আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো…

9

কাজিরবাজার ডেস্ক :
কবি আল মাহমুদ ‘নিদ্রিতা মায়ের নাম’ কবিতায় ‘তাড়িত দুঃখের মতো চতুর্দিকে স্মৃতির মিছিল/ রক্তাক্ত বন্ধুদের মুখ, উত্তেজিত হাতের টঙ্কারে/তীরের ফলার মতো/ নিক্ষিপ্ত ভাষার চিৎকার : বাঙলা, বাঙলা-’ মাতৃভাষাকে এভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন।
মাতৃভাষায় রচিত কবিতায় গানে- গল্পে এখনও পাকিস্তানশাসকগোষ্ঠীর প্রতি ঘৃণা ও প্রতিবাদ আগুন জ্বলছে। ইতিহাসের এমন বর্বর ঘটনার বাঙালি জাতি কোন দিন ভুলবে না।
বদরুদ্দীন উমরের লেখা ‘পূর্ব বাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি-১’ খন্ডে উল্লেখ করেন, ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দীন আহমদ হিন্দীকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশের অনুকরণে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে অভিমত ব্যক্ত করেন ডক্টর শহীদুল্লাহ। এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোন প্রতিবাদ কেউ করেনি। মুসলিম লীগ মহলেও এ নিয়ে কোন বিতর্কের সূচনা হয়নি। কিন্তু জিয়াউদ্দীন আহমদের এই সুপারিশের অসারতা সম্পর্কে পূর্ব-পাকিস্তানের জনসাধারণ ও শিক্ষিত সমাজকে অবহিত করার উদ্দেশে ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সমস্যা’ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন। এই প্রবন্ধে তিনি বলেন, ‘কংগ্রেসের নির্দিষ্ট হিন্দীর অনুকরণে উর্দু পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষারূপে গণ্য হইলে তাহা শুধু পশ্চাদগমনই হইবে। ইংরেজী ভাষার বিরুদ্ধে একমাত্র যুক্তি এই যে, ইহা পাকিস্তান ডোমিনিয়নের কোন প্রদেশের অধিবাসীরই মাতৃভাষা নয়। উর্দুর বিপক্ষেও একই যুক্তি প্রযোজ্য। পাকিস্তান ডোমিনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চলের অধিবাসীদের মাতৃভাষা বিভিন্ন যেমন পষতু, বেলুচী, পাঞ্জাবী, সিন্ধী এবং বাংলা, কিন্তু উর্দু পাকিস্তানের কোন অঞ্চলেই মাতৃভাষারূপে চালু নয়।’
ভাষাসৈনিক আবদুল মতিন তার এক গ্রন্থে বলেন, বায়ান্ন সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাৎক্ষণিকভাবে ভাষা আন্দোলন সংঘটিত হয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক ছিলাম আমি। সে জন্য আন্দোলনের বিষয়ে অনেক দায়িত্ব পালন করতে হয় আমাকে। বায়ান্ন সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের একটি সভা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সারাদেশের ছাত্ররা তাতে অংশ নেন। সভায় আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক শামসুল হকও উপস্থিত ছিলেন। সভায় সব ছাত্র বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলনের পক্ষে মত দেন। শামসুল হক একা এতে দ্বিমত জানান। তিনি বলেছিলেন, ‘সামনে নির্বাচন। এখন আন্দোলন করলে নির্বাচন নাও হতে পারে।’ সভায় উপস্থিত কোন ছাত্রই তার কথা শোনেননি।
১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে এসে বৈষম্যমূলক ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোন ভাষা নয়।’ জিন্নাহর প্রতি আমার আস্থা ধূলিসাত হয়ে যায়। ওই অনুষ্ঠানে জিন্নাহ সাহেবের বক্তব্যের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। তাকে বলেছিলাম, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দু মেনে নেবে না। অনুষ্ঠানে যারা ছিলেন, তাদের কাছে মতামত চাওয়া হয়Ñ আমার এ বক্তব্যের প্রেক্ষিতে। সবাই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার পক্ষে মত দেন। কিন্তু জিন্নাহ সাহেব আমাদের কথা শুনলেন না। এর পর আমরা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন-সংগ্রাম করতে থাকলাম। ১৯৫০ সালের ১১ মার্চের এক সভায় আমরা ঠিক করি মাতৃভাষা রক্ষার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার। আর এ কাজটা ছাত্ররাই করতে পারেন। তারা রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমাদের কার্যক্রম শুরু করি। ধীরে ধীরে আমাদের আন্দোলন দৃঢ় হয়। ১৯৫২ সালে ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় আবার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। এর পর ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সাধারণ ছাত্রদের নিয়ে একটি সভা হয়। ছাত্র ও সাধারণ জনতা সম্মিলিতভাবে ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেন। গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ওইদিন বেলা ১১টায় সভা শেষে আমাদের মিছিল রাস্তায় নামে। কাঁদানে গ্যাস, লাঠিচার্জ, অগণিত গ্রেফতার উপেক্ষা করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের গেটে পৌঁছতেই গুলি হয়। এখানে আমি বলতে চাচ্ছি, একুশ ছিল নিছকই ছাত্রদের আন্দোলন।