কাজিরবাজার ডেস্ক :
সারাদেশের এমপিওভুক্ত মাদ্রাসার শিক্ষক-কর্মচারীদের শতভাগ বেতন সরকার দিলেও অধিকাংশতেই চলছে সুপার, প্রিন্সিপালসহ গবর্নিং বডির স্বেচ্ছাচারিতা। সরকারের অধীনস্থ ১৬ হাজারেরও বেশি আলিয়া ও এবতেদায়ী মাদ্রাসার পৌনে দুই লাখ শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন দিলেও পরিচালনায় নেই সরকারের নিয়ন্ত্রণ। নেই জবাবদিহিতা। শক্ত নীতিমালা না থাকায় দুর্বল এক আদেশের ওপর ভর করে দায়সারাভাবে চলছে হাজার হাজার মাদ্রাসা। আর কওমি মাদ্রাসা চলছে ধর্মের নামে রাজনীতি করা কিছু ব্যক্তির ইচ্ছামতো। ফলে উন্নয়নের নামে অর্থ লোপাট, ধর্মীয় শিক্ষার জন্য অর্থ এনে আত্মসাত, নারী ও শিশু নির্যাতন, জামায়াতের রাজনীতিসহ নানা অপকর্মে জড়িত এর ব্যবস্থাপক ও শিক্ষকরা।
তবে খোদ অধ্যক্ষের নির্দেশে ফেনীর ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনাসহ মাদ্রাসায় একের পর এক ছাত্রীর যৌন হয়রানি ও শারীরিক নির্যাতনের প্রেক্ষাপটে নড়েচড়ে বসেছে শিক্ষা প্রশাসন। নারীর নিরাপত্তায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে সরকার নিয়ন্ত্রিত ও অধিভুক্ত সকল মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থাপনায়। দেশের প্রতিটি মাদ্রাসায় নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে নির্দেশনা পাঠিয়েছে মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড। ছাত্রীদের নিরাপত্তায় প্রত্যেক মাদ্রাসায় একজন করে নারী মেন্টর নিয়োগ হচ্ছে। যার নেতৃত্বে কাজ করবে পাঁচ সদস্যের কমিটি। এখন থেকে অধ্যক্ষসহ কোনও পুরুষ শিক্ষক কোনও ছাত্রীকে সরাসরি ডাকতে পারবেন না। প্রয়োজন থাকলে মেন্টর ও কমিটির মাধ্যমে ডাকতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মাদ্রাসায় ছাত্রীদের যৌন হয়রানি ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনায় প্রায়ই শোনা যায়। সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকা কওমি মাদ্রাসায় এমন ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটলেও সরকারী নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসায়ও অভিযোগের মাত্রা কম নয়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাদ্রাসায় অধ্যক্ষসহ শিক্ষকদের বিরুদ্ধেই আসে অভিযোগ। তবে এবার ফেনীর মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার নেতৃত্বে ছাত্রী নুসরাতকে যৌন হয়রানি ও নৃশংসভাবে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কিছু একটা করা প্রয়োজন। এমন প্রয়োজন থেকেই মাদ্রাসার বিষয়ে নতুন করে ভাবা হচ্ছে।
নুসরাত হত্যাকান্ডের পর দ্রুতই অধ্যক্ষসহ অন্য অপরাধীদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছিলেন মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান অধ্যাপক এ কে এম ছায়েফ উল্ল্যাহ। তখন তিনি বলেছিলেন, ‘মাদ্রাসা নিয়ে অনেক অভিযোগ আছে এ কথা সত্য। তবে মাদ্রাসায় দুর্নীতি অনিয়মের বিষয়টি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এলাকাভিত্তিক। যেমন গত কয়েকমাস ধরে যেসব অভিযোগ সুপার ও প্রিন্সিপালসহ গভর্ণিং বডির সদস্যদের বিরুদ্ধে আসছে তার অধিকাংশই উত্তরাঞ্চল বিশেষত চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, গাইবান্ধা, রংপুর, বগুড়াসহ নির্দিষ্ট কয়েকটি এলাকার। অন্যান্য এলাকায় অভিযোগ থাকলেও তা কম। সরকার এখন স্বচ্ছতার বিষয়টি কঠোরভাবে নিশ্চিত করছে। আমরা সব সময় নজরদারির মধ্যে রাখছি। তারপরেও সম্ভব হয় না। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আসলে বেসরকারী এসব প্রতিষ্ঠানের গভর্ণিং বডি বিধান অনুসারে এতই শক্তিশালী যে তারা ইচ্ছেমতো অনেক কিছুই করতে চায়।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান খুব ভাল চললেও কিছু প্রতিষ্ঠানের গভর্ণিং বডির সদস্যরা তাদের পদটিকে মনে করেন একটি চাকরি। এমনও অভিযোগ পাই, যেখানে সকালে সুপারদের কাছে সকাল বেলা এসে গভর্ণিং বডির কোন কোন সদস্য বলছেন, ‘সুপার বাজারে যাইতে হবে।’ মানে হলো তিনি বাজারে যাবেন তো মাদ্রাসা ফান্ড থেকে টাকা দেন! তবে এ ধরনের চিত্র খুব অল্প প্রতিষ্ঠানে বলেই দাবি সাবেক চেয়ারম্যানের’।
সাবেক এ চেয়ারম্যানের কথাতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে মাদ্রাসা পরিচালনার সঙ্গে জড়িতদের একচ্ছত্র আধিপত্যের কথা। যেখানে সরকার সঠিকভাবে সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মতো কাজ করতে পারছে না। সম্প্রতি মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদফতরের এক কর্মকর্তা গিয়েছিলেন চট্টগ্রামের শীতাকু- উপজেলার এক মাদ্রাসার অধিয়ম দুর্নীতির তদন্তে। এমপিওভুক্ত মাদ্রাসা হলেও সেখানে ছিল নারী নির্যাতনের নানা অভিযোগ।
কিন্তু ভবনের শিক্ষকদের কক্ষে তথ্য সংগ্রহের পর ভবনের ভেতরে যেতে চাইলে বলা হয় ‘ওখানে যাওয়া যাবে না’। কেন জানতে চাইলে দুই কর্মকর্তাকে এক শিক্ষার্থী জানান, ওখানে গেলে আপনাদের সমস্যা হবে।’ এই কর্মকর্তাদের একজন বৃহস্পতিবার বলেন, আসলে আমাদের তদন্তের সময় এক ছাত্র জানায় স্যার এ প্রতিষ্ঠানটি শিবিরের ক্যাডারদের নিয়ন্ত্রণে চলে। শিবিরের অস্ত্রও থাকে। তাই ভয়ে আর ভেতরের কক্ষে তখন যাইনি’। এক প্রশ্নে এ কর্মকর্তা বলেন, আসলে কেবল এ প্রতিষ্ঠানই নয়। অধিকাংশ মাদ্রাসাতেই জামায়াত-শিবিরের প্রভাব আছে। তারপর ভাল তদারকি নেই নানা কারণেই। এই জায়গাটায় কাজ করা কঠিন হবে তবে পদক্ষেপ নিতে হবে।
দাখিল, আলিম, ফাজিল, কামিল মাদ্রাসার সুপার, প্রিন্সিপালসহ গভর্ণিং বডির সদস্যদের কাছে রীতিমতো অসহায় হয়ে পড়া সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ‘আল্লাহর পরেই যেন তাদের ক্ষমতা। অনেক প্রতিষ্ঠান সত্যিকারের শিক্ষা দিলেও বহু প্রতিষ্ঠানেই এদের কারণে প্রতারিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আবার অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গেলেও জামায়াত-শিবিরসহ উগ্রবাদী গোষ্ঠীকে দিয়ে অপপ্রচার চালানো হয় যে, সরকার মাদ্রাসার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে’।
জানা গেছে, এই মুহূর্তে মাদ্রাসা বোর্ডের অধীনে পরিচালিত মাদ্রাসার সংখ্যা ১৬ হাজারের ওপরে। এরমধ্যে ইবতেদায়ী, দাখিল, আলিম, ফাজিল ও কামিল মাদ্রাসা আছে। যেখানে শিক্ষার্থী আছে অর্ধকোটিরও বেশি। এমপিওভুক্ত শিক্ষক আছেন প্রায় এক লাখ ৩০ হাজার। কর্মচারী আছেন ৫০ হাজারের কাছাকাছি। এর বাইরেরও নন-এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী আছেন। দাখিল বা মাধ্যমিক স্তরের প্রধানকে বলা হয় সুপার। আর আলিম বা উচ্চ মাধ্যমিক স্তরের প্রধানকে বলা হয় প্রিন্সিপাল।
প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীর ১০০ ভাগ বেতনই দিচ্ছে সরকার। দেয়া হচ্ছে অন্যান্য ভাতাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা। এর সঙ্গে গতবছর যুক্ত হয়েছে বহুযুগের দাবি অনুসারে শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া ও উৎসব ভাতা বৃদ্ধির সরকারী ঘোষণা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শতভাগ বেতন, সুয়োগ-সুবিধা দেয়া হলেও পরিচালনায় সরকারের নেই তেমন কোন নিয়ন্ত্রণ। কার্যকর নেই কোন নীতিমালা। ১৯৬১ সালের ঢাকা জেলা প্রশাসকের আদেশের ওপর ভর করে দায়সারাভাবে চলছে এ হাজার হাজার প্রতিষ্ঠান। সরকারের অনুদানে পরিচালিত হলেও চলছে সুপার, প্রিন্সিপালসহ গভর্ণিং বডির ইচ্ছায়। গভর্ণিং বডিতে সুপার ও প্রিন্সিপালরা হচ্ছেন সদস্য সচিব। নিয়ম অমান্য করে গভর্ণিং বডি হস্তক্ষেপ করছে একাডেমিক বিষয়েও। গবর্নিং বডিতে এসে প্রভাবশালীরা সরকারের আদেশ নির্দেশ অমান্য করে ইচ্ছেমতো প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছেন।
ফলে দিন দিন প্রতিষ্ঠান পরিণত হচ্ছে নিয়োগ ও ভর্তি বাণিজ্যের হাতিয়ার হিসেবে। সুপার ও প্রিন্সিপালরা অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের পছন্দের লোক দিয়ে কমিটি গঠন করছেন। অনেকেই পাত্তা দিচ্ছেন না প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতাকেও। এ অবস্থায় এখন অনেক অঞ্চলেই দাবি উঠেছে, এখন যেখানে সরকারই শতভাগ বেতন-ভাতা দিচ্ছে সেখানে পুরনো আইন এখন আর মেনে নেয়া যায় না। প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় এমপিওভুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারী নিয়ন্ত্রণ আনা জরুরী। শতভাগ বেতন সরকার দিচ্ছে-এ বিষয়টি মাথায় রেখে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োগ করতে হবে। আর অশিক্ষিত মোড়ল মাতব্বররা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আসছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের কাছে আছে কেবল ১৯৬১ সালের একটি আদেশ। কিন্তু ওই আদেশ জারির সময় কোন প্রতিষ্ঠানই সরকারের অর্থে পরিচালিত হতো না। আদেশও হয়েছিল সরকারী অর্থায়ন না থাকার বিষয়টি মাথায় রেখেই। আর এখন শিক্ষক-কর্মচারীদের শতভাগ বেতন সরকারীভাবে দেয়া হলেও সেই একই নীতিমালা টিকে থাকায় তা কার্যকর করা যাচ্ছে না। এখন শতভাগ বেতন সরকারীভাবে দেয়া হচ্ছে। তাই আগের নীতিমালা দিয়ে কোনভাবেই প্রতিষ্ঠানেও ওপর নিয়ন্ত্রণ ফলপ্রসূ হচ্ছে না, হবেও না। শতভাগ বেতন সরকার দিচ্ছে-এই বিষয়টি মাথায় রেখে এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় সুনির্দিষ্ট একটি নীতিমালা প্রণয়ন ও প্রয়োগ করা জরুরী।
শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিক্ষকদের নৈতিক অবক্ষয়ের প্রভাব পড়ছে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যেও। নিজ প্রতিষ্ঠানেই যৌন নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েছে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীরা। অথচ মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সুপর থেকে শুরু করে শিক্ষকদের একটা বড় অংশ জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তারপরেও এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় কখনোই কঠোর হতে পারেনি প্রশাসন।
পপুলেশন কাউন্সিলের এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের ৭৬ শতাংশ কিশোরী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বাইরে যৌন নির্যাতনের শিকার হন। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি বন্ধে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিরোধ কমিটি হবে। যার ধারাবাহিকতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। গণস্বাক্ষরতা অভিযানের পরিচালিত এ্যাডুকেশন-ওয়াচের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের অর্ধেক শিক্ষক নিজেদের নৈতিক আদর্শ মনে করেন না। আরও বলা হয়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ৫০ শতাংশ, মাধ্যমিকের দুই তৃতীয়াংশ এবং, উচ্চশিক্ষার ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী শিক্ষকদের নৈতিক আদর্শ মনে করেন না।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী ও শিশু নির্যাতন নিয়ে কম বেশি গবেষণা হলেও সবকিছুর বাইরেই থেকে যাচ্ছে মাদ্রাসায় নারী নির্যাতনের বিষয়গুলো। নেই কোন সঠিক ও সুনির্দিষ্ট পরিসংখ্যান। অথচ একের পর এক ঘটনা আসছে গণমাধ্যমে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নারী নির্যাতনের ঘটনা সাধারণ প্রতিষ্ঠানের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি হলেও সেই তথ্য প্রকাশ হয় খুব কম। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ও সুপারের পক্ষে অবস্থান নেন মৌলবাদীরা। ফলে নিজের সামাজিক অবস্থা কথা চিন্তা করেই মুখ বন্ধ সবকিছু সহ্য করেন ছাত্রীরা। কিছুক্ষেত্রে নারী শিক্ষকরা ছাত্রীর পক্ষে অবস্থান নিতে চাইলেও তারা সফল হতে পারেন না মৌলবাদীদের দাপটের কারণে।