কাজিরবাজার ডেস্ক :
কোনভাবেই দলের সঙ্কট কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারছে না বিএনপি। সব চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর এখন নতুন পথের সন্ধানে দলটি। তবে কোন পথে যাবে দিশা ঠিক করতে পারছে না দলীয় হাইকমান্ড। এ কারণে দলের সর্বস্তরে হতাশা বিরাজ করছে।
বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার পর থেকে দুই বছর শত চেষ্টা করেও দলের নেতারা না পেরেছে দল গুছিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে, না পেরেছেন রাজপথে আন্দোলন চাঙ্গা করতে। সর্বশেষ ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তারা আন্দোলনকে টার্গেট করে এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। নির্বাচনে জিতলে এক রকম কৌশল আর হেরে গেলে আরেক রকম কৌশলে রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমেই দলকে এগিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বিএনপি হাইকমান্ড। কিন্তু সিটি নির্বাচনে হেরে গিয়ে হরতালসহ দুইটি কর্মসূচী ঘোষণা করে তা সফল করতে না পেরে তারা প্রমাণ করেছে দলটি এখন সকল ক্ষেত্রেই ব্যর্থ।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির আন্দোলনের টার্গেট থাকায় ভোটের আগেই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে সরকার, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ আনে। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না করে কথায় কথায় অভিযোগ করায় নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও বিব্রত হন। এ ছাড়া দেশের সাধারণ মানুষের কাছে বিএনপির দুর্বলতাও প্রকাশ পায়।
অভিজ্ঞ মহলের মতে, ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে রাজনৈতিকভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর ইস্যু করতে পারত বিএনপি। সে ক্ষেত্রে তারা যদি ভোটের দিন কেন্দ্র ও আশপাশের এলাকায় জোরালো অবস্থান নিতে পারত তাহলে তাদের দলের আরও কিছু ভোটার হয়তো ভোট দিতে যেত। সে ক্ষেত্রে নির্বাচনে হেরে গেলেও আওয়ামী লীগের কাছাকাছি ভোট পেলে দলের ইমেজ বৃদ্ধি পেত। দলের নেতাকর্মীরা এভাবে হতাশ হতো না। তাই নির্বাচন পরবর্তী আন্দোলন কর্মসূচীও হয়তো কিছুটা হলেও সফল হতো। কিন্তু বিএনপি নিজেদের ব্যর্থতার কারণে নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পাশাপাশি আন্দোলনেও ব্যর্থ হয়। আর এ কারণে ঘুরে দাঁড়ানোর পথও আপাতত বন্ধ হয়ে যায়।
মূলত, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় পড়ে বিএনপি। বিএনপি এ নির্বাচন বর্জন করায় আওয়ামী লীগ অতি সহজে নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠন করে এবং রাজনৈতিকভাবে অবস্থান আরও শক্তিশালী করে। এর এক বছর পর ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে শুরু করে সারাদেশে টানা ৯২দিন সহিংস অবরোধ কর্মসূচী পালন করে দেশ-বিদেশে চরম সমালোচনার মুখে পড়ে দলটি। ওই আন্দোলনের সময় পেট্রোলবোমাসহ বিভিন্নভাবে জ্বালাও- পোড়াও হওয়ার কারণে শতাধিক মানুষ নিহত, কয়েক হাজার যানবাহন পুড়িয়ে দেয়াসহ ব্যাপক সহিংসতা হওয়ায় বিএনপির রাজনীতি সম্পর্কে নেতিবাচক মনোভাব সৃষ্টি হয় সর্বমহলে। এ কারণে ওই কর্মসূচীর পর রাজপথে আর কোন কর্মসূচী সফল করতে পারেনি বিএনপি। এবার ঢাকার দুই সিটি নির্বাচনের আগে সে পরিস্থিতির মোড় ঘুরানোর জোর প্রস্তুতি নেয় বিএনপি। কিন্তু নির্বাচনে হেরে যাওয়া ও নির্বাচন পরবর্তী আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ায় দলটি নতুন করে হতাশায় পড়ে। আর শীঘ্র এ হতাশা থেকে মুক্তি পাওয়ার কোন পথও আপাতত তৈরি করতে পারছে না তারা।
২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরও বিএনপি রাজপথে সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরু করার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু সর্বস্তরের দলের নেতাকর্মীরা আন্দোলনের পক্ষে সায় না দেয়ায় তখন তারা ব্যর্থ হয়। এক পর্যায়ে তারা দল থেকে নির্বাচিতরা সংসদে যোগ না দেয়ার পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আর কোন নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ঘোষণা দেয়। কিন্তু কিছুদিন পর আবার সে সিদ্ধান্ত থেকে ইউটার্ন নিয়ে দলীয় এমপিরা সংসদে যাওয়ার পাশাপাশি সকল নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এ বিষয়ে তাদের আগের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল বলে জনসম্মুখে প্রকাশ করে। তবে ঢাকার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পর যেন রাজপথে আন্দোলন চাঙ্গা করা যায় সে জন্য আগে থেকেই দলের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করারও চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ভোটের দিন সিনিয়র নেতারা মাঠে সক্রিয় না থাকায় দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা হতাশ হয়। এ কারণে বিএনপির সাধারণ নেতাকর্মীদের মধ্যে অনেকেই ভোট দিতে যায়নি।
এদিকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত এ নির্বাচনকে আন্দোলনের ইস্যু করতে পারেনি বিএনপি। দলীয় কর্মকা-ে সিনিয়র নেতাদের দায়সারা অবস্থান ও তৃণমূল নেতাকর্মীদের অনীহার কারণে বিএনপি রাজপথে কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার পরিবর্তে এ অবস্থান থেকে সরে আসে। তবে এ নিয়ে লন্ডনপ্রবাসী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান প্রচ- ক্ষুব্ধ থাকলেও বাস্তবতার কারণে কাউকে কিছুই বলছেন না।
জানা যায়, লন্ডন থেকে পাওয়া হাইকমান্ডের নির্দেশ পেয়ে ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের দিন ১ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টায় ফল ঘোষণার আগেই পরদিন ২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল পালনের ঘোষণা দেয় বিএনপি। কিন্তু সাধারণ মানুষ এবং দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা এ হরতালকে ভালভাবে গ্রহণ করতে না পারায় কর্মসূচীটি ব্যর্থ হয়। হরতাল ডেকে দলের কোন সিনিয়র নেতারা মাঠে নামেননি। আর সিনিয়র নেতারা মাঠে না নামায় সাধারণ নেতাকর্মীরাও মাঠে নামেননি। এর ফলে নয়াপল্টন বিএনপি কার্যালয়ের নিচে দলের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর নেতৃত্বে কিছু নেতাকর্মী দিনভর বসে বসে বিক্ষোভ প্রদর্শন করলেও আর কোথাও হরতাল পালনের কোন আলামত কেউ দেখতে পায়নি।