আফতাব চৌধুরী
বিভিন্ন ধর্মে, প্রতিবন্ধকতাকে পাপের ফল অথবা পূর্বজন্মের কর্মফল হিসাবে দেখানো হয়েছে। আধুনিক সভ্যতার যুগেও প্রতিবন্ধীদের সম্পর্কে আমাদের দেশে অসম্মানজনক ধ্যান-ধারণা চলে আসছে। প্রতিবন্ধকতা-যুক্ত ব্যক্তিরা যুগ যুগ ধরে সমাজের কাছে অনুকম্পা ও করুণার পাত্র হয়ে থেকেছেন। তাদের অবস্থান হয়েছে সমাজের প্রান্তিকতম স্থানে। তাদের অধিকার হয়েছে উপেক্ষিত। জীবনের ন্যুনতম অধিকারগুলো থেকেও তারা যুগ যুগ ধরে বঞ্চিত হয়ে এসেছেন। সেই বঞ্চনার ইতিহাস আজও সমানভাবে প্রবাহিত হয়ে চলেছে।
আমাদের সমাজের এই মানসিকতা বা ধারণা বহু বছর আগেড় থেকেই চলে আসছে। প্রতিবন্ধীদের সমাজে বিভিন্নভাবে অপমানিত ও নিগৃহীত হতে হয়। প্রতিবন্ধী ব্যক্তি যদি মহিলা হন তাহলে তার অবস্থা আরও করুণ। জন্মগতভাবে কিছু মানুষ প্রতিবন্ধকতা নিয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তারা সবাই আমাদের সমাজের অংশ। প্রতিবন্ধকতার কারণে তারা অনেক সময় অবজ্ঞা ও করুণার পাত্র হয়ে উঠেন, যা নিতান্তই অমানবিক। যে সমাজ তাদের অবহেলার চোখে দেখে সে সমাজ প্রতিবন্ধী।
আমাদের সমাজে প্রতিবন্ধীদের অবস্থা কেমন এবং প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে রাষ্ট্র তথা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি কী হওয়া উচিত তা আমাদের বিশ্লেষণ করতে হবে দয়া-দক্ষিণা নয় বরং অধিকারের ভিত্তিতে। প্রতিবন্ধীরা সমাজে বেঁচে থাকতে হলে তাদের অধিকারের জন্য লড়াই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। সমাজে উঁচু মাথা নিয়ে প্রতিবন্ধীদের বেঁচে থাকার প্রধান এবং একমাত্র হাতিয়ার হল ‘শিক্ষা। শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে পারলেই প্রতিবন্ধীরা সমাজের বিশিষ্ট নাগরিক হতে পারবে। আমাদের সরকার প্রতিবন্ধীদের জন্য আইন প্রণয়ন করেছে। অনেক সুযোগ-সুবিধার কথাও উল্লেখ করেছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় হল প্রতিবন্ধীরা সেই সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধীদের যা সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার কথা আইনে উল্লেখ করা আছে, তা প্রতিবন্ধীদের কাছে স্বপ্নসম। সরকার শুধু বড় বড় ভাষণ দিয়েই ভবেন কাজ শেষ, প্রকৃত প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের কথা কেউই ভাবেন না। ‘জরমযঃ ঃড় ঊফঁপধঃরড়হ অপঃ’-এ প্রতিবন্ধীদের জন্য অনেক সুযোগ-সুবিধার কথা বলা হয়েছে কিন্তু যখন বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হয় তখন দেখা যায় যে, প্রতিবন্ধীদের জন্য কোনো প্রকৃত শিক্ষা কাঠামোর ব্যবস্থা নেই। প্রতিবন্ধীদের বেশির ভাগই গরিব ঘরের সন্তান। তারা যদি শিক্ষাঙ্গনে গিয়ে সব সুযোগ-সুবিধা ঠিকভাবে না-পায় তাহলে পড়াশোনার ব্যাপারে তারা অগ্রসর হতে পারবেনা।
তাই প্রতিবন্ধীরা শিক্ষাঙ্গনে যেন সঠিকভাবে সব সুযোগ-সুবিধা পায় তার ব্যাবস্থা করতে হবে। প্রতিবন্ধীরা আমাদের সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তাদের মধ্যেও কোনো না-কোনো বিষয়ে প্রতিভা রয়েছে যা আমরা স্টিফেন হকিং, হেলেন কেলার, এডিসন প্রমুখকে দেখলেই বুঝতে পারি। সরকার যদি একটু মানবিকতার দৃষ্টিতে প্রতিবন্ধীদের কথা ভাবেন তাহলে তারা অনেক দুর অগ্রসর হতে পারবে। সবচেয়ে বড়ো কথা হল প্রতিবন্ধীদের কী কী অধিকার আছে এই ব্যাপারে তারা কেউই অবগত নয়। প্রতিবন্ধীদের জন্য আইন আছে এই বলে বসে থাকলে চলবে না। তা যদি ঠিকঠাক ব্যবহার না করা হয় তাহলে এই আইনের কোনো গুরুত্ব নেই। শিক্ষাঙ্গনে গিয়ে প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীরা সঠিকভাবে বৃত্তি পাচ্ছে না। নতুন সরকার আসে, পুরাতন সরকার চলে যায়। কিন্তু প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের কথা ভাবার সময় কারো নেই।
প্রতিবন্ধীদের যদি উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করা যায় তাহলে সামাজিক উন্নয়নে তাদের অবদান যেমন বাড়বে, তেমনি উন্নয়নের গতিও বৃদ্ধি পাবে। কীভাবে তারা বিনা খরচে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে সেই বিষয়টা সরকারকেই ভাবতে হবে। বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশক থেকেই প্রতিবন্ধকতা যুক্ত ব্যক্তিরা নিজ নিজ অধিকারের প্রশ্নে সরব হতে থাকেন। অবশেষে ১৯৭৬ সালে জাতিসংঘ ১৯৮১ সালকে ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবন্ধকতা বর্ষ’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘ থেকে প্রতিবন্ধীদের জন্য সুন্দর একটি নাম দেওয়া হয়েছে। আজকাল আমরা তাদের প্রতিবন্ধী বলি না। সুন্দর নামটি হল- উরভভবৎহঃষু অনষবফ চবৎংড়হ বাংলায় তরজমা করলে দাঁড়ায় ‘ভিন্ন রূপে সক্ষম’। জাতিসংঘের দাবি সনদে এও বলা হয়েছে যে, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো বিষয়ে প্রতিবন্ধকতা যুক্ত ব্যক্তিদের সম্পূর্ণ অধিকার থাকবে।
শিক্ষার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে যাতে প্রতিবন্ধীকতা যুক্ত ব্যক্তিরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না-হয়। বাংলাদেশ সরকার প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নের জন্য যে নতুন খসড়া তৈরি করেন তাতেও প্রতিবন্ধীদের সব অধিকারের কথা উল্লেখ করা হয়নি। ‘ঢ়বৎ-ংড়হং রিঃয উরংধনরষরঃরবং অপঃ’-আঠারো বৎসর পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিল। অথচ আজ এত বছর পরও উচ্চশিক্ষা দূর অস্ত। পচিশ থেকে ত্রিশ শতাংশ শিশু নিরক্ষর। যারা স্কুলে যায় তাদের মধ্যেও প্রাক-প্রাথমিক স্তর উত্তীর্ণের সংখ্যা স্বল্প। সর্বশিক্ষা অভিযানে যে গুরুত্ব দেবার ঘোষণা ছিল কার্যত তার কিছুই হয়নি। ফলে অবস্থা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই। অস্বীকার করা যাবে না মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী এ ব্যাপারে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু এ ব্যাপারে সকল মহলের সহযোগিতা প্রয়োজন।
শিক্ষার বাণিজ্যকরণের ফলে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার অঙ্গনে প্রবেশের দরজা প্রায় বন্ধ। শিক্ষার অধিকার আইনে ছয় থেকে চৌদ্দ বছরের প্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য পঁচিশ শতাংশ সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। স্কুলগুলোতে প্রতিবন্ধীদের উপযোগী পরিকাঠামোর অভাবে তা নিতান্ত কথার কথাই রয়ে গেল। ছয় বছরের নিচের শিশুদের এই আইনের আওতায় আনা হয়নি। ফলে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত শিশুরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তির ক্ষেত্রেও বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। তাই সব প্রতিবন্ধীদের ঐক্যবদ্ধভাবে শিক্ষার অধিকার আদায়ের আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পরতে হবে। আমাদের সমাজে যে বুদ্ধিজীবী মহল আছে তারাও যদি প্রতিবন্ধীদের নিয়ে একটু ভাবে তাহলে প্রতিবন্ধীদের উন্নয়ন সম্ভব।
প্রতিবন্ধীরা স্বচ্ছল হওয়ার জন্য বা উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ার জন্য সরকার নামে একটা গরপৎড় ঋরহধহপব ঝপযবসব তৈরি করেছেন এই স্কিমের আওতায় প্রতিবন্ধীদের ঋণ দেওয়া হয়। কৃষি, বাণিজ্য কুটির শিল্প এইসব বিষয়ে এবং এই স্কিমের আওতায় প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীরা বৃত্তি পেয়ে উপকৃত হচ্ছে। যেসব প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীরা আর্থিকভাবে দুর্বল তারাও ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নিয়ে দেশে ও বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছে। যারা গবেষণা করতে ইচ্ছুক তাদের জন্যও নামে একটি প্রকল্প তৈরি করা হয়েছে এই প্রকল্পগুলো সম্পর্কে যদি সব প্রতিবন্ধী ছাত্রছাত্রীদের অবগত করা হয় তাহলে তারা উচ্চ শিক্ষা গ্রহণে অগ্রসর হবে। প্রতিবন্ধীদের জন্য যেসব প্রকল্প প্রণয়ন করা হচ্ছে তা তৃণমুল স্তরে পৌঁছাচ্ছে না।
সমাজের সকল অংশের মানুষের জন্য আমাদের সংবিধানের জন্য যে মৌলিক নীতিগুলো অর্থাৎ স্বাধীনতা, ন্যায়, সমতা ও মর্যাদাপূর্ণ জীবনের জন্য যে বিবিধ ব্যবস্থা রয়েছে তা প্রতিবন্ধীদের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। কিন্তু যখন প্রতিবন্ধীরা এই অধিকারগুলো প্রয়োগ করতে যায় তখন দেখা যায় তাদের কোনো অধিকারই নেই। আমাদের এটা বুঝতে হবে যে প্রতিবন্ধী মানুষটি তো আমাদেরই স্বজন। আমার পরিবারের, আমাদের দেশের তাদের উন্নয়নের অধিকার আদায়ের লড়াইতে সকলের অংশগ্রহণ একান্ত আবশ্যক। অবজ্ঞার তাপে শুঙ্ক নিরানন্দ সেই মরুভূমি থেকে তাদের তুলে এনে তাদের জীবনের শরিক হয়ে পথ চলা শুরু করে পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। প্রতিবন্ধীদের উন্নয়নে অনুকম্পার প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু ভালোবাসা ও উৎসাহ।
একজন প্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে পারে ভালোবাসা ও উৎসাহ। তারা অবহেলার পাত্র নয়, তারা আমাদের সমাজের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। যে সম্পদকে আমরা উপযুক্তভাবে কাজে লাগিয়ে সমাজকে সমৃদ্ধশালী করতে পারব। সবচেয়ে বড় কথা হল প্রথমে বিকলাঙ্গ হওয়ার কারণগুলোকে অনুসন্ধান করে সরকার পক্ষ এবং জনগণকে এর প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিতে হবে। প্রতিবন্ধীদের সমস্যা সম্পর্কিত সমস্যার মুল বিষয়গুলো উপলব্ধি করা এবং সমাজ ও তার কাঠামোর সাথে যুক্ত করে দেখা। সব প্রতিবন্ধীদের ভালোবাসা ও উৎসাহ সহকারে শিক্ষার আলোয় আলোকিত হতে হলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে যেতে হবে এবং সকল প্রতিবন্ধীদের বুঝতে হবে যে তারা পিছিয়ে নয়, এগিয়ে যাচ্ছে। ভবিষ্যাতেও এগিয়ে যাবে।
লেখক : সাংবাদিক-কলামিস্ট। সদস্য- জেলা সমাজকল্যাণ পরিষদ, সিলেট।