কাজিরবাজার ডেস্ক :
শুধু যুবলীগ কিংবা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নয়, আসন্ন কাউন্সিলে মূল দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেও নাটকীয় পরিবর্তন আসছে। যেসব নেতার বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভূমি দখল ও মাদক বাণিজ্যসহ নানা অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে এবং যারা দলের সাংগঠনিক কার্যক্রম থেকে দূরে সরে গিয়ে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন তাদের সবাইকে কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ দেওয়া হবে। সংগঠনের নেতৃত্ব নির্বাচনে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা এমন দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করায় আওয়ামী লীগ এবং এর বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের ভেতরে কেন্দ্রীয় নেতাদের অপকর্ম ফাঁসের গোপন প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। যা ভালো চোখে দেখছেন না তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
তাদের ভাষ্য, দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের কুকীর্তি যেভাবে ফাঁস হচ্ছে তাতে যেমন দলের ইমেজ ক্ষুণœ হচ্ছে, তেমনি মাঠপর্যায়ে নেতাকর্মীদের সামাজিকভাবে বিব্রত হতে হচ্ছে। এ অবস্থা চলমান থাকলে আগামীতে দলীয় কর্মী হিসেবে পরিচয় দিতেও অনেকে কুণ্ঠা বোধ করবেন। দুর্নীতিবাজ নেতাদের দলীয় নেতৃত্ব থেকে পুরোপুরি সরিয়ে দেওয়া হলেও এ নিয়ে যেন কাদা ছোড়াছুড়ি না হয় এমনটাই চাইছেন তৃণমূলের নেতাকর্মীরা।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, কেন্দ্রীয় নেতাদের সন্ত্রাস-দুর্নীতির তথ্য ফাঁস করার ক্ষেত্রে নতুন করে যারা ওই পদপ্রত্যাশী তারা ও তাদের সহযোগীরাই মুখ্য ভূমিকা রাখছেন। এছাড়া দুর্নীতিবাজ নেতার কারণে যেসব কর্মী কিংবা সাধারণ মানুষ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারাও এ ব্যাপারে তৎপর হয়ে উঠেছেন। এ কাজে অনেকে গোপনে গণমাধ্যমকর্মীদের ব্যবহার করছেন। আবার কেউ কেউ নিজেকে আড়াল রেখে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), এসবি (স্পেশাল ব্রাঞ্চ) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দাসহ (এনএসআই) বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার হাতে নেতাদের অপকর্মের তথ্য তুলে দিচ্ছেন। ফেক আইডি খুলে প্রভাবশালী নেতাদের কুকীর্তির তথ্য-প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ারও বেশকিছু ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ আওয়ামী লীগ নেতাদের দুর্নীতি খুঁজতে প্রধানমন্ত্রীর যে বিশেষ সেল কাজ করছে অনেকে সেখানেও তথ্য সরবরাহ করছেন। এমনকি কেন্দ্রীয় নেতাদের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির ফিরিস্তি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে বলেও তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এতদিন যেসব নেতার বিরুদ্ধে কেউ ‘টুঁ’ শব্দটুকু করার সাহস পেত না, সেই ক্ষমতাধর যুবলীগ চেয়ারম্যান (সদ্য অব্যাহতিপ্রাপ্ত) ওমর ফারুক চৌধুরী, যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ ফজলুর রহমান মারুফ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সভাপতি (বহিষ্কৃত) ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, সাংগঠনিক সম্পাদক (বহিষ্কৃত) খালেদ মাহমুদ ভুইয়া ও দপ্তর সম্পাদক (বহিষ্কৃত) কাজী আনিসুর রহমানের অনিয়ম-দুর্নীতির নানা তথ্য এখন অনেকে যেচে দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার হাতে তুলে দিয়েছেন। একই সঙ্গে তাদের বেশির ভাগ অপকর্মের সুনির্দিষ্ট প্রমাণও তারা সরবরাহ করেছেন।
এছাড়া স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোল্লা মো. আবু কাওসারের বিরুদ্ধে ক্যাসিনোকান্ডে সংশ্লিষ্টতা, চলমান শুদ্ধি অভিযানে অবৈধ অস্ত্রসহ গ্রেফতার হওয়া ভয়াবহ দুর্নীতিবাজ যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও গণপূর্ত বিভাগে একচেটিয়া কাজের দরপত্র নিয়ন্ত্রণে তাকে সহযোগিতার নানা তথ্য একটি মহল গোয়েন্দাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবক লীগের এই শীর্ষ নেতা তার অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ স্ত্রী-সন্তান ও ঘনিষ্ঠজনদের নামে কোথায় কীভাবে গচ্ছিত রেখেছেন এবং এর কতটা বিদেশে পাচার করেছেন সে তথ্যও প্রধানমন্ত্রীর মনিটরিং সেলে সরবরাহ করা হয়েছে বলে জানা গেছে।
স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক পংকজ দেবনাথের বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতি, মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থীকে বাদ দিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থীকে বিজয়ী করে দলীয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, মেহেদিগঞ্জের ধুলিয়ামধ্যচর-মাসকাট স্পট থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন এবং হুন্ডি, মানিলন্ডারিংয়ের মাধ্যমে দেশের বাইরে শত শত কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া রাজধানীর উত্তরা ও ধানমন্ডিতে বিলাসবহুল বাড়ি, অভিজাত এলাকায় নামে-বেনামে একাধিক প্লট, ফ্ল্যাট ও গার্মেন্টস রয়েছে বলে বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ জমা পড়েছে।
এদিকে স্বেচ্ছাসেবক লীগের জাতীয় সম্মেলনের দিন ঘোষণার পর দলের সহ সভাপতি মতিউর রহমান ওরফে মতি ও আবদুর রাজ্জাক, সাংগঠনিক সম্পাদক আবদুল আলিম, ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি মোবাশ্বের হাসান চৌধুরী, একই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ফরিদুর রহমান খান, ঢাকা দক্ষিণ স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি দেবাশীষ বিশ্বাস ও সাধারণ সম্পাদক আরিফুর রহমানের বেশকিছু অপকর্মের ফিরিস্তি বিভিন্ন মাধ্যমে গোয়েন্দাদের হস্তগত হয়েছে। যা তারা এখন যাচাই-বাছাই করে দেখছে। এর মধ্যে কিছু অপকর্মের সত্যতা মিলেছে বলে দায়িত্বশীল একটি গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, নেতাদের অপকর্মের চিত্র তুলে ধরার ক্ষেত্রে এ সংক্রান্ত মামলার নথিপত্র, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের নাম-ঠিকানা-টেলিফোন নম্বর, এ সংক্রান্ত স্থিরচিত্র ও ভিডিও ফুটেজসহ আনুষঙ্গিক অন্যান্য প্রমাণ সরবরাহ করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তথ্য সরবরাহকারী নিজের পরিচয় গোপন রেখেছেন। এমনকি কোনোভাবে কেউ যাতে তাকে চিহ্নিত করতে না পারে সে ব্যাপারেও যথেষ্ট সতর্ক থেকেছেন। বিতর্কিত এসব নেতা আগামী কাউন্সিলে ফের গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত হলে তারা আরও ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন- এ আশঙ্কায় তথ্য সরবরাহকারীরা নিজেদের আড়াল রেখেছেন বলে জানিয়েছেন।
দুদকের উপপরিচালক পদমর্যদার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ইদানীং আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় নেতাদের নানা অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য যেভাবে তাদের দপ্তরে আসছে, তাতে তারাই রীতিমতো বিস্মিত। অধিকাংশ অভিযোগের সঙ্গে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকায় এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে খুব বেশি সময় লাগবে না বলে মনে করেন এই দুদক কর্মকর্তা।
কাউন্সিল ঘিরে কেন্দ্রীয় নেতাদের অপকর্ম ফাঁসের গোপন পাল্লার বিষয়টি স্বীকার করে জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার মাঠপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ের ভোটের আগেও দলীয় মনোনয়ন পাওয়া নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। তবে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল ঘিরে এবার যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে তা কিছুটা ব্যতিক্রম।
মাঠপর্যায়ের ওই গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ধারণা, শুধু আওয়ামী লীগের কাউন্সিল নয়, এ তৎপরতা শুরুর পেছনে শুদ্ধি অভিযানের ব্যাপক প্রভাব রয়েছে। দলের ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতারা যারা এত দিন নানা কারণে কোণঠাসা ছিলেন, শুদ্ধি অভিযান শুরুর পর তারা এখন অনেকেই দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি পাওয়ার ব্যাপারে আশাবাদী। বিশেষ করে যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবকলীগের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতাকে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর দুর্নীতিগ্রস্ত নেতাদের বিরুদ্ধে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে অটল থাকার বিষয়ে ত্যাগী নেতারা আস্থাশীল হয়ে উঠেছেন। আর এ কারণেই তারা এখন দলের দুর্নীতিবাজ কেন্দ্রীয় নেতাদের অপকর্মের চিত্র তুলে ধরতে তৎপর বলে মনে করছেন গোয়েন্দারা।
নেতাদের নানা অপকর্ম-দুর্নীতির তথ্য পাওয়ার কথা খোদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরও স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ নেতাদের দুর্নীতি খুঁজতে গোয়েন্দা সংস্থার পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সেল মাঠে কাজ করছে। নেতাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ আসছে। দুর্নীতির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী ইনফরমেশন পাচ্ছেন। এ তথ্য শুধু দলের নেতারা দিচ্ছেন, তা নয়। এখানে গোয়েন্দা সংস্থা ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সেল কাজ করছে। তারাও বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করছে।’ যত বড় নেতাই হোক, প্রভাবশালী হোক, দলের ভেতরে যারা অপকর্মের সঙ্গে জড়িত থাকবে, কোনো অবস্থাতেই তাদের ছাড় দেয়া হবে না। আগামী কাউন্সিলে বিতর্কিত কাউকে নেতৃত্ব না দেয়ার ব্যাপারে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা দৃঢ় প্রত্যয়ী- যোগ করেন ওবায়দুল কাদের।
এদিকে দলের নীতিনির্ধারকদের অনেকেরই আশঙ্কা, একজনের বিরুদ্ধে অপরজনের অভিযোগ চালাচালির বিষয়টি একপর্যায়ে সংঘাত-সংঘর্ষে রূপ নেবে। এছাড়া গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের কুকীর্তির ফিরিস্তি তুলে ধরে প্রতিপক্ষের রাজনীতিকরা ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সামাজিকভাবে ঘায়েল করার সুযোগ পাবে। যা একপর্যায়ে সামাল দেয়া কঠিন হবে।
তারা মনে করেন, গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের সমন্বয়ে মূল দলের পাশাপাশি সহযোগী সংগঠনের জন্য পৃথক ‘অভিযোগ সেল’ গঠন করে নেতাদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ সংগ্রহ করা যায় কিনা তা ভেবে দেখা দরকার। এতে তদন্তসাপেক্ষে বিতর্কিত নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলেও রাজনৈতিক অঙ্গনে এর নেতিবাচক প্রভাব কম পড়বে। এছাড়া ভুয়া অভিযোগের কারণে গুরুত্বপূর্ণ নেতা সামাজিক মর্যাদা লুণ্ঠিত হওয়া থেকে রক্ষা পাবেন।