্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কাশেম ট্রাস্ট, বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিস এসোসিয়েশন, বিসিএস কর এসোসিয়েশন, ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইইবি) ঢাকা ক্লাব, বিএসআরএম গ্রুপ, সাইফ পাওয়ারটেক লিমিটেড, উত্তরা গ্রুপ, টেক্সকোটেক, হামদর্দ ফাউন্ডেশন, গান বাংলা, শাওমি টেকনোলজি বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেড, ইস্পাহানি টি লিমিটেড, সিদ্ধেশ্বরী উচ্চবালিকা বিদ্যালয়, আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশন, ওলিয়া গ্যাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (আইডিইবি), ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স এসোসিয়েশন (ইইডি), চট্টগ্রাম চেম্বার্স অব কমার্স এবং বাংলাদেশ জুয়েলারি সমিতি। একইসঙ্গে জিল্লুল হাকিম এমপি প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে অনুদান প্রদান করেন।