কাজিরবাজার ডেস্ক :
বুকের ভেতরে, টের পাচ্ছেন নিশ্চয়ই, অদ্ভুত একটা শিহরণ! একটা দারুণ তৃষ্ণা। মন কেমন যেন আকুলিবিকুলি করছে। চিত্তচঞ্চল। হঠাৎ ভেঙেচুরে যাচ্ছে সব। পুরনো হাহাকার নতুন করে ভেতরে বাজছে। বাজছে কি? হঠাৎ এতসব পরিবর্তনের একটিই কারণ ফাগুন হাওয়া বইছে।
আজি দখিন-দুয়ার খোলা-/এসো হে, এসো হে, এসো হে আমার বসন্ত এসো…। এসেছে বসন্ত। আজ ১ ফাল্গুন, ১৪২৬ বঙ্গাব্দ। শুক্রবার। বিপুল ঐশ্বর্যের অধিকারী ঋতুরাজ বসন্তের প্রথম দিন। প্রতিবারের মতো এবারও প্রিয় ঋতুকে বর্ণিল উৎসব অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বরণ করে নেবে বাঙালী। দেশজুড়ে হবে বাঙালীর অন্যতম বৃহৎ অসাম্প্রদায়িক উৎসব।
বাংলা বর্ষপঞ্জির হিসেবে ঋতু পরিবর্তন আসায় এবার একদিন পর সূচনা হলো ফাগুনের। এখন থেকে এভাবেই চলবে। গত বছর পর্যন্ত ১ ফাল্গুন এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি ছিল অভিন্ন দিন। এবার থেকে খ্রিস্ট্রীয় বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি অভিষেক ঘটবে ফাগুনের। সে হিসাবেই আজ উদ্যাপিত হবে বসন্ত উৎসব।
কবিগুরুর ভাষায় : বসন্ত, দাও আনি,/ফুল জাগাবার বাণীÑ/ তোমার আশায় পাতায় পাতায় চলিতেছে কানাকানি…। শেষ হলো কানাকানি। প্রেমের কবি নজরুল তাই ঘোষণা করছেন, এলো খুনমাখা তূণ নিয়ে/ খুনেরা ফাগুন…। ভাটিবাংলার প্রেমিক পুরুষ বাউল শাহ আব্দুল করিমও গাইলেন : বসন্ত বাতাসে সই গো/ বসন্ত বাতাসে/বন্ধুর বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে…।
প্রতিবারের মতোই এবারও রাঙিয়ে দিতে এসেছে ফাগুন। শূন্য হৃদয় ভরিয়ে দিতে এসেছে। মনের গহীন কোণে অতি সূক্ষ্ম যে পুলক, সে তো কেবল বসন্তই জাগাতে পারে! এই বসন্ত কুসুম কোমল প্রেমের। কাছে আসার। প্রিয়জনের স্পর্শ নিয়ে বাঁচার সুখ বসন্ত।
ষড়ঋতুর বাংলাদেশে প্রতি দুই মাস অন্তর রূপ পরিবর্তন করে। শুরু হয় গ্রীষ্ম দিয়ে। শেষ বসন্ত দিয়ে। ভীষণ প্রিয় ঋতু এই বসন্ত। এখন বনে যেমন, মনেও এর আশ্চর্য দোলা। এরই মাঝে রূপ লাবণ্যে জেগে উঠেছে প্রকৃতি। বৃক্ষের নবীন পাতায় আলোর নাচন। ফুলে ফুলে বাগান ভরে উঠেছে। চোখ খুললেই গোলাপ-জবা-পারুল-পলাশ। পারিজাতের হাসি। মৌমাছিদের গুঞ্জন। কোকিলের কুহুতান। সব, সবই বসন্তকে আবাহন করার। জানিয়ে দেয়, ‘আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।’
ফাগুনের এই ক্ষণে বিবর্ণ প্রকৃতি জেগে উঠেছে নতুন করে। বাগানে বাগানে ফুটেছে কুসুম। শিমুল, কাঞ্চন, মাধবী, কৃষ্ণচূড়ায় বন সেজেছে। উচ্ছ্বসিত কবিগুরু হয়তো তাই দেখে বলেছিলেন, ওরে ভাই, ফাগুন এসেছে বনে বনেÑ/ডালে ডালে ফুলে ফলে পাতায় পাতায় রে,/আড়ালে আড়ালে কোণে কোণে…। শুধু পাতা আর ফুলেরা কেন, আপন মনে গাইছে পাখি। কত কত গান! কবিগুরুর বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে বললে, আহা, আজি এ বসন্তে এত ফুল ফুটে,/এত বাঁশি বাজে, এত পাখি গায়…। অথবাÑ বসন্ত এসেছে বনে, ফুল ওঠে ফুটি,/ দিনরাত্রি গাহে পিক, নাহি তার ছুটি…।
বনের মতোই অনাদিকাল ধরে বাঙালীর মন রাঙিয়ে দিতে আসে বসন্ত। সেই বর্ণনা দিতে গিয়ে উচ্ছ্বসিত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় অন্য সব অনুষঙ্গ ভুলে গিয়েছিলেন। কবিতায় তিনি লিখেছিলেন, ফুল ফুটুক না ফুটুক/আজ বসন্ত…। বসন্তে ভীষণ আকুলিবিকুলি করে ওঠে মন। বুকে নতুন করে জাগে ভালবাসার বোধ। কবিগুরু বিশেষ বোধটির কথা জানিয়ে লিখেছেন, আমার প্রাণের ’পরে চলে গেল কে/বসন্তের বাতাসটুকুর মতো।/ সে যে ছুঁয়ে গেল, নুয়ে গেল রে—/ফুল ফুটিয়ে গেল শত শত…। আর বিখ্যাত সেই স্বীকারোক্তি তো সবার জানা, যেখানে কবিগুরু বলছেন, ফুলের বনে যার পাশে যাই তারেই লাগে ভাল…। হ্যাঁ বসন্ত এমনই। ভাললাগা ভালবাসার সৌরভ ছড়ানো ছাড়াও মিলনের বার্তা দেয় বসন্ত। এমন লগ্নে প্রিয়জনের কাছে দেহমন সঁপে দিতে যেন বাধা নেই কোন। ভীরু প্রাণে কেবলই বাজে, মধুর বসন্ত এসেছে মধুর মিলন ঘটাতে/ মধুর মলয়সমীরে মধুর মিলন রটাতে…। লোকজ সুরেও প্রতিধ্বনি হয় অভিন্ন বাসনা। আব্বাসউদ্দীনের কালজয়ী কণ্ঠ শোনায় : সুখ বসন্ত দিলরে দেখা, আর তো যৈবন যায় না রাখা গো…। এভাবে বসন্তের আগমনে উচাটন হয়ে ওঠে মন। পুরনো বেদনা, হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি ভালবেসে এর পেছনে আবারও ছুটতে আমন্ত্রণ জানায়। পাখিরাও প্রণয়ী খোঁজে এ সময়। ঘর বাঁধে। মৌমাছিরা মধুর খোঁজে হন্যে হয়। এক ফুল থেকে অন্য ফুলে ছোটে।
আর যারা বসন্তেও বাঁধে না ঘর, বাঁধতে পারে না যারা, তাঁদের বেদনা অপার। বেদনাকে নিয়ে খেলা করে বসন্ত। উস্কে দেয়। কবিগুরুর সেই বেদনা উল্লেখ করে লিখেছেন, মর্মরিয়া ওঠে আমার দুঃখরাতের গান/ফাগুন, হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান…। অন্যত্র তিনি লিখেছেন : অতি নিবিড় বেদনা বনমাঝে রে/আজি পল্লবে পল্লবে বাজে রেÑ/দূরে গগনে কাহার পথ চাহিয়া/আজি ব্যাকুল বসুন্ধরা সাজে রে…। সব মিলিয়ে দারুণ সব অনুভূতির অনন্য ঋতু বসন্ত।
প্রিয় ঋতুকে বরণ করে নিতে আজ সারাদেশেই বসন্ত উৎসবের আয়োজন করা হবে। রাজধানী ঢাকার অলিগলি রাজপথে বাড়বে ভিড়। রঙিন হয়ে উঠবে চারপাশ। ছোট্ট মেয়েটিও খোঁপায় জড়িয়ে নেবে গাঁদা ফুল। বড়দের মতো শাড়ি পরে গন্তব্য হীন হেঁটে যাবে। ছেলেরা পরবে পাঞ্জাবি। তবে এবার একই দিনে ভালবাসা দিবস উদ্যাপিত হবে। এর ফলে বাসন্তি রং এবং ভালবাসার লাল পোশাকে দুটো রংই দেখা যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দিনটি বিশেষত প্রেমিক প্রেমিকাদের। যুগল শ্রোতে ভেসে উদ্যাপন করবে চিরসুখীজন। এভাবে গোটা শহরে পৌঁছার বসন্তের বার্তা। যথারীতি মানুষের ঢল নামবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি, চারুকলার বকুল তলাসহ আশপাশের এলাকায়। আর সব ঢেউ আছড়ে পড়বে অমর একুশে গ্রন্থমেলায়। বইয়ের মেলা হয়ে উঠবে বাঙালী সংস্কৃতির বর্ণাঢ্য উৎসব। রমনা পার্ক বোটানিক্যাল গার্ডেন, চন্দ্রিমা উদ্যানের সবুজের সঙ্গে আজ হলদে রংটি মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস রেস্তরাঁ সবখানে পরিলক্ষিত হবে উৎসবের রং উচ্ছ্বল ছোটাছুটি।
রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্তে আজ থাকছে বেশ কিছু অনুষ্ঠান। ‘এসো মিলি প্রাণের উৎসবে’ সেøাগানে একসঙ্গে চারটি ভেন্যুতে উৎসব আয়োজন করা হচ্ছে। আয়োজক জাতীয় বসন্ত উৎসব উদ্যাপন পরিষদ। বসন্তের প্রকৃতি বর্ণনা ও বন্দনা ছাড়াও এসব মঞ্চ থেকে বাঙালীর জীবনে বসন্তের প্রভাব নানা ব্যঞ্জনায় ফুটিয়ে তোলা হবে।
আয়োজকদের পক্ষে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরী সুইট জানান, বসন্ত উৎসবের অনুষ্ঠান একযোগে চলবে চারুকলার বকুলতলা, ধানম-ির রবীন্দ্রসরোবর, সদরঘাটের বাফা ও উত্তরায়।
বসন্ত উদ্যাপন উপলক্ষে বাঙালির গর্বের প্রতিষ্ঠান ছায়ানটও বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। আজ সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় ছায়ানট ভবনে শুরু হবে বসন্তবরণ অনুষ্ঠান। এর বাইরে ছোট বড় নানা প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের পক্ষ থেকে ঘরে বাইরে বসন্ত উৎসবের আয়োজন করা হবে।
এদিকে বসন্ত উৎসব উদ্যাপনের বড় অনুষঙ্গ ফুল। মৌসুমি ফুল যেন প্রিয় ঋতুর অর্ঘ্য। একদিন আগে থেকেই ঢাকার ফুলের দোকানে ভিড় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেখানে ফুল বিক্রি হতো না, সেখানেও এখন ফুলের পসরা। এমনকি ঢাকার ফল ব্যবসায়ীরা ফুল বিক্রি করছেন! আজ এ বিক্রি বেড়ে কয়েকগুণ হয়ে যাবে বলে আশা করছেন বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার্স সোসাইটি (বিএফএস)। ফুল বিক্রেতাদের সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আজকের দিনে ১৯০ কোটি টাকার ফুলের ব্যবসা হবে। গত বছর বসন্ত ও ভালবাসা দিবস। এ দুদিনে দুইশ’ কোটি টাকার ফুল বিক্রি হয়েছিল। এবার বসন্ত ও ভালবাসা দিবস এক হয়ে যাওয়ায় বিক্রি বাড়বে বলেই আশা করছেন তারা। ফুলের চাহিদা বেশি থাকায় দামও বেড়ে গেছে। তবে আজকের দিনে দাম টামের জন্য যে কিছু আটকে থাকবে না, সে তো বলাই বাহুল্য!
ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে আমার নামটি লিখো-তোমার মনের মন্দিরে : উইল ইউ বি মাই ভ্যালেন্টাইন? আজকের দিনে এই তো একমাত্র প্রশ্ন। একমাত্র জিজ্ঞাসা। আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার, ভালোবাসার বিশেষ দিবস ভ্যালেনটাইন্স ডে।
ভালোবাসি ভালবাসি আর ভালোবাসি। না, আর কোন কথা নয়। মুখ থেকে, বুকের গভীর থেকে শুধু বলাÑ ভালোবাসি। বছর ঘুরে আবারও এসেছে সেই দিন।
ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে/ আমার নামটি লিখোÑ তোমার/ মনের মন্দিরে …। মনের মন্দিরে লেখা হয়েছে কি প্রিয়জনের নাম? বলা হয়েছে ভালোবাসি? আজ বলুন। ভালোবাসার শক্তিতে সুন্দর সমাজ প্রেমময় পৃথিবী গড়ার শপথ নেয়ার দিন এসেছে। কবিগুরু বলেছিলেন, তোমার গোপন কথাটি, সখী রেখো না মনে।/শুধু আমায়, বোলো আমায় গোপনে …। হৃদয়ের একান্ত গোপন কথাটি আজ প্রকাশ করবেন অনেকেই। প্রিয়জনের সামনে হাঁটু গেড়ে ঠিক বসে যাবেন। হাতে গোলাপ তুলে দিয়ে জানতে চাইবেন, উইল ইউ বি মাই ভ্যালেনটাইন? আজ ভালোবাসার নেশায় নতুন করে বুঁদ হবে বিশ্ব। বাদ যাবে না বাঙালীও। সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশেও উদ্যাপিত হবে ভ্যালেনটাইনস ডে। প্রেমিক-প্রেমিকারা একে অন্যকে বিভিন্ন উপহার দেবেন। মোবাইল ফোন, এসএমএস, ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে চলবে ভালোবাসার আদান প্রদান।
মনের গভীর ভাব প্রকাশ করে হাসন রাজা লিখেছিলেন, নিশা লাগিলরে, বাঁকা দুই নয়নে নিশা লাগিলরে…। ভাটিবাংলার লোককবির ‘নিশা’ আর কাটেনি কোন দিন। বরং অনলে পুড়েছে ভেতর বাহির। কাউকে বলে তা বোঝাবার নয়। সুনামগঞ্জের অসহায় প্রেমিক কবি তাই গানে গানে বলেছেন, ধাক্ ধাক্ কইরা উঠল আগুন ধৈল আমার প্রাণে/সুরমা নদীর জল দিলে নিভে না সে কেনে …। এ আগুনকে দ্বিগুণ করতে আবারও এসেছে ভালোবাসার বিশেষ দিবস। আজ ঘরে থাকা দায়। রাধারমন থেকে বললে, ‘আমি রব না রব না গৃহে বন্ধু বিনে প্রাণ বাঁচে না …।’ প্রায় একই উচ্চারণ শাহ আবদুল করিমের। তার বলাটিÑ আমি ফুল বন্ধু ফুলের ভ্রমরা/কেমনে ভুলিব আমি বাঁচি না তারে ছাড়া …। মনের মানুষটি ছাড়া সত্যি বাঁচা দায়। ভালোবাসাহীন জীবন বিবর্ণ। আর তাই যত আকুলি বিকুলি সব ভালবাসার জন্য।
প্রথম দিকে দিবসটি ঘিরে কিছুটা ফিস ফিস ছিল। এখন আর তা নয়। বিপুল আবেগ উচ্ছ্বলতায় কাটে বিশেষ এই দিবস। ভালোবাসা দিবসে নতুন করে দেখা দেয় চিত্ত চাঞ্চল্য। রাজপথে, ক্যাম্পাসে, পার্কে, রেস্তরাঁয় প্রকাশ্যে ও গোপনে মিলবে যুগল। শহর ঘুরে বেড়াবে। একে অন্যের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলবে: নিরাশ্রয় পাঁচটি আঙুল তুমি নির্দ্বিধায়/ অলংকার করে নাও, এ আঙুল ছলনা জানে না …। প্রেমের কবি নজরুল তো প্রিয়ার চোখে হারিয়ে গিয়েছিলেন। গুন গুন করে গেয়েছিলেনÑ চেয়ো না সুনয়না আর চেয়ো না এ নয়ন পানে/জানিতে নাইকো বাকি, সই ও আঁখি কি যাদু জানে …। আজ সারা জীবন প্রিয় মানুষটির পাশে থাকার শপথ নেয়ার দিন। নজরুলের ভাষায়Ñ এসো তুমি একেবারে প্রাণের পাশে।/যাও মিশে গো আমার প্রাণে, আমার শ্বাসে …। আর যারা একলা মানুষ তাঁরা মনের মানুষটিকে ‘ভালবাসি’ বলার সব চেষ্টা করবেন। পাশ্চাত্যের অনুকরণে মেয়েদের প্রশ্নটি হবেÑ উইল ইউ বি মাই ভ্যালেনটাইন? যারা সাহস করতে পারবেন না তাঁরা অপেক্ষা করে থাকবেন, হঠাৎ কিছুর জন্য। গুন গুন করে গাইবেনÑ হাজার লোকের মাঝে রয়েছি একেলা যে-/এসো আমার হঠাৎ-আলো, পরাণ চমকি তোলো …। কারও কারও ভেতরে ভালোবাসার সব অনুভূতি তৈরি হয়ে থাকে। কিন্তু কার জন্য ব্যাকুল মন সেটি আর বোঝা হয় না। কবিগুরুকে তাই হয়ত লিখতে হয়Ñ যদি জানতেম আমার কিসের ব্যথা তোমায় জানাতাম।/ কে যে আমায় কাঁদায় আমি কী জানি তার নাম…। আর যারা নামটি জানেন কিন্তু তাঁকে বলতে পারেন না ভালোবাসি সেই তাদের ব্যথা তুলে ধরে কবিগুরু বলেছেনÑ আমি যে আর সইতে পারি নে।/সুরে বাজে মনের মাঝে গো, কথা দিয়ে কইতে পারি নে। অন্যভাবে বললে, লাগে বুকে সুখে দুখে কত যে ব্যথা,/কেমনে বুঝায়ে কব না জানি কথা …। এখানেই শেষ নয়। ভ্যালেনটাইন ডে মনের পুরনো অনেক ব্যথা জাগিয়ে তুলে। ‘হারানো হিয়ার নিকুঞ্জপথে’ ‘ঝরা ফুল’ কুড়ান কোন কোন প্রেমিক প্রেমিকা।
অবশ্য এখন স্থূল প্রেমও কম দেখা যায় না। তরুণ-তরুণীরা যখন তখন প্রেমে পড়ে যাচ্ছেন। এবং বিনা কারণে কিংবা সামান্য কারণে বলে দিচ্ছেÑ ব্র্যাকআপ! নতুন প্রেমিক কিংবা প্রেমিকাও জুটে যাচ্ছে তৎক্ষণাত। শুরু হয়ে যাচ্ছে ভালবাসাবাসি! তবে আজ এসব প্রেমের কথা হবে না। সুন্দর আর শ্রেষ্ঠ প্রেমগুলোর কথা বার বার স্মরণ করবে মানুষ। আজ সবটুকু সততা নিয়ে একে অন্যকে বলবেন ‘এভরি থিং আই ডু আই ডু ইট ফর ইউ।’ শিরি-ফরহাদ, লাইলি-মজনু, ইউসুফ-জুলেখা, রুমিও-জুলিয়েটের মতো অমর হওয়ার স্বপ্নে উদযাপিত হবে ভ্যালেনটাইনস ডে।
যত দূর তথ্য, এই ভ্যালেন্টাইন ডে উদযাপনের শুরুটা প্রাচীন রোমে। তখন ১৪ ফেব্রুয়ারি ছিল বিয়ের দেবি জুনোকে সম্মান জানানোর পবিত্র দিন। দিবসটি অনুসরণ করে পরের দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি উদযাপন করা হতো লুপারকেলিয়া উৎসব। সে সময় তরুণ-তরুণীদের খোলামেলা দেখা সাক্ষাতের তেমন সুযোগ ছিল না। জীবনসঙ্গী নির্বাচনে তাদের জন্য ছিল লটারির মতো একটি আয়োজন। উৎসবের সন্ধ্যায় কিছু কাগজের টুকরোয় তরুণীদের নাম লিখে একটি পাত্রে রাখা হতো। একটি করে কাগজের টুকরো তুলত তরুণরা। কাগজের গায়ে যার নাম লেখা থাকত তাকে সঙ্গী হিসেবে পেত তরুণটি। কখনও কখনও ওই দু’জনের মিলনের ক্ষণ এক বছর স্থায়ী হতো। কখনও কখনও তা গড়াত বিয়েতে। অপর গল্পটি এ রকমÑ স¤্রাট ক্লদিয়াসের শাসনামলে রোম কয়েকটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু তার সেনা বাহিনীতে সৈন্য সংখ্যা কম ভর্তি হওয়ায় ক্লদিয়াস উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। তিনি ধারণা করতেন, পরিবার ও ভালবাসার বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কারণেই যুদ্ধে যেতে রাজি হতো না পুরুষরা। ফলে ক্লদিয়াস সমগ্র রোমে সব ধরনের বিয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সে সময় রোমে ধর্মযাজকের দায়িত্ব পালন করছিলেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। তিনি এবং সেন্ট ম্যারিয়াস খ্রীস্টান ধর্মাবলম্বী তরুণ-তরুণীদের গোপনে বিয়ের ব্যবস্থা করে দিতেন। বিবাহিত যুগলদের সহযোগিতা করতেন। এ অপরাধে রোমের ম্যাজিস্ট্রেট তাকে গ্রেফতার করে করাগারে নিক্ষেপ করেন। বন্দী থাকা অবস্থায় অনেক তরুণ তাকে দেখতে যেত। জানালা দিয়ে তার উদ্দেশে চিরকুট ও ফুল ছুড়ে দিত। হাত নেড়ে জানান দিত, তারা যুদ্ধ নয়, ভালবাসায় বিশ্বাস রাখে। এদের মধ্যে একজন আবার ছিল কারারক্ষীর মেয়ে। তার বাবা তাকে ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ করে দিতেন। এক পর্যায়ে তারা একে অপরের বন্ধু হয়ে যান। ভ্যালেন্টাইন মেয়েটির উদ্দেশে একটি চিরকুট লিখে রেখে যান। এতে লেখা ছিল ‘লাভ ফ্রম ইয়র ভ্যালেন্টাইন।’ বিচারকের নির্দেশ অনুসারে সে দিনই ভ্যালেনটাইনকে হত্যা করা হয়। সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের এই আত্মত্যাগের দিনটি ছিল ২৬৯ খ্রীস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি। কালের ধারাবাহিকতায় আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এর কেন্দ্রীয় চরিত্রটি হয়ে ওঠেন সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। তার নামেই দিবসটির নামকরণ করা হয়েছে ভ্যালেন্টাইনস ডে। এ দিনে তরুণ-তরুণীরা সাধারণত লাল পোশাকে সেজে ঘর থেকে বের হন। তবে এবার একই দিনে পহেলা ফাল্গুন। ঘটা করে বসন্ত উৎসব উদযাপন করা হবে। এর ফলে বাসন্তী রং এবং ভালবাসার লাল পোশাকে দুটো রং দেখা যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পোশকী রং যাই হোক, ভালবাসা প্রকৃত। জয় হোক প্রকৃত ভালবাসার।