কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনা ভাইরাসের আতঙ্কের প্রেক্ষাপটে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। প্রাক-প্রাথমিক থেকে শুরু করে সব ধরনের স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও সরকারী বেসরকারী সকল বিশ^বিদ্যালয় এমনকি কোচিং সেন্টারও বন্ধ থাকবে। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুজিববর্ষের কর্মসূচীও। বাতিল করা হয়েছে সারাদেশের সকল সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেয়া জাতির জনককে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা পাঠের বিশাল কর্মযজ্ঞও। এদিকে জরুরী বৈঠক ডেকে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ ও শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগেরও নির্দেশ দিয়েছে বিভিন্ন পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়। স্থগিত করা হয়েছে পিএসসির অধীন সকল পরীক্ষাও।
করোনাভাইরাসের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ায় কদিন ধরেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের দাবি জোরালো হচ্ছিল। গত দুদিনে অনেক বিশ^বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই ক্লাস পরীক্ষা বন্ধের ঘোষণা দেয়। এক পর্যায়ে বিষয়টি গড়াল আদালতেও। এমন পরিস্থিতিতে রবিবার পরামর্শের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন হয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী জানিয়ে দেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এখতিয়ার। অবশেষে সোমবার বিষয়টি গড়ায় মন্ত্রী পরিষদের বৈঠকে। সেখান থেকেই আসে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত।
পরে দুপুরে শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এক ব্রিফিংয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের বিষয়টি জানান। তিনি বলেন, প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা এবং কোচিং সেন্টারগুলোও ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। শিক্ষার্থীদের ঘরে থাকতে হবে। স্কুল-কলেজ বন্ধ মানে পড়াশোনা বন্ধ নয়, বাইরে ঘোরাঘুরি নয়। তিনি শিক্ষার্থীদের নিজ নিজ বাড়িতে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন মন্ত্রী। মন্ত্রী সভার বৈঠক থেকে এ সিদ্ধান্ত এসেছে জানিয়ে দীপু মনি বলেন, কোচিং সেন্টারের ক্ষেত্রেও এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। সতর্কতামূলক পদক্ষেপ হিসেবে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। শিক্ষার্থীরা যাতে বাড়িতে থাকে তা সবাইকে নিশ্চিত করতে হবে। আগামী ১ এপ্রিল থেকে চলতি বছরের এইচএসসি পরীক্ষা শুরুর সময়সূচী রয়েছে। তার আগেই সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে সরকার পরবর্তী সিদ্ধান্ত দেবে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী।
মন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পরপরই সংবাদ সম্মেলনে এসে প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধের ঘোষণা দেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন। প্রতিমন্ত্রী বলেন, আমরা সমন্বয় করে কাজ করছি। মঙ্গলবার সারাদেশে ৬৫ হাজারের বেশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার লেখা চিঠি প্রায় দেড় কোটি শিক্ষার্থীর পাঠ কর্মসূচী থাকলেও তা বাতিল করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর চিঠি আজ সোমবার শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দিতে সকল প্রধান শিক্ষকদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এ চিঠি আজকে সকল শিক্ষার্থীদের হাতে তুলে দেয়া হবে। তারা বাসায় বসে তা পাঠ করবে।
প্রতিমন্ত্রী বলেন, বন্ধের সময়টা শিক্ষার্থীদের বাড়িতে থাকতে হবে। এ সময় বাইরে ঘোরাফেরা করা যাবে না। বাসায় বসে লেখাপড়া করতে হবে। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। যদি পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয় তাহলে আবারও স্কুল খোলা হবে। নতুবা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। সংবাদ সম্মেলনে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মোঃ আকরাম আল হোসেনসহ বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে শিক্ষার দুই মন্ত্রণালয়ের ঘোষণার আগেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এক জরুরী সভা ডেকে ১৮ থেকে ২৮ মার্চ সব ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বিশ^বিদ্যালয় রিপোর্টার জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আখতারুজ্জামান বলেন, শিক্ষক- শিক্ষার্থীদের ‘দাবি ও পরামর্শের ভিত্তিতে’ তারা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধের এই সময়টা পরে গ্রীষ্মকালীন ছুটির সঙ্গে সমন্বয় করে নেয়া হবে। আপাতত ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কার্যক্রম চলবে। আবাসিক হলগুলোও খোলা থাকবে। সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল মতিন ভার্চুয়াল ক্লাসরুমে সকল বিভাগের চেয়ারপার্সন, হল প্রভোস্ট ও ইনস্টিটিউশনগুলোর পরিচালকদের নিয়ে এক জরুরী সভার পর এই সিদ্ধান্তের কথা জানান উপাচার্য।
তিনি বলেন, সুরক্ষা দেয়াটাও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয় ক্যালেন্ডার পুনর্বিন্যাস করা হবে। এই সময়ে যে সকল পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল, সেই তারিখগুলো পুনর্বিন্যাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রককে অনুরোধ জানাব। একইসঙ্গে পরীক্ষার নতুন তারিখ যেন শিক্ষার্থীরা দ্রুত জানতে পারে সেই আহ্বানও জানাব।
ক্লাস ও পরীক্ষা কার্যক্রম ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল কাজ চালু থাকবে জানিয়ে তিনি বলেন, মহামারী মোকাবেলার জন্য বিশ্বব্যাপী ‘সামাজিক দূরত্ব’ মডেল গ্রহণ করা হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দাবি ও আতঙ্ক কমাতে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তবে আবাসিক হল ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যান্য কাজ চলমান থাকবে। করোনাভাইরাস বিস্তার রোধে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। বুয়েটের সকল শিক্ষা কার্যক্রম আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। শিক্ষার্থীদের হল ত্যাগের নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, আবাসিক হলগুলোতে অবস্থানরত ছাত্র-ছাত্রীদের তাদের নিজ নিজ বাসা বাড়িতে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হচ্ছে এবং আগামী ১৮ মার্চ বিকেল ৫টার পর হলসমূহ বন্ধ থাকবে।
৩১ মার্চ পর্যন্ত সকল পরীক্ষা স্থগিত করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। স্থগিত পরীক্ষাসমূহের সংশোধিত তারিখ ও সময় পরবর্তীতে জানানো হবে। বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের অধীন সকল পরীক্ষা ৩১ মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে। কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মোহম্মদ সাদিক বলেছেন, তবে ইতোমধ্যে গৃহীত পরীক্ষাসমূহের ফল প্রকাশ অব্যাহত থাকবে। স্থগিত সকল পরীক্ষার তারিখ ও বিস্তারিত তথ্য পরবর্তীতে কমিশনের ওয়েবসাইটিি .িনঢ়ংপ.মড়া.নফ এবং জাতীয় পত্রিকার মাধ্যমে জানানো হবে।
আজ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ১৫ দিনের জন্য জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে (জবি) সকল বিভাগের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। জবি সংবাদদাতা জানিয়েছেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী মঙ্গলবার থেকে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগের ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ থাকবে। তবে সকল বিভাগ ও প্রশাসনিক দফতর যথারীতি খোলা থাকবে।
এদিকে রাবি সংবাদদাতা জানিয়েছেন, করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) ক্লাস-পরীক্ষাসহ আবাসিক হল বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে প্রশাসন। ১৮ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিশ^বিদ্যালয় এবং হলসমূহ বন্ধ থাকবে। প্রাধ্যক্ষ পরিষদের আহ্বায়ক অধ্যাপক আবদুল আলীম বলেন, ১৮ মার্চ বিকেল ৪টায় বন্ধ হয়ে আগামী ১ এপ্রিল হল খুলে দেয়া হবে। যদি পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না থাকে কিংবা সরকার ছুটি বাড়ায় তবে সে অনুযায়ী বিশ^বিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে তা পরবর্তীতে জানানো হবে।
জাবি সংবাদদাতা জানিয়েছেন, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে ১৮ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সোমবার দুপুরে এক জরুরী সিন্ডিকেটে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মোঃ আমির হোসেন বলেছেন, ২ এপ্রিল পর্যন্ত বিশ^বিদ্যালয়ের যাবতীয় ক্লাস-পরীক্ষা এবং ২২ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত দাফতরিক কার্যক্রম বন্ধ থাকবে। তবে এ সময় সকল জরুরী সেবা চালু থাকবে। বৃহস্পতিবার সকাল এগারোটার মধ্যে শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বিশ^বিদ্যালয় বন্ধ থাকাকালীন ক্যাম্পাসে বহিরাগত ও দর্শনার্থীদের প্রবেশসহ সব ধরনের গণজমায়েত নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
ইবি সংবাদদাতা জানান, আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত ইসলামী বিশ^বিদ্যালয়ের (ইবি) সকল একাডেমিক কার্যক্রম ও আবাসিক হলসমূহ বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে বিশ^বিদ্যালয় প্রশাসন।
১৮ মার্চ থেকে আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের সকল ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। শাবি সংবাদদাতা জানিয়েছেন, সোমবার বিশ^বিদ্যালয়ের জরুরী সিন্ডিকেট থেকে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে বলে জানান সিন্ডিকেট সদস্য অধ্যাপক ড. জহীর বিন আলম।
তবে থিসিস করা শিক্ষার্থীরা তাদের ল্যাবে কাজ করতে পারবেন। ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ রাখলেও অফিসিয়াল কার্যক্রম চলমান থাকবে। তাছাড়া আবাসিক হলগুলোতে চাইলে শিক্ষার্থীরা অবস্থান করতে পারবেন।
এক্ষেত্রে করোনা প্রতিরোধে করণীয় নিয়মগুলো শিক্ষার্থীরা নিজ দায়িত্বে মেনে চলার জন্য বিশ^বিদ্যালয় র্কর্তৃপক্ষ নির্দেশ দিয়েছে।
করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঠেকাতে ২১ দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
১৮ মার্চ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) সকল একাডেমিক কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। যশোর অফিস থেকে স্টাফ রিপোর্টার জানিয়েছেন, ১৮ মার্চ দুপুর ১২টার মধ্যে বিশ^বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আবাসিক হল ত্যাগেরও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সোমবার প্রশাসনিক ভবনের সম্মেলন কক্ষে করোনাভাইরাস নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনা শেষে যবিপ্রবি উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন তার ওপর অর্পিত ক্ষমতাবলে বিশ^বিদ্যালয় বন্ধের এ ঘোষণা দেন।