বিশেষ বৈঠকে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ॥ কোন ঝুঁকি নেয়া যাবে না ॥ চীন গমনকারী বিমানের পাইলটদের অন্য দেশ ভিসা দিতে চাচ্ছে না

22
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রী পরিষদ কক্ষে মন্ত্রী পরিষদ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
করোনা ভাইরাস কোন অবস্থায় যাতে বাংলাদেশে ঢুকতে না পারে সে বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার জন্য আবারও নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভায় নিয়মিত বৈঠক শেষে ২০/২৫ মন্ত্রীকে নিয়ে বিশেষ বৈঠকে তিনি এই নির্দেশ দেন। এছাড়া চীনে আটকেপড়া অন্য বাংলাদেশীদের দেশে ফিরিয়ে আনতে জটিলতা তৈরি হয়েছে। যেসব পাইলট ইতোমধ্যে চীন থেকে আটকেপড়া বাংলাদেশীদের ফিরিয়ে এনেছে, তাদের সিঙ্গাপুরসহ অন্যান্য দেশ ভিসা দিচ্ছে না। তাই চীনের প্লেনে করে বাকিদের আনার ব্যবস্থা করার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। পাশাপাশি কোম্পানি নিবন্ধনের সময় সিল নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়ে ‘কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২০’-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোাদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। এছাড়া মন্ত্রিসভা ডেজিগনেটেড রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টস বাংলাদেশ আইন ২০২০-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে।
বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রী পরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম বলেন, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যেভাবেই হোক, একে (করোনা ভাইরাস) আমাদের দেশে ঢোকা প্রতিরোধ করতে হবে। এ লক্ষ্যে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। চীন থেকে যারা ফিরবেন, তাদের অবশ্যই ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে রাখতে হবে। কারণ আমরা এটা নিয়ে কোন প্রকার ঝুঁকি নিতে চাই না। এ সময় প্রধানমন্ত্রী কোয়ারেন্টাইনে থাকা চীন ফেরত বাংলাদেশীদের বিষয়ে খোঁজখবর নেন।
ইতোমধ্যে যে ৩১২ ব্যক্তি এসেছেন (চীনের উহান থেকে) তাদের হজ ক্যাম্পে রাখা হয়েছে। সেখানে খাওয়া-দাওয়া সবকিছু দেয়া হচ্ছে। প্রাথমকিভাবে তারা বোধহয় বুঝতে পারেননি তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হবে। তারা ভাবছেন ছেড়ে দেবে, বাড়িতে চলে যাবে। ইয়ং ছেলেরা প্রথমে জানতেও চাচ্ছিল, আমাদের কেন আটকে রাখা হয়েছে? তাদের বোঝানো হলো এটা তো হাইলি রিস্কি। ওই ৩১২ জনের মধ্যে আটজনের শরীরে জ্বর থাকায় তাদের হাসপাতালে পাঠিয়ে বাকিদের আশকোনার হজ ক্যাম্পে পাঠানো হয়েছিল গত শনিবার।
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডাঃ মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা সোমবার সাংবাদিকদের বলেছেন, ওই আটজনের নমুনা পরীক্ষা করে কারও শরীরে করোনা ভাইরাস পাওয়া যায়নি।
নতুন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের প্রেক্ষাপটে চীনের উহান থেকে ৩১২ বাংলাদেশীর প্রথম দলটিকে যে পাইলটরা উড়িয়ে এনেছেন, তাদের এখন ঢুকতে দিতে চাইছে না অন্য দেশ। এই পরিস্থিতিতে আরও ১৭১ বাংলাদেশীকে উহান থেকে ফেরানো নিয়ে জটিলতা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী পরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নভেল করোনা ভাইরাস নিয়ে বৈশ্বিক জরুরী অবস্থা ঘোষণা করায় সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রী সভার বৈঠকের পর তার উপস্থিতিতে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়।
পরে সচিবালয়ে এ বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য সাংবাদিকদের সামনে তুলে ধরেন মন্ত্রী পরিষদ সচিব। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আরও ১৭১ বাংলাদেশী উহানে আছেন, যারা দেশে ফিরতে চান। সমস্যা হলো, আমাদের প্লেন পাঠালে অসুবিধা হচ্ছে। আমাদের যে প্লেনটা গিয়েছিল, আসার পরে এই পাইলটদের কোন দেশ ঢুকতে দিচ্ছে না। সেজন্য আলোচনা হয়েছে, দেখতে হবে চার্টার করা প্লেন যদি পাওয়া যায় সেটাই হবে সবচেয়ে ভাল উপায়। চায়নিজ চার্টার করা প্লেন যদি আনা যায় সেটাকে ফার্স্ট প্রেফারেন্স দিতে হবে।
চীনের উহান শহরে ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর করোনা ভাইরাসের প্রথম সংক্রমণ শনাক্ত করা হয়। এরপর এক মাসে ৩৬২ জনের মৃত্যু হয়েছে, আক্রান্তের সংখ্যা ১৭ হাজার ছড়িয়েছে। নভেল করোনা ভাইরাসের কোন টিকা বা ভ্যাকসিন এখনও তৈরি হয়নি। ফলে আপাতত নিরাপদ থাকার একমাত্র উপায় হলো, যারা ইতোমধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন বা এ ভাইরাস বহন করছেন- তাদের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা এবং কিছু স্বাস্থ্যবিধি ও পরিচ্ছন্নতার নিয়ম মেনে চলা।
এ ভাইরাস অন্যান্য দেশে ছড়াতে থাকায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) বৈশ্বিক সতর্কতা জারি করেছে। কয়েকটি দেশ তাদের নাগরিকের চীন থেকে সরিয়ে নিয়েছে বা নিচ্ছে। কয়েকটি দেশ তাদের সীমান্তে চীনাদের জন্য কড়াকড়িও আরোপ করেছে।
উহানের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন বা গবেষণায় যুক্ত আছেন, এমন ৩১২ বাংলাদেশীকে গত শনিবার বিমানের একটি বোয়িং ৭৭৭-৩০০ ইআর উড়োজাহাজে করে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। তাদের কারও মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণের তথ্য পাওয়া না গেলেও সাবধানতার অংশ হিসেবে রাখা হয় ১৪ দিনের পর্যবেক্ষণে।
নতুন করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে চীনের অবরুদ্ধ নগরী উহান থেকে দেশে ফেরানোদের শনিবার দুপুরে হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বাসে নিয়ে যাওয়া হয় আশকোনা হজ ক্যাম্পে, সেখানে ১৪ দিন পর্যবেক্ষণ করা হবে তাদের। তাদের আনতে চার চিকিৎসক, চারজন ককপিট ক্রু ও ১১ কেবিন ক্রুকে পাঠানো হয়েছিল ওই উড়োজাহাজে। সংক্রমণ এড়াতে মাস্ক, সানিটাইজার, ডিসপোজেবল গাউনসহ বিভিন্ন সরঞ্জামও তাদের সঙ্গে দেয়া হয়েছিল।
সংবাদমাধ্যমে আসা খবর অনুযায়ী, ‘আকাশ প্রদীপ’ নামের বিমানের ওই উড়োজাহাজকে ১২ ঘণ্টা ধরে স্প্রে করে জীবাণুমুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এখন জটিলতা বেঁধেছে ওই ফ্লাইটের পাইলটদের নিয়ে। তাদের অন্য দেশ ঢুকতে দিতে রাজি না হওয়ায় অন্য কোন পাইলটকে আর চীনে পাঠানোর ঝুঁকি নিতে পারছেন না বাংলাদেশ। ফলে দেশে ফিরতে আগ্রহী ১৭১ বাংলাদেশীকে উহানেই অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে।
মন্ত্রী পরিষদ সচিব বলেন, আমাদের এ্যাম্বাসিকে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে। এই মুহূর্তে প্লেন পাঠানো যাচ্ছে না, কারণ আমাদের প্লেন পাঠালে যে ক্রুরা যাবে, তাদের বাইরে ভিসা দেয় না। ইতোমধ্যে সিঙ্গাপুর না করে দিয়েছে। তারা বলেছে, এই ক্রুরা (যারা চীনে গিয়েছিল) সিঙ্গাপুরেও যেতে পারবে না। এক প্রশ্নের জবাবে আনোয়ারুল বলেন, মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘২০/২৫ জনকে নিয়ে’ করোনা ভাইরাস বিষয়ে আলোচনা করেন।
কোম্পানি আইন : কোম্পানি নিবন্ধনের সময় সিল নিবন্ধনের বাধ্যবাধকতা তুলে দিয়ে ‘কোম্পানি (সংশোধন) আইন, ২০২০’-এর খসড়া চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রী সভা। সোমবার (৩ ফেব্রুয়ারি) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে মন্ত্রী সভার নিয়মিত বৈঠকে এই অনুমোদন দেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।
মন্ত্রী পরিষদ সচিব বলেন, এই আইনটিকে অধিকতর ব্যবসাবান্ধব ও সহজ করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় উদ্যোগ নিয়েছিল। বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহযোগিতায় এই আইনের খসড়াও প্রণয়ন করা হয়। নেয়া হয় মতামত। তবে সব ধারা নিয়ে ঐকমত্য না হওয়ায় খসড়াটি চূড়ান্ত হয়নি। চূড়ান্ত খসড়া প্রণয়ন প্রক্রিয়াধীন থাকাবস্থায় ২০১৮ সালের ৮ জুলাই বিনিয়োগ প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে একটি সভা হয়। সেখানে কমিটি গঠন করে বিনিয়োগ সংশ্লিষ্ট একটি ধারা দ্রুত সংশোধনের সিদ্ধান্ত হয়।
বিদ্যমান আইন পর্যালোচনা করে দেখা যায় যায়, কোম্পানির রেজিস্ট্রেশনের জন্য প্রতিষ্ঠানের সিলের প্রয়োজনীয়তা নেই। তবে কোম্পানির নিজস্ব কার্যক্রম পরিচালনায় সিল ব্যবহার করে। কোম্পানির কমন সিল, সাধারণ সিল, অফিসিয়াল সিল বিলোপ করার জন্য কোম্পানি আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধনের জন্য খসড়া উপস্থাপন করা হলে মন্ত্রিসভা বিস্তারিত আলোচনার মাধ্যমে নীতিগত ও চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়।
মন্ত্রী পরিষদ সচিব বলেন, কোম্পানি রেজিস্ট্রেশনের সময় সিল ছাড়াই করতে পারবে। কিন্তু নিজস্ব কাজের জন্য সিল ব্যবহার করতে হবে। কারণ অনলাইনে যখন কাজ করে তখন তো সিল ব্যবহার করা যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, রেজিস্ট্রেশনের সময় সিল থাকতে হবে এই বাধ্যবাধকতা বাদ দিলে ব্যবসার সূচক ৬-৭ নম্বর বেড়ে যায়। তখন আমাদের ওয়ার্কিং ওপরের দিকে চলে যাবে। সেই চিন্তা-ভাবনা করে মন্ত্রী সভা এটাকে ভেটিংয়ে নেয়ার শর্তে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে। আগামী ৩১ মার্চের মধ্যে এটা সংশোধন করলে ৭ বা ৮ পয়েন্ট পেয়ে যাব।
ডেজিগনেটেড রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টস বাংলাদেশ আইন ২০২০-এর খসড়ার নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে মন্ত্রিসভা। আন্তর্জাতিক মান সংস্থা বা আন্তর্জাতিক মানক সংস্থা (আইএসও) অনুযায়ী কেমিক্যাল সংক্রান্ত যে কোন পরীক্ষা এই ইনস্টিটিউটে করা সম্ভব হবে। এজন্য আর বাইরে যেতে হবে না জানিয়েছেন খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, এটি কোনভাবেই বিএসটিআই’র সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। এই ইনস্টিটিউটের প্রধান হবেন মহাপরিচালক (ডিজি)।
মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে স্বাক্ষরিত ‘প্রটোকল অন ট্রান্স-বাউন্ডারি এলিফ্যান্ট কনজারভেশন বিটুইন রিপাবলিক অব বাংলাদেশ এ্যান্ড রিপাবলিক অব ইন্ডিয়া’-এর খসড়ার ভূতাপেক্ষ অনুমোদন দেয়া হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘এটি করা হয়েছে অনেক সময় সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া ভেদ করে বন্য হাতি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী ২৩ হাতি মারা গেছে এবং বন্য হাতির আক্রমণে মারা গেছেন ৩৩ ব্যক্তি। এছাড়া হাতির আক্রমণে অসংখ্য বাড়িঘর ও ফসল নষ্ট হয়েছে। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে দুই দেশের মধ্যে এই চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে।
২০১৮ সালের ২৯ নভেম্বর দুই দেশের মধ্যে এ সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছিল। এছাড়া মন্ত্রী সভার বৈঠকে ‘জাতীয় তেল ও রাসায়নিক নিঃসরণ কনটিনডেনসি পরিকল্পনা’-এর বাংলা ও ইংরেজী ভাষায় প্রণীত খসড়ার অনুমোদন দেয়া হয়েছে।