সিন্টু রঞ্জন চন্দ :
বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে গতকাল বৃহস্পতিবার নগরীর ঐতিহাসিক আলীয়া মাদ্রাসার মাঠে সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামীলীগের ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন-২০১৯ সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি ও মাদক ব্যবসায়ীদেরকে কখনো জায়গা দেয়নি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশজুড়ে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছেন। তাই সবাই সাবধান হয়ে যান। নেতাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, দলের দুঃসময়ের যারা ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের রেখে আজ কোন পকেট কমিটি হবে না। আপনার পকেট কমিটি করা বন্ধ করুন। আওয়ামী লীগ থেকে কখনোই কাউকে বাদ দেয়া হয় না, শুধুমাত্র দায়িত্বের পরিবর্তন হয়। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগে মনোনয়ন বাণিজ্যের দিন শেষ। এখন আর মনোনয়ন বাণিজ্য করা যাবে না। যারা মনোনয়ন বাণিজ্য করতেন তারা সময় থাকতে সাবধান হয়ে যান।
অনুষ্ঠানের শুরুতে কোরআন তেলাওয়াত, গীতা, বাইবেল ও ত্রিপিঠক পাঠের মাধ্যমে সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করে সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সম্মেলনের আনুষ্ঠানিকতা উদ্বোধন করেন।
সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এডভোকেট লুৎফুর রহমানের সভাপতিত্বে ও সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী ও মহানগর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন আহমদের যৌথ পরিচালনায় সম্মেলনে সিলেট স্বাগত বক্তব্য রাখেন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বদর উদ্দিন আহমদ কামরান।
বিশেষ অতিথি হিসেবে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ, আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ও আব্দুর রহমান, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা ইনাম আহমদ, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, কেন্দ্রীয় সদস্য অধ্যাপক মো. রফিকুর রহমান প্রমুখ। মঞ্চে এ সময় স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় নেতা, এমপি ছাড়াও সিলেট মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের নেতৃবৃন্দরা উপস্থিত ছিলেন।
পোস্টার লাগালেই বড় নেতা হওয়া যায় না উল্লেখ করে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আরও বলেন, ঢাকা মহানগরে সম্মেলনে যারা বিশাল বিশাল বিলবোর্ড লাগিয়েছেন বা শ্লোগান দিয়েছেন তাদের নেতৃত্ব দেয়া হয়নি। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, টাকা দিয়ে আওয়ামী লীগের নেতা হওয়া যায় না। আওয়ামী লীগের নেতা হতে হবে যোগ্যতা দিয়ে, ত্যাগ দিয়ে তিতীক্ষা দিয়ে। সময়ের সুবিধাবাদীদের আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দেয়া যাবে না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ মৃত্যুর মিছিলে দাঁড়িয়ে জীবনের জয়গান গায়। ধ্বংসস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে সৃষ্টির পতাকা উড়ায়। আওয়ামী লীগ বীরের রক্ত ছুয়ে ঝড়ের বিরুদ্ধে, অন্ধকারের বিরুদ্ধে, দুর্যোগের বিরুদ্ধে দিপ্ত পদভারে এগিয়ে যায়। ওবায়দুল কাদের বলেন, সময়ের চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে আওয়ামী লীগকে ঢেলে সাজানো হবে। আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের দুজন সেরা প্রধানমন্ত্রীর একজন, বিশ্বের চারজন প্রভাবশালী রাষ্ট্রনায়কের একজন এবং তিনজন সৎ নেতার মধ্যে একজন। তিনি গত ৪০ বছরে বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। তিনি বলেন, বর্তমানে আওয়ামী লীগে কর্মীর সংখ্যা কমে গেছে। বেড়েছে নেতার সংখ্যা। এখন পোস্টার-বিলবোর্ড লাগাতে মানুষ ভাড়া করতে হয়। আর এখন বিলবোর্ডে সকলেই নেতা।
সেতুমন্ত্রী আরো বলেন, সামনে মানুষ দেখি এক, আর বিলবোর্ডে মানুষ দেখি আরেক। আমাদের এমন নেতা দরকার নেই। আমাদের দরকার সাচ্চা নেতা, দুঃসময়ের নেতা। আমাদের ত্যাগী নেতা ও যোগ্য নেতা দরকার। তিনি অনুষ্ঠানের শুরুতে বলেন, আমি শ্রদ্ধা জানাই আমাদের ইতিহাসের মহানায়ক বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অমর স্মৃতির প্রতি। বাংলার স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন পর্যাযের আত্মাহুতি দিয়েছেন তাদের স্মৃতির প্রতি। তিনি আরও বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রকে বাঁচতে হলে আওয়ামী লীগকে বাঁচাতে হবে। বাংলাদেশকে বাঁচতে হলে শেখ হাসিনাকে বাঁচতে হবে। এর আগে বেলা ১২টার দিকে ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় নেতারা ঢাকা থেকে বিমানযোগে সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করেন।
এদিকে সম্মেলনকে ঘিরে সকাল থেকেই নেতাকর্মীরা খন্ড খন্ড মিছিল নিয়ে আলিয়া মাদরাসার মাঠে জড়ো হতে শুরু করেন। বর্ণিল প্ল্যাকার্ড ফেস্টুন নিয়ে শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করে তুলেন তারা সম্মেলনস্থল। প্রথম পর্বে জাতীয় সংগীতের সাথে জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে সম্মেলন উদ্বোধন করেন কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। এ সময় সম্মেলনে সরব উপস্থিতি দেখা গেছে মহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রীদের। সভাস্থলসহ সম্মেলনের আশপাশ এলাকাগুলোতে আইন শৃংঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা ছিল লক্ষণীয়।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন বলেছেন, আগামী ১৫ ডিসেম্বর থেকে ই পাসপোর্ট চালু করা হচ্ছে। যার মেয়াদ থাকবে ১০ বছর। প্রবাসীদের সুবিধার জন্য এটি করা হচ্ছে। একই সাথে প্রবাসীদের জন্য বিদেশের মাটিতে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিশেষ কোর্স চালু করা হয়েছে। মন্ত্রী আরও বলেন, প্রবাসীদের সুবিধার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে একটি অ্যাপস চালু করা হচ্ছে। এটির মাধ্যমে ৩৫ ধরণের সেবা পাবেন প্রবাসীরা। গত ১০ বছর দেশে প্রচুর উন্নয়ন হয়েছে উল্লেখ করে ড. মোমেন বলেন, উন্নয়নের সেই ধারাবাহিক বজায় থাকলে দেশে দরিদ্র মানুষ থাকবে না। এজন্য আগামী নেতৃৃত্বকে সহযোগিতা করতে হবে।
প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রী ইমরান আহমদ বলেন, সবাই চাচ্ছে পরিষ্কার রাজনীতি। সবই চায় পরিবর্তন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে যেভাবে কাজ করতে দিবেন আমি সেইভাবে কাজ করতে চাই। তিনি বলেন, আজ এই সম্মেলনে জানান দিচ্ছে সিলেটে আজ আমরা ঐক্যবদ্ধ।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেন, ডিসেম্বর মাসে আজ আওয়ামীলীগের সম্মেলন হচ্ছে আর এ মাসে পাকিস্তানীকে এদেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়ে দেশ স্বাধীন করা হয়। তিনি বলেন, আজ পর্যন্ত এ দেশে যা অর্জন হয়েছে তা শেখ হাসিনার আমলে হয়েছে ও হচ্ছে। শেখ হাসিনা আজ দেশ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের ছোয়া লেগেছে। তাই উন্নয়নের জন্যই আজকের এই সম্মেলন।
কেন্দ্রীয় সদস্য অধ্যাপক মো. রফিকুর রহমান বলেন, দলকে মজবুত রাখতে হলে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। তাই আসুন শেখ হাসিনার হাতকে আরো শক্তিশালী করে গড়ে তুলি।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, সিলেটের এই পুণ্যভূমিতে দীর্ঘ ৭ বছর আমাদের দায়িত্ব পালন করে ছিলাম। ২০০১ সালে সিলেটে মেয়র নির্বাচনের জন্য কাজ করে গেছি। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা আজ সারা বাংলাদেশকে উন্নয়ন করে মানুষকে অবাক করে দিয়েছেন। বিনামূল্যে তিনি বই, বয়স্ক ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, পঙ্গুত্বভাতাসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কাজ করে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশ গড়তে যাচ্ছেন। তাই দেশের এই উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আজকের এই সম্মেলন।
আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা ইনাম আহমদ বলেন, আলীয়া মাদ্রাসার মাঠের আজকের আওয়ামীলীগের এই ত্রি-বার্ষিক সম্মেলন ইতিহাস হয়ে থাকবে। জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকতে আজ আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। এই ধারা বয়ে যেতে হবে এটায় আমাদের একটা চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা রাষ্ট্রভাষা থেকে বঙ্গবন্ধুর আর্দশে এ দেশ আজ স্বাধীন। যার ফলশ্র“তিতে শেখ হাসিনা আজ দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। দেশ আজ উন্নয়ন অভিযাত্রা চলছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বলেন, এই আলীয়া মাদ্রাসা মাঠে বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিয়ে ছিলেন আর দেশে ফিরে প্রথম এ মাঠে ভাষণ দিয়ে ছিলেন। তিনি বলেন, তৎকালীন আওয়ামীলীগের কঠিন সময়ে জীবন বাজি রেখে এই সিলেটে সংগ্রাম করে গেছি। তার জন্য ১৭ মাস কারাগারে থাকতে হয়েছে। তখন ঘরে বসে থাকিনি। তিনি বলেন, ২০২০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১শ’ বছর পূর্তি পালন করা হবে। তাই শেখ হাসিনার উন্নয়ন কাজ করে যেতে হবে।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, সিলেটের সম্মেলনে আমার দৃষ্টি অগোচর করেছে শৃংখলার অভাব। আমি সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় সম্মেলনে গিয়েছি কিন্তু এরকম অশৃঙ্খলা দেখিনি। এ সময় তিনি নেতাকর্মীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ব্যক্তির নামে শ্লোগান দিয়ে কোনো লাভ হবে না। শ্লোগান দিবেন আমার নেত্রীর নামে। আওয়ামী লীগ আজ সারা বিশ্বে সুনাম কুঁড়িয়ে আনছে। শেখ হাসিনার সরকার উন্নয়নের সরকার, শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে একটি আধুনিক রোল মডেল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছেন। আওয়ামী লীগে কোনো অনুপ্রবেশকারীদের ঠাঁই নেই।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন বলেছেন, বিএনপি ক্ষমতায় আসতে চায়। কিন্তু তারা চোরের পার্টি, লুটপাটের পার্টি। এই চোরের পার্টির নেতা হচ্ছে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দেশে দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করেছেন। কোন দুর্নীতিবাজ এ দেশে ঠাঁই পাবে না। তাই দুর্নীতিবাজ তারেক জিয়া দেশে ক্ষমতায় আসতে পারবে না।