ব্রেক্সিটের প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের পোষাক খাতে

10

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বাংলাদেশ থেকে নিয়মিতভাবে যুক্তরাজ্যে তৈরি পোষাক রপ্তানি করে ইস্ট ওয়েস্ট গ্রুপ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সংস্থাটির কর্মকর্তারা বলছেন, এখনো দুই দেশের বাণিজ্যে কোনো প্রভাব না পড়লেও ভবিষ্যতে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
ইস্ট ওয়েস্ট গ্রুপের উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক রুমানা রশীদ বলছেন, ‘যুক্তরাজ্যের অনেকগুলো ছোট ছোট প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছ থেকে পোশাক কিনে থাকে। তারা বলেছে, ব্রেক্সিটের পর তাদের ব্যবসা কমে যেতে পারে। আর তাদের ব্যবসা কমলে স্বাভাবিকভাবে আমাদের ব্যবসার ওপরেও প্রভাব পড়বে।’
তিনি বলছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে হয়তো বড় কোনো প্রভাব চোখে পড়বে না। কিন্তু তারপরে কী হবে, সেটা নির্ভর করবে যুক্তরাজ্য বাংলাদেশের সঙ্গে কী ধরনের চুক্তি করে এবং তারা কী ধরনের নীতি গ্রহণ করে।
গত ৩১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গেছে যুক্তরাজ্য।
তবে আগামী এক বছর এই বিচ্ছেদের অন্তর্বর্তীকালীন সময় থাকবে। অর্থাৎ এ সময় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের আগামী চুক্তি, হিসাবনিকাশ যেমন চলবে, তেমনি এতদিন যারা ইইউর নিয়মনীতি অনুসরণ করে ব্যবসা করে আসছিল, তাদেরও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে।
ফলে বাংলাদেশকেও যুক্তরাজ্যের সঙ্গে নতুন করে বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে, যেখানে আরো কিছু পণ্যের সঙ্গে তৈরি পোষাকের বড় বাজার রয়েছে।
বিজিএমইএ জানিয়েছে, ২০১৯ সালে যুক্তরাজ্যে তৈরি পোষাক রপ্তানি হয়েছে ৩.৮৪ বিলিয়ন ডলারের। ২০১৮ সালে এই পরিমাণ ছিল ৩.৭৫ বিলিয়ন ডলার।
শুল্কমুক্ত সুবিধা : রুমানা রশীদের মতো ব্যবসায়ীর আশঙ্কা, ব্রেক্সিটের কারণে এই রপ্তানি খাতের ওপরেও প্রভাব পড়তে পারে।
এর কারণ হিসাবে তারা বলছেন, ইউরোপের বাজারে রপ্তানিতে জিএসপি প্লাস সুবিধা পাওয়ায় বাংলাদেশকে শুল্ক দিতে হয় না। ফলে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ কিছুটা কম দরে পোশাক রপ্তানি করতে পারে। এতদিন ধরে যুক্তরাজ্যের বাজারেও এই সুবিধা পেয়ে আসছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশ থেকে ২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ইউরোপে পোষাক রপ্তানি হয়েছে ১৯.৬৩ বিলিয়ন ডলার। এর বড় অংশটি গিয়েছে যুক্তরাজ্যে। কিন্তু যুক্তরাজ্যের সঙ্গে নতুন বাণিজ্য চুক্তিতে সেই সুবিধা থাকবে কি না, সেটি নিয়ে আশঙ্কা রয়েছে। শুল্কমুক্ত সুবিধা পাওয়া না গেলে বাংলাদেশকে ভিয়েতনাম, চীন, ভারতের মতো দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পড়তে হবে।
তবে এখনি আশঙ্কার কোনো কারণ দেখছে না বাংলাদেশে তৈরি পোষাক উৎপাদন ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ। সংগঠনটির সিনিয়র সহ-সভাপতি ফয়সাল সামাদ বিবিসিকে বলছেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আমরা আশা করছি, এতদিন ইউরোপীয় ইউনিয়নের যেসব সুবিধা পেয়ে আসছি, ব্রেক্সিটের পর যুক্তরাজ্যেও সেগুলো পাওয়া যাবে। ইইউতে যেহেতু আমরা শুল্কমুক্ত সুবিধা পেয়েছি, যুক্তরাজ্যেও সেটা পাবো বলে আশা করছি।’
‘এর আগে আমাদের যে আলাপ আলোচনা হয়েছে, সেখানেও এরকমটাই আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে। ফলে আমরা আশা করছি, এখন যুক্তরাজ্যে আমাদের যে ধরনের ব্যবসা আছে, সেটা একইরকম থাকবে।’
তিনি মনে করেন, ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের নতুন যে চুক্তি হবে, তার ওপর নির্ভর করবে সুবিধা-অসুবিধার ব্যাপারগুলো।
যুক্তরাজ্যের সঙ্গে নতুন চুক্তি করতে চাইবে ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দেশগুলোও। ফলে বাংলাদেশ কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়বে?
সামাদ বলছেন, প্রতিযোগিতা তো রয়েছেই, সেটা হয়তো আরেকটু বাড়বে। তবে যেহেতু ব্রিটেনের সঙ্গে এতদিন ধরে আমাদের ব্যবসাবাণিজ্য, ভালো যোগাযোগ রয়েছে, আশা করা যায়, আমাদের ক্ষেত্রে নেতিবাচক কোনো সমস্যা হবে না। এই একবছরে আমরা এ নিয়ে আরও কাজ করবো, যাতে সবকিছু স্বাভাবিক থাকে।
নিজেদের প্রস্তুতি নেয়া দরকার : বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ব্রেক্সিট পরবর্তী ব্রিটেনের বাজারে অবস্থান ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশের উচিত এখনি প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলছেন, ‘ব্রেক্সিটের পরে প্রথমদিকে কিছুটা প্রভাব ফেলবে। কারণ ইউকের সঙ্গে নতুন করে বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে। যদিও তারা বলেছে যে, কোনো সমস্যা হবে না, কিন্তু চুক্তি হওয়ার আগে কিছুই বলা সম্ভব নয়।’
‘যদি ইইউর আদলে যুক্তরাজ্য চুক্তি করে, তাহলে আর চিন্তার কিছু থাকবে না। কিন্তু সেটা যদি না হয়, তাহলে কী চুক্তি হবে, সেখানে শর্তগুলো কী থাকবে, তার ওপরে অবশ্যই তৈরি পোশাক খাতসহ বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের ওপর প্রভাব ফেলবে।’
তিনি বলছেন, প্রথমে দরকার আলোচনার মাধ্যমে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো সুবিধাগুলো নেয়া। দ্বিতীয়ত নিজেদের প্রস্তুত করে তুলতে হবে, যাতে অন্যান্য প্রতিযোগীদের সাথে লড়াই করে বাজারে নিজের অবস্থান ধরে রাখা যায়। আর তৃতীয়ত সরকারের এমন নীতি গ্রহণ করতে হবে, যাতে রপ্তানিকারকরা তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারেন।
‘বাংলাদেশে এখন উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে কর্মীদের উৎপাদনশীলতাতেও ঘাটতি রয়েছে। এসব দিক থেকে কিন্তু ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা এগিয়ে গেছে। ফলে শুধু যুক্তরাজ্য নয়, বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে হলে এগুলো কাটিয়ে উঠতে হবে,’ বলছেন ফাহমিদা খাতুন।
তবে আলাদাভাবে যুক্তরাজ্যের বাজার উন্মুক্ত হওয়ায় ভিয়েতনাম, শ্রীলঙ্কা, ভারত, চীনের মতো দেশগুলোও সেখানে প্রবেশের চেষ্টা করবে। সেখানে বাংলাদেশকে প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়বে হবে।
সেই প্রতিযোগিতায় টিকে থেকে অবস্থান তৈরি করাটাই বাংলাদেশের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ বলে তিনি মনে করেন।