কমলগঞ্জ থেকে সংবাদদাতা :
পিঠা বাঙালীর খাদ্য সংস্কৃতির অন্যতম ঐতিহ্য। বাংলাদেশের প্রতিটি জনপদে কোন না কোন পিঠা পাওয়া যায়। স্বাদ ও গুণে প্রত্যেক অঞ্চলের পিঠা অন্যন্য। দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো সিলেট অঞ্চলেও রয়েছে পিঠার নিজস্ব ঐতিহ্য। বিভিন্ন ধরনের ও বিভিন্ন স্বাদের পিঠা বানানো হয় সিলেট অঞ্চলে। ঢলু বাঁশের লম্বা সরু চুঙ্গায় বিন্নি চালের গুঁড়া। নাড়ার আগুনে বাঁশের ভেতর সিদ্ধ হয়ে তৈরি হলো লম্বাটে সাদা পিঠা। চুঙ্গার ভেতরে তৈরি বলে এর নাম চুঙ্গা পিঠা। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে এক সময় শীত মৌসুমে ভাপা, পুলি আর মালপো পিঠার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে উৎসব মাতালেও এই পিঠার এখন দেখা পাওয়াই দুষ্কর। এক সময় বাড়িতে জামাই এলে এই চুঙ্গা পিঠার সঙ্গে হালকা মসলায় ভাজা মাছ বিরাণ ও নারিকেল ও কুমড়ার মিঠা বা রিসা পরিবেশন না করতে পারলে যেনো লজ্জায় মাথা কাটা যেতো গৃহকর্তার। কুয়াশা মোড়া রাতে রাতভর চলতো চুঙ্গাপুড়া তৈরি। গিট্টু মেপে ছোট ছোট করে কাটা বাঁশের ওপর জ্বলতো খড়ের আগুন। কালের স্রোতে কোন কোন পিঠা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। শীতের কনকনে রাতে ঘটা করে এ রকম একটি বিলুপ্ত প্রায় পিঠা চুঙ্গাপিঠা উৎসবের আয়োজন করা হয়েছিল মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার ২নং পতনঊষার ইউনিয়নের পতনঊষার গ্রামে কবি জয়নাল আবেদীনের বাড়ির আঙ্গিনায়। গত ১৯ জানুযারি রবিবার রাত ৯টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত চলে এই পিঠা উৎসব। অবশ্য সঙ্গে ছিল গান, পুথি পাঠ, কবিতা আবৃত্তি, কৌতুকসহ বিভিন্ন পরিবেশনা। কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী, সমাজসেবীম কৃষক, শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার প্রায় দুইশত লোকের উপস্থিতিতে জমে উঠেছিল হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য গ্রাম বাংলার চুঙ্গা পিঠ উৎসব।
চুঙ্গা পিঠা উৎসব এসোসিয়েশনের আহবায়ক কবি জয়নাল আবেদীনের সভাপতিত্বে ও সদস্য সচিক মো. আব্দুল মুকিত হাসানীর সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানের শুরুতেই পুথিপাঠ করেন মো. আব্দুস শহীদ। অভিমত ব্যক্ত করেন প্রভাষক মোহাম্মদ আব্দুল আহাদ, সমাজসেবক অলি আহমদ খান, নাট্যকার ডা: মানিক চন্দ্র দেবনাথ, কবি আব্দুল হাই ইদ্রিছি, সাংবাদিক প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ, নুরুল মোহাইমীন মিল্টন, জয়নাল আবেদীন, কৃষক সংগঠক তোয়াবুর রহমান তবারক, সংস্কৃতিকর্মী মহসীন আহমদ কয়েছ, মুহিবুল ইসলাম, ওমর মাহমুদ আনছারী, কমরেড আফরোজ আলী, মিজানুর রহমান মিস্টার, আজিজুল হক পিপলু, হরমুজ আলী প্রমুখ। রাত ১০টা থেকে শুরু হয় চুঙ্গা পিঠা খাওয়া। সাথে ছিল গুড়ের লালী। পরে উপস্থিত সকলের মাঝে পায়েস বিতরণ করা হয়।
সব মিলিয়ে এ পিঠা তৈরির আবহটাই তৈরি করেছে উৎসবের আবহ। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী এই পিঠা বানাতে ঢলু নামে যে বিশেষ প্রজাতির বাঁশ দরকার হয় তা বিলুপ্ত হতে বসায় চুঙ্গাপুড়ারও আকাল চলছে এখন। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন আর পাহাড় উজাড়ের কারণে ঢলু বাঁশ এখন সহজে পাওয়াই মুশকিল। শীতকালে তবু কালেভদ্রে দেখা মেলে ঢলু বাঁশের। বিশেষ ধরনের রাসায়নিক থাকে বলে এই বাঁশ আগুনে পোড়ে না মোটেও। ক্রমাগত তৈলাক্ত তরল নি:সরণ করে টিকে ঢাকে সরু বাঁশের সবুজ শরীর। এমনকি কয়েক ঘণ্টা আগুনে পোড়ার পরও সবুজই থাকে ঢলু বাঁশ। কিন্তু আগুনের ভাপে চোঙ্গার ভেতরে ঠিকই তৈরি হয়ে যায় চুঙ্গাপুড়া।
আর এর সাথে সাথে হারিয়ে যেতে বসেছে ঐতিহ্যবাহী চুঙ্গা পিঠা। কারণ ঢলু বাঁশ ছাড়া চুঙ্গাপিঠা তৈরী করা যায় না। এই বাঁশে অত্যধিক রস থাকায় এটি সহজে আগুনে পোড়ে না। এই সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে ঢলু বাঁশের চোঙ্গায় পিঠা তৈরির বিভিন্ন উপকরণ ঢুকিয়ে দীর্ঘ সময় আগুনের তাপে ভেতরের পিঠা সিদ্ধ করা হয়। যে বাঁশের চুঙ্গায় চাল ভরা হয় সেগুলো লম্বায় দুই থেকে তিন ফুট হয়ে থাকে। এগুলো স্থানীয়ভাবে ‘চুঙ্গার বাঁশ’ নামে পরিচিত।
ঢলু বাঁশের চুঙ্গায় পিঠা তৈরির উপকরণ ঢুকিয়ে ভিন্ন স্বাদের পিঠা তৈরি করা হয়। কেউ কেউ চোঙ্গার ভেতরে বিন্নি চাল, দুধ, চিনি, নারিকেল ও চালের গুঁড়া দিয়ে পিঠা তৈরি করেন। পিঠা তৈরি হয়ে গেলে তা চুঙ্গার ভেতরেই চোঙ্গা থেকে আলাদা হয়ে যায়। চুঙ্গা পিঠা পোড়াতে খড়ের প্রয়োজন হয়। এটি যে বাড়ীতে বানানো হতো হয় সে বাড়ীতে উৎসবের আমেজ দেখা যায়। আশে পাশের বাড়ীর ছোট বাচ্চারা এসে জড়ো হয় চুঙ্গা পোড়ানোর সময়। চুঙ্গা পিঠার বাঁশ আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু, বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীদের দেয়া হতো। এখন চুঙ্গার অপ্রতুলতায়, আগ্রহের অভাবে চুঙ্গা পিঠা খাওয়া হয় না।