কাজিরবাজার ডেস্ক :
দেশে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক মানের ১০ লেনের সর্বাধুনিক এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। চার লেনের জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ পর্যন্ত ৮৭ দশমিক ১৮ কিলোমিটার সড়কটি এক্সপ্রেসওয়েতে উন্নীত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগের পক্ষ থেকে। সরকারী-বেসরকারী অংশীদারিত্বের (পিপিপি) মাধ্যমে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে চায় মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে প্রকল্পে অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে সড়ক নির্মাণে দক্ষ দেশ হিসেবে পরিচিত দক্ষিণ কোরিয়া। প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে সর্বোচ্চ দেড় ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ পৌঁছানো সম্ভব হবে।
সড়ক ও জনপথ সূত্রে জানা গেছে, ইতোমধ্যে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়েছে। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষও সম্প্রতি ময়মনসিংহ সফর করেছেন। সবকিছু ঠিক থাকলে সমীক্ষা, পরিকল্পনা, ডিজাইন গ্রহণের মাধ্যমে একনেকে পাসের পর মূল কার্যক্রম শুরু হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ ও দক্ষিণ কোরিয়া সরকারের মধ্যে জিটুজি ভিত্তিতে পিপিপির মাধ্যমে এ প্রকল্পে অর্থায়ন করা হবে জানিয়ে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আমরা প্রকল্পের বিষয়ে দক্ষিণ কোরিয়াকে জানিয়েছি। তারা অর্থায়নের বিষয়ে ইতোমধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তাছাড়া ভারত, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কাসহ বিভিন্ন দেশে এরকম এক্সপ্রেসওয়ে রয়েছে। দ্রুত ও উন্নত সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়েই এরকম প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিভিন্ন দেশ। বর্তমানে বিশে^ সর্বাধুনিক সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা হলো এক্সপ্রেসওয়ে। জানা গেছে, ইতোমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ প্রকল্পে অর্থায়নের আশ্বাস দিয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের লোকজনের বাংলাদেশে এসে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনের কথা রয়েছে। এ ছাড়াও ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কও এক্সপ্রেসওয়ে ১০ লেনে উন্নীত করে নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের।
এক্সপ্রেসওয়ে বিশেষজ্ঞ সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শিশির কান্তি রাউত বলেন, বিদ্যমান চার লেন বিশিষ্ট জয়দেবপুর-ময়মনসিংহের ৮৭ দশমিক ১৮ কিলোমিটার সড়কটি এখন এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে ১০ লেনে উন্নীত করার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। বিদ্যমান চার লেনের পাশাপাশি ১০ ফুট প্রশস্ত দু’পাশে ব্যারিয়ার দিয়ে ইমার্জেন্সি লেন নির্মাণ করা হবে। যা দিয়ে শুধু এ্যাম্বুলেন্স, নিরাপত্তা গাড়ি, ভিআইপিসহ যে কোন জরুরী প্রয়োজনীয় গাড়ি চলাচল করবে। এর পর আরও ১৮ থেকে ২৪ ফুট করে স্বল্প গতির যান চলাচলের জন্য আলাদা দুটি লেন করা হবে। একপাশে পাঁচটি সড়ক লেনসহ দুপাশে দশ লেনের সড়ক নির্মাণের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। প্রতি ২-৩ কিলোমিটার পর আন্ডারপাস ইউটার্ন নির্মিত হবে। দুপাশের অন্য সড়ক থেকে এক্সপ্রেসওয়ে সড়কে উঠতে ও বের হতে ইন্টারচেঞ্জ- যা আন্ডারপাস ও ওভারপাস সিস্টেমে কোন গাড়ি মুখোমুখি হবে না।
শিশির কুমার রাউত আরও জানান, সড়কে অত্যাধুনিক ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্ট সিস্টেম (আইটিএস) এ্যাপ্লিকেশন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে। সড়কের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা সর্বক্ষণিক মনিটরিং সিস্টেমে আসবে। কোন দুর্ঘটনা, মাত্রাতিরিক্ত গতি বা কোন ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করলে সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা। রাস্তায় কোন সমস্যা হলে দূর থেকেই সঙ্কেত পাওয়া যাবে। এই প্রযুক্তির ফলে কোন গাড়ি দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে গেলে খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। রাস্তা নষ্ট থাকলে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা যাবে। সেইসঙ্গে যানজট নিরসন, অবৈধ পার্কিং রোধে এই প্রযুক্তি সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। মূল কথা হলো, সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের জন্য খুব চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে এসেছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। তাছাড়া সড়কে কি ধরনের ত্রুটির কারণে দুর্ঘটনা হয় তাও সরাসরি চিহ্নিত করা সম্ভব হবে।
সড়ক বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, সরকারের নীতিগত অনুমোদন পেলে প্রকল্প নির্মাণে পরামর্শক নিয়োগ করা হবে। তারপর নির্মাণ ব্যয় নির্ধারণসহ আনুষ্ঠানিক অন্যান্য কাজ সম্পন্ন হবে। বর্তমানে প্রকল্পটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে।
জানা গেছে, প্রযুক্তি নির্ভর এক্সপ্রেসওয়ের দু’পাশে সর্বাধুনিক দুটি রেস্টহাউস, শপিং, রেস্তরাঁ, খাবারের দোকান, গাড়ির তেল ভর্তিসহ নানা সুবিধার ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়া পরিবহন চালক, শ্রমিকসহ যাত্রীদের বিশ্রামের ব্যবস্থা থাকবে। বিদ্যমান মহাসড়কের উভয় পাশে সওজের পর্যাপ্ত ভূমি থাকায় এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে নতুন করে ভূমি অধিগ্রহণের পরিমাণ খুবই কম হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। শিশির কান্তি বলেন, জমি অধিগ্রহণ করতে হবে। তবে খুব বেশি নয়। মহাসড়কের দু’পাশে সড়ক বিভাগের পর্যাপ্ত জমি থাকায় নির্মাণ ব্যয় অনেক কমে আসবে। ২০১৭ সালে জিটুজি পিপিপি নীতিমালার আওতায় দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে পিপিপি ভিত্তিতে এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়। শীঘ্রই প্রস্তাবটি সরকারী ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির নীতিগত অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। নীতিগত অনুমোদন পাওয়া গেলে বিস্তারিত সমীক্ষার আলোকে পরবর্তী কার্যক্রম নেয়া হবে।
ঢাকা-ময়মনসিংহ জাতীয় মহাসড়ক (এন-৩) দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি সড়ক করিডর। ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনাসহ গাজীপুর ও কিশোরগঞ্জ জেলার সঙ্গে সংযোগ প্রদানকারী এই মহাসড়কে যানবাহনের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। এই সড়ক করিডর সংলগ্ন এলাকাগুলোয় ব্যাপক শিল্প স্থাপনা গড়ে ওঠায় ভারি যানবাহনের চলাচলও সম্প্রতি উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। এ ছাড়া সরকারের গৃহীত পরিকল্পনা অনুসারে গাজীপুর, ময়মনসিংহ, শেরপুর ও জামালপুর জেলায় মোট ১০টি অর্থনৈতিক জোন হবে।
এসব অর্থনৈতিক জোনের কারণেও এ সড়কে যানবাহন চলাচল উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে যাবে। শেরপুর, জামালপুর ও ময়মনসিংহ জেলায় অবস্থিত মোট চারটি স্থলবন্দরের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের স্থলপথে বাণিজ্যের কারণেও এই সড়ক করিডরে যানবাহনের চাপ ইতোমধ্যে বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান যানবাহন নিরাপদ ও দ্রুত চলাচল নিশ্চিত করতে সরকার গাজীপুর থেকে ময়মনসিংহ মহাসড়ক সম্পূর্ণ প্রবেশ-নিয়ন্ত্রিত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
ময়মনসিংহ সড়ক সার্কেলের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোঃ আতাউর রহমান বলেন, জয়দেবপুর-ময়মনসিংহ সড়কটিতে এখন এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কথা ভাবছে সরকার। এটি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া প্রাথমিক পর্যায়ে। এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের লক্ষ্যে সম্প্রতি সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী শিশির কুমার রাউত ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী বিকাশ চন্দ্র দাস সরেজমিন ময়মনসিংহ সফর করে গেছেন। শীঘ্রই কোরিয়ার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ সফর করবেন। সরকারের নীতিগত অনুমোদনের পর বাকি প্রক্রিয়া এগোবে। এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের ব্যাপারে সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা প্রদান করা হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়েছে। তারা প্রকল্প অগ্রগতির বিষয়ে সম্মতি দিয়েছে। প্রকল্পটি ইতোমধ্যে সরকারী ক্রয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটিতে অনুমোদনের জন্য সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদনের পর কাজটি আরেক ধাপ এগিয়ে যাবে বলে আশা সড়ক ও জনপথের কর্মকর্তারা।
তারা বলছেন, এই প্রকল্প নির্মাণে দক্ষিণ কোরিয়ার আগ্রহী প্রতিষ্ঠান নিজেদের উদ্যোগে আরও কিছু ইনভেস্টর দেখছে। যার মধ্য দিয়ে কাজটি আরও দ্রুত এগিয়ে যাবে। তাছাড়া প্রকল্প নির্মাণ কাজ শেষ হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ যাওয়া সম্ভব হবে। শিল্প প্রতিষ্ঠান বাড়বে। বাড়বে কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি। নিশ্চিত হবে সড়ক নিরাপত্তা। পাশাপাশি সড়ক দুর্ঘটনা কমে আসবে। তবে এক্সপ্রেসওয়েটি ব্যবহার করলে টোল দিতে হবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এক্সপ্রেসওয়ের ইন্টারসেকশনগুলো পৃথক ইন্টারচেঞ্জ করা হবে। স্থানীয় যানবাহন চলাচলের জন্য দুপাশে থাকছে সার্ভিস রোড। একপাশের যানবাহন অন্যপাশে চলাচলের জন্য নির্মাণ করা হবে আন্ডারপাস। থাকবে ওভারপাসের ব্যবস্থাও। সুবিধাজনক স্থানে এসব আন্ডারপাস ও ওভারপাস নির্মাণের চিন্তা করা হচ্ছে। বিশে^র বিভিন্ন দেশের মতো দক্ষিণ কোরিয়া সড়ক নির্মাণে দক্ষ। তাই প্রকল্প নির্মাণ ও অর্থায়নে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতি দুর্বলতা আছে সড়ক বিভাগের। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, মানগত বিচারে সড়ক নির্মাণে কোরিয়া এখন অন্যান্য দেশের থেকে বেশ এগিয়ে।
সওজ সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়া সড়ক বিভাগের বিভিন্ন প্রকল্পের তালিকা চায়। তখন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিশ^মানের সড়ক নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার লক্ষ্যে কয়েকটি প্রকল্পের তালিকা তাদের কাছে দেয়া হয়। প্রকল্প বিশ্লেষণ করে তারা অর্থায়নে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।