কাজিরবাজার ডেস্ক :
কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ কবিতায় লিখেছেন, ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনো চারকোটি পরিবার/খাড়া রয়েছে তো/যে-ভিৎ কখনো কোন রাজন্য পারেনি ভাঙতে।’ ভাষা আন্দোলন নিয়ে বাঙালীর গর্বের অন্ত নেই। একুশে ফেব্রুয়ারি উচ্চারণ করলে সেটা তখন আর সংখ্যা বাচকে সীমাবদ্ধ থাকে না। শুধু মাতৃভাষা আর রাষ্ট্রভাষার গূঢ় ব্যঞ্জনা অতিক্রম করে এর বিস্তার সুদূর প্রসারী হয়ে যায়। ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ বাংলাভাষী সব মানুষের বুকের রুধির আর অবিরল অশ্রুপাতে সিক্ত। জাকির হোসেন সম্পাদিত ‘একুশের কবিতা সংকলন’ গ্রন্থে মাতৃভাষার প্রতি এভাবেই শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে।
বাংলাভাষা নিয়ে চক্রান্তের শুরু বহু আগে থেকেই। এর চূড়ান্ত বহির্প্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিস (সিএসপি) পরীক্ষা থেকে বাংলাকে বাদ দেয়া হয়। ১৯৪৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমানের নজিরা বাজারের বাসায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতা অধ্যাপক আবুল কাশেমের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল যায়। প্রতিনিধিদল শিক্ষামন্ত্রীর কাছে জানতে চান সিএসপি পরীক্ষা থেকে বাংলা ভাষাকে কেন বাদ দেয়া হলো। এ নিয়ে মন্ত্রীর সঙ্গে সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের তুমুল বিতর্ক হয়। মন্ত্রী পরে প্রতিনিধি দলকে বলেন, এটা নিতান্তই ভুলবশত হয়েছে। বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব-বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ (প্রথম খ-) গ্রন্থে এ কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
একই সালে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর পরীক্ষা থেকেও বাংলা ভাষাকে বাদ দেয়ার চক্রান্ত শুরু হয়। ওই পরীক্ষা উর্দু ও ইংরেজী ভাষায় নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলে কলকাতার দৈনিক ইত্তেহাদ পত্রিকায় নৌবাহিনীর পরীক্ষায় বাংলা মাধ্যম বাদ দেয়ার বিষয়ে ‘ভুলের পুনরাবৃত্তি‘ শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করা হয়। পরে এ সম্পদকীয় ১৯৪৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি সিলেট থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক নওবেলাল’ পত্রিকায় পুনর্মুদ্রিত হয়। এরপর তমদ্দুন মজলিসের অধ্যাপক আবুল কাশেম পূর্ব-পাকিস্তানের মন্ত্রী হাবিবুল্লাহ বাহার ও নূরুল আমিনের সঙ্গে সাক্ষাত করে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান।
মাতৃভাষা রক্ষার জন্য ৪৮ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে দেশব্যাপী ‘বাংলাভাষা প্রচার তহবিল’ গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এমতাবস্থায় তমদ্দুন মজলিসের কেন্দ্রীয় পরিষদ সেদিন ‘বাংলাভাষা প্রচার তহবিল’ নামে রাষ্ট্রভাষা প্রচার তহবিলের জন্য অনুদান চেয়ে আবেদন পাঠায়।
বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ববাঙলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে, ১৯৪৭ সালের ২০ ডিসেম্বর ‘বলিয়াদী হাউসে’ পার্লামেন্টারি উপদলের এই জাতীয় একটি বৈঠক হয়। ওই বৈঠকে ডক্টর মালেকসহ ১৬ জন উপস্থিত ছিলেন না। উপস্থিত ছিলেন কমরুদ্দীন আহমদ তাজউদ্দীন আহমদ শেখ মুজিবুর রহমান শওকত আলী শামসুজ্জোহা আসলাম আবদুল আউয়াল আজিজ আহমদ মহিউদ্দীন আহমদ আতাউর রহমান খান কফিলউদ্দীন চৌধুরী কাদের সর্দার ও মতি সর্দার। পরদিন মুসলিম লীগ পার্লমেন্টারি পার্টির সভায় খাদ্য সমস্যা পাট সমস্যা ইত্তেহাদ, মন্ত্রী ও পার্লামেন্টারি সেক্রেটারিদের মাইনে ইত্যাদি প্রশ্নেও এই আলোচনায় সিদ্ধান্ত হয়। নাজিমুদ্দীনের মন্ত্রী অপসারণের আশঙ্কার প্রশ্নও আলোচনার অন্তর্ভুক্ত থাকে। বিকল্প মন্ত্রী যার নেতৃত্বে গঠিত হবে কর্মীরা তার নাম জানতে চান। পার্লামেন্টারি পার্টির নেতারা এই প্রশ্নের জবাব ২২ ডিসেম্বর দেয়া হবে বলে আশ্বাস দেন। এই বৈঠক রাত আটটা পর্যন্ত চলে। পরে একটি মোটরগাড়িতে চড়ে তাজউদ্দীন আহমদ শওকত আলী শেখ মুজিবুর রহমান ও মহিউদ্দীন পলাশী ব্যারাক, সলিমুল্লাহ, নীলক্ষেত ব্যারাক, ফজলুল হক হল, ইঞ্জিনিয়ারিং হোস্টেল ও নিমতলী মেসে ‘ইত্তোহাদ’ কাগজ বিতরণ করেন। ইত্তেহাদ সে সময় নাজিমুদ্দীনবিরোধী উপদলটিকে সমর্থন করত। এজন্য ইত্তেহাদকে সরকারীভাবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও সে সময় লোক মারফত বড় বড় প্যাকেটে ইত্তেহাদ ঢাকায় আসত। ইত্তেহাদে নাজিমুদ্দীন বিরোধী নানা কথা প্রচার হতো।