বিজয়ের মাস

57

কাজিরবাজার ডেস্ক :
‘পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত/ঘোষণার ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলে/নতুন নিশান উড়িয়ে/ দামামা বাজিয়ে দিগি¦দিক/এই বাংলায় তোমাকে আসতেই হবে হে স্বাধীনতা।’
বছর ঘুরে আবার এসেছে বাঙালির অহঙ্কার বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। হাজার বছরের ইতিহাসে বাঙালি তার আত্মপরিচয়, স্বাধীনতা ও স্বাধীন পতাকা পেয়েছিল যে মাসে, তার নাম ডিসেম্বর। বিজয়ের ৪৮ বছর। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের এ বিজয় শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এর পেছনে রয়েছে লাখ লাখ মানুষের রক্ত ও মহান আত্মত্যাগ।
মুক্তিপাগল বাঙালি জাতি এক সাগর রক্তের বিনিময়ে এই ডিসেম্বরেই ছিনিয়ে আনে হাজারও বছরের লালিত স্বপ্ন প্রিয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মহান বিজয়। বিশ্ব মানচিত্রে স্থান পায় লাল-সবুজের রক্তস্নাত স্বাধীন পতাকা, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাই ডিসেম্বর হচ্ছে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন জাতি ও ভূখন্ডের স্বীকৃতি আদায়ের মাস। ২৪ বছরের পাকিস্তানী শাসন-শোষণকে পদানত করে ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বাংলার দামাল সন্তানরা ছিনিয়ে আনা বীরত্বগাঁথা বিজয় অর্জনের মাস।
৪৮ বছর আগের ২ ডিসেম্বর। একাত্তরে বিজয়ের মাস ডিসেম্বর যতই এগিয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের বিজয় যেন ততই এগিয়ে আসতে থাকে। কিন্তু পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে চরম নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতায় মেতে ওঠে হিংগ্র পাক হানাদার বাহিনীরা। নবেম্বরের শেষ সপ্তাহের দিকেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান জেনারেল নিয়াজি তার রাজাকার, আল-বদর ও সেনাবাহিনীকে দেশের চারিদিকে ছড়িয়ে নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ চালাত। কিন্তু তখনও হানাদার বাহিনী বুঝতে পারেনি তাদের পতন অত্যাসন্ন।
একাত্তরের রক্তক্ষরা এই দিনে গেরিলা আক্রমণ থেকে সম্মুখযুদ্ধের গতি বাড়ে। অপ্রতিরোধ্য বাঙালীর বিজয়রথে পাকবাহিনীর নিষ্ঠুর সব পরিকল্পনা ভেস্তে যেতে থাকে। পরাজয়ের আভাস পেয়ে তৎকালীন পাকিস্তানী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এদিন মরিয়া হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে একটি চিঠি পাঠান। ইয়াহিয়া তার চিঠিতে যুদ্ধকালীন সাহায্যের আশায় ১৯৫৯ সালের পাক-মার্কিন দ্বিপক্ষীয় চুক্তির এক অনুচ্ছেদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেন। সীমান্ত এলাকায় পাক জান্তারা সমরসজ্জা বৃদ্ধি করায় ভারতও তা মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি নেয়।
ডিসেম্বরের প্রথম থেকেই ত্রিমুখী যুদ্ধের আশঙ্কা ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠতে থাকে। এসব দেখেশুনে ভারত সরকার বুঝেছিল, পাকিস্তান যুদ্ধ করবেই। ভারত তখন যে রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টা বা আশা একেবারে ছেড়ে দিয়েছে তা নয়। কিন্তু রাজনৈতিক সমাধানের সঙ্গে সঙ্গে ভারত সামরিক প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। পশ্চিমের প্রস্তুতি দেখে এবং নাশকতামূলক কাজের লোক ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভারত মোটামুটি পরিষ্কার বুঝে ফেলে পাকিস্তান রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যাবে না, বরং লড়াই-ই করবে। তাই তখন থেকে ভারতের প্রস্তুতিও জোরদার হয়েছিল।
অন্যদিকে বীর বাঙালির গেরিলা আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে পাক সৈন্যরা। যতই সময় গড়াচ্ছিল গেরিলা আক্রমণ ততই প্রবল হতে থাকে। পাক সেনাদের হাতে তখনও আধুনিক অস্ত্র-গোলাবারুদ মজুদ থাকায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রবল গেরিলা আক্রমণের মাধ্যমে পরাস্ত করতে থাকে। মুক্তিপাগল বাঙালীর অকুতোভয় লড়াইয়ে পাক হানাদারদের রাতে চলাফেরাও কঠিন হয়ে পড়ে। নিয়াজী বুঝতে পারে, এবার বড় ধরনের কিছু করতে না পারলেই নয়। তাই মার্কিন সাহায্য নিশ্চিত, নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি, রাজাকার-আলবদর-আলশামসসহ এ দেশীয় স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিকে নিয়ে ব্যাপক নিধনযজ্ঞ চালানোর জঘন্য পরিকল্পনা আঁটতে থাকে কসাই নিয়াজী।
বর্ণাঢ্য আয়োজনে রবিবার থেকে ডিসেম্বর মাসব্যাপী বিজয় উৎসব কর্মসূচী পালন শুরু হয়েছে। সত্যিই এক অন্যরকম পরিবেশে এবার বিজয়ের মাস পালন করছে বাঙালি জাতি। বিজয়ের মাস ডিসেম্বরের প্রথম প্রহর রাত ১২টা ১ মিনিটে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধু জাদুঘরের সামনে মোমবাতি প্রজ্ব¡ালন, শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে বিভিন্ন সংগঠন। ওই সময় ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তনেও পুষ্পস্তবক অর্পণ করে বীর শহীদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করেন অনেকেই।
২০১৪ সাল থেকে দেশের মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনগুলো প্রতিবছর দিনটিকে মুক্তিযোদ্ধা দিবস হিসেবে পালন করে থাকে। এবারও তারা দিনটি পালনে বিস্তারিত কর্মসূচী পালন করেছে। বিজয়ের মাসের প্রথমদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে বর্ণাঢ্য ‘বিজয় র‌্যালি’ বের করা হয়। বিজয় র‌্যালি শেষে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের স্বাধীনতা চত্বরে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সামাদ বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ব্যবসা, বাণিজ্য, অর্থনীতিসহ সকল ক্ষেত্রে অসাধারণ অগ্রগতি অর্জন করেছে। প্রধানমন্ত্রীর হাতকে আরও শক্তিশালী করে উন্নয়নের এই ধারা অব্যাহত রাখার জন্য তরুণ প্রজন্মকে শপথ নিতে হবে। আলোচনা পর্বের আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সঙ্গীত বিভাগের উদ্যোগে জাতীয় সঙ্গীত ও দেশাত্মবোধক গান পরিবেশিত হয়।
বঙ্গবন্ধু পরিষদের উদ্যোগে সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে মাসব্যাপী কর্মসূচীর উদ্বোধন ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। পদক্ষেপ বাংলাদেশ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হাকিম চত্বরে জাতীয় সংগঠন ও শিল্পীদের অংশগ্রহণে ‘বিজয় মাসের প্রথম প্রভাত’ শীর্ষক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এতে সভাপতিত্ব করেন বাদল চৌধুরী। এফ এফ ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে রবিবার সকালে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সামনে থেকে একটি বর্ণাঢ্য র‌্যালি বের করা হয়। র‌্যালিটি ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের শিখা চিরন্তনে গিয়ে শেষ হয়। এফ এফ ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান এস এম জাহাঙ্গীর আলমের সভাপতিত্বে র‌্যালি পূর্ব সমাবেশে বক্তব্য রাখেন, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক এডভোকেট মৃণাল কান্তি দাস এমপি প্রমুখ।