ইতালি থেকে দেশে ফিরেছেন ২০১ জন ॥ আশকোনা হজ্ব ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে

9

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ইতালি থেকে তিন দফায় দেশে ফিরেছেন ২০১ জন। শনিবার সকাল ৮টায় ইতালির রোম থেকে দুবাই হয়ে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের (ইকে ৫৮২) ফ্লাইটে ১৪২ বাংলাদেশী ঢাকায় আসেন। বিকেলে এমিরেটসের অপর দু’টি ফ্লাইটে আসেন আরও ৫৯ জন। আজ ইতালি থেকে আরও অর্ধশতাধিক বাংলাদেশীর দেশে ফেরার কথা রয়েছে। তাদের সবাইকে বাধ্যতামূলক হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। প্রাথমিকভাবে তাদের সবাইকে বিমানবন্দর থেকে নিয়ে যাওয়া হয় আশকোনা হজ্ব ক্যাম্পে। রাতে এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তারা সবাই ওই ক্যাম্পেই অবস্থান করছিলেন। তবে হজ্ব ক্যাম্পের অস্থায়ী কোয়ারেন্টাইন পরিবেশ মানসম্মত না হওয়ায় তারা থাকতে চাচ্ছেন না। ইতালি ফেরতদের ক’জনকে হজ্ব ক্যাম্পের গেটের বাইরে বিক্ষোভ করতে দেখা যায়। তাদের অভিযোগ চিকিৎসা শাস্ত্রের সংজ্ঞা অনুযায়ী কোয়ারেন্টাইন বলতে যা বোঝায়Ñ সেটা মানা হচ্ছে না হজ্ব ক্যাম্পে। একটা বড় হলরুমে মেঝেতে পাশাপাশি মেট বিছিয়ে গাদাগাদি করে রাখা হয়। এর চেয়ে বাড়িতে গিয়েও আরও নিরিবিলি ও শান্তিতে থাকা ভাল। এখানে থাকলে অন্য একজন অসুস্থ থাকলে সবাই সংক্রমিত হয়ে যাবেন।
সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ছয়টি দেশ থেকে আসা যাত্রীদের হজ্ব ক্যাম্পের অস্থায়ী কোয়ারেন্টাইনে থাকাটা বাধ্যতামূলক। কেউ ইচ্ছে করলেই ঘরে ফিরতে পারবেন না। এ ছয়টি দেশ হচ্ছে চীন, ইতালি, ইরান, ফিলিপিন্স, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া। শনিবার সকাল ৮টায় প্রথম দফায় ইতালির রোম থেকে দুবাই হয়ে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের (ইকে ৫৮২) ফ্লাইটে ১৪২ বাংলাদেশী ঢাকায় আসেন। বিকেলে দ্বিতীয় দফা আরও আসেন ৩৪ জন। তাদের বিমানবন্দরে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর কিছু বুঝে ওঠার আগে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় হজ্বক্যাম্পে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান তাদের গাড়িতে তোলার সময়েই হৈচৈ করতে শোনা গেছে। ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদের বেলা ১২টায় বিমানবন্দর থেকে উত্তরার আশকোনা হজক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়। এখানে আনার পর তাদের পরীক্ষা করা হয়। এরপর তাদের ক্যাম্পের বাইরে রেখে ভেতরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজ শুরু হয়। কিছুক্ষণ পর যখন তাদের বাধ্যতামূলকভাবে ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা আসে তা শুনে ক্ষুব্ধ হন তারা। হজক্যাম্পের প্রধান গেটে এসে বিক্ষোভ ও গেট ধাক্কাধাক্কি করে বের হওয়ার চেষ্টা করেন এবং প্রশাসনের অবহেলার বিরুদ্ধে শ্লোগান দেন। মাসুদ নামের একজন বলেন, আমরা ইতালিতে একবার টেস্ট করে এসেছি শাহজালাল বিমানবন্দরে আমাদের মধ্যে কোন উপসর্গ ছিল না। এরপরও কেন আমাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হলো এটা বুঝতে পারছি না। এছাড়া ক্যাম্পের ভেতরের পরিস্থিতি থাকার মতো নয়। এসময় ১০ মিনিট বিক্ষোভের পর পুলিশ তাদের ভেতরের সরিয়ে নেয়। এ খবর শুনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী নির্দেশ দেন যে কোন মূল্যে তাদের অবশ্যই কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে। সেটা ক্যাম্পেই হোক কিংবা ঘরে হোক।
এদিকে সরজমিনে দেখা যায়- ইতালি ফেরত ১৭৬ জনকে নিয়ে বিপাকে পড়তে হয়েছে স্বাস্থ্যকর্মী ও নিরাপত্তাকর্মীকে। শনিবার সকালে হজক্যাম্পের গেটের বাইরে তাদের চেঁচামেচি দেখে আশপাশের শত শত পথচারী ভিড় জমান। পুলিশের সঙ্গে ঠেলা ধাক্কাধাক্কি দেখে পথচারীরা বেশ কৌতূহলী হয়ে ওঠেন। তবে পুলিশ যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দেয়ায় সবাই ইতালি প্রবাসী এক যুবককেই উল্টো তিরষ্কার করতে দেখা গেছে। এ সময় তারা সবাই একযোগে চিৎকার বলে উঠেন আমরা কেউ থাকব না এখানে। হজক্যাম্পের কোয়ারেন্টাইনে রাখার মতো সক্ষমতা ও পরিবেশ নেই বলে অভিযোগ ইতালি ফেরতদের। একই অভিযোগ ছিল উহান ফেরত ৩১২ বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদেরও।
এ বিষয়ে হজক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন জামিল আহমেদ নামের অপর এক অভিভাবক। তিনি বলেন, চীনে করোনা ছড়িয়েছে প্রায় চার মাস আগে। ভয়ঙ্কর এ ভাইরাস মোকাবেলায় দুনিয়াজুড়ে আগাম সতর্কতামূলক নানামুখী কার্যকর পদক্ষেপ নিলেও এখানে নেই তেমন কিছু। সরকারের কার্যক্রম সব সভা সেমিনার বক্তৃতা বিবৃতিতে। নইলে গত তিন মাসে এই হজক্যাম্পে নিরাপদ দূরত্বে একশ’ বেডেরও ব্যবস্থা করতে পারেনি। অথচ এ বাজেটও বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। তারপরও কিছু করতে না পারাটা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চরম ব্যর্থতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
জানা যায়, ইতালি থেকে আসা সবার জ্বরমাপাসহ শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও নাম, ঠিকানাসহ বিস্তারিত তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। তারা রোম থেকে রওনা হওয়ার আগে সেখানে থার্মাল স্ক্যানারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। সেখানে তাদের কারও শরীরে জ্বর ছিল না। সকালে শাহজালাল বিমানবন্দরে অবতরণের পর আরেক দফা থার্মাল স্ক্যানারে জ্বর মাপা হলেও কারও শরীরে জ্বর ধরা পড়েনি। অধিক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের অংশ হিসেবে এখন আশকোনা হজক্যাম্পে ফিরে আসা যাত্রীদের প্রত্যেকের শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বাস্থ্য অধিদফতরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, কারও শরীরে জ্বর বা অন্যান্য অসুস্থতা না থাকায় তাদের সবাইকে পুলিশি পাহারায় নিজ নিজ বাড়িতে পাঠানো হবে। তাদের বাড়িতে ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে। ফিরে আসা যাত্রীদের মধ্যে যারা এ নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না তাদের অন্য কোথাও ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে। বাড়িতে বা অন্য যেখানেই কোয়ারেন্টাইনে থাকুক না কেন তাদের ওপর স্থানীয় প্রশাসনের কঠোর নজরদারি থাকবে। এদিকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা জানান, ইতালি থেকে ফেরা সবাইকে আশকোনা হজক্যাম্পে বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে রাখার নির্দেশ দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এমপি। সেইসঙ্গে পরবর্তী সময়ে আক্রান্ত দেশগুলো থেকে কোন যাত্রী দেশে এলে তাকেও বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন করা হবে বলে জানান তিনি। নির্দেশ অমান্যকারীর জন্য জেল-জরিমানা করা হবে।
এদিকে তাদের পরিবার-স্বজনদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ না দেয়ায় দুপুর থেকে হজ ক্যাম্পের গেটের বাইরে শতাধিক স্বজনকে অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। স্বজনরা নিজ নিজ যাত্রীদের জন্য বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসছেন। যাত্রীরা গেটের সামনে এসে খাবার নিয়ে যাচ্ছেন। প্রবাসীরা ক্ষোভ প্রকাশ করলেও প্রিয়জন দেশে ফিরেছে তাই স্বস্তি প্রকাশ করেছে তাদের স্বজনরা। মাদারীপুর থেকে পরিবারের পাঁচজনকে নিতে আসা আব্দুল করিম তালুকদার বলেন, আমার শ্যালিকা-ভায়রাসহ পাঁচজন ইতালি থেকে এসেছে। তারা ১৩ বছর ধরে ইতালি ছিল। সেখানে তারা একটি সুপারশপে কাজ করত। করোনার প্রকোপে সব বন্ধ হয়ে গেছে। এক মাস ধরে তাদের কোন কাজ নেই। তাই দুর্বিষহ জীবন ছেড়ে দেশে ফিরেছে। তাদের সঙ্গে দেড় বছর ও পাঁচ বছর বয়সের দুটি মেয়ে রয়েছে। তাদের দেখতে পেরে আমরা খুবই খুশি। শুনলাম তাদের ১৪ দিন বাধ্যতামূলকভাবে এখানে থাকতে হবে। যাক স্বস্তি এটাই যে তারা দেশে ফিরেছে।
দুপুরে সরজমিনে দেখা যায়- সকাল থেকে যাত্রীদের হজক্যাম্পে নেয়া হলেও তাদের এখানে রাখা হবে নাকি হোম কোয়ারেন্টাইনে নিয়ে যাওয়া হবে এনিয়ে চূড়ান্ত কোন নির্দেশনা ছিল না। তবে দুপুরে তাদের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে থাকার নির্দেশনা দেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। মন্ত্রীর নির্দেশনার পর হজক্যাম্পের অস্থায়ী কোয়ারেন্টাইনের বাইরের গেটে এসে বিক্ষোভ শুরু করেন প্রবাসীরা। হজক্যাম্পের প্রধান গেটে বিক্ষোভ ও গেটে ধাক্কাধাক্কি করেন। হজক্যাম্পে থাকার পরিবেশ নেই উল্লেখ করে প্রশাসনের অবহেলার বিরুদ্ধে স্লোগান দেন।