আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনে নেতৃত্বে বড় ধরণের পরিবর্তন আসছে ॥ বাদ যাচ্ছেন বিতর্কিতরা, আসছেন তরুণ ও ক্লিন ইমেজধারীরা

36

কাজিরবাজার ডেস্ক :
শুধু জেলা উপজেলায় নয়, কেন্দ্রীয় ও সব সহযোগী সংগঠনের নেতৃত্বে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। বিতর্কিত ও অভিযুক্তদের সহযোগী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে হটিয়ে তাদের জায়গায় পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির তরুণ নেতৃত্ব আনতে চান দলটির হাইকমান্ড। যাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাসের মতো অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে তারা আওয়ামী লীগের মূল দলে এবং সহযোগী কিংবা ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনÑ কোথাও কোন স্থান পাবেন না, এটি স্পষ্ট করেই জানিয়ে দিয়েছেন দলটির সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফলে আসন্ন সম্মেলনকে ঘিরে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোতে পরিবর্তনের হাওয়া বইতে শুরু করেছে।
কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ ও পাঁচ সহযোগী সংগঠনের আসন্ন কাউন্সিলকে ঘিরে চাঙ্গা হয়ে উঠেছেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। কাউন্সিলকে ঘিরে দলীয় নেতাকর্মীদের পদভাবে মুখরিত ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভাপতির রাজনৈতিক কার্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়। চার সহযোগী সংগঠন ছাড়াও ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগকেও সম্মেলনের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ও একসঙ্গে ছয়টি সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনে নিজেদের পদ-পদবি টিকিয়ে রাখা এবং নতুন পদপ্রত্যাশীদের পদচারণায় দলটিতে রীতিমত উৎসবের আমেজ তৈরি হয়েছে। সম্মেলন সামনে রেখে সারাদেশেই দলটির মধ্যে একদিকে যেমন ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছে তেমনি পদপ্রত্যাশী ও পদে থাকা নেতাদের টেনশনের পারদ ততই যেন উঠছে। সবাই তাকিয়ে আছেন দলটির সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকে। সম্মেলনে বিতর্কিতরা বাদ পড়ছেন, সেক্ষেত্রে ভাগ্য খুলতে পারে একঝাঁক সাবেক ছাত্রনেতার। ভাবমূর্তি ফেরাতে সক্ষম এমন নেতাদের বাছাই করে সহযোগী সংগঠনগুলোকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকরা।
জানা গেছে, সম্মেলন সামনে রেখে কেন্দ্রীয় ও সহযোগী সংগঠনগুলোর বর্তমান অনেক নেতার বিরুদ্ধে একাধিক গোয়েন্দা রিপোর্ট এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে। সবার আমলনামা পর্যবেক্ষণ করছেন তিনি। অনেকের বিরুদ্ধে প্রমাণ পেলেও কঠোর ভাষায় কাউকে কিছু বলছেন না। মাত্রাতিরিক্ত বিতর্কিতদের আগামী জাতীয় সম্মেলনে তিনি বাদ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর নতুন যাদের নিয়ে আসবেন তাদের ব্যাপারেও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। জাতীয় সম্মেলনে যতটুকু সম্ভব দলকে সরকার থেকে পৃথক করার চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শনিবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা একজন চেঞ্জ মেকার। তিনি সব সময়ই সম্মেলনের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞানসম্পন্ন নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে থাকেন। কাউন্সিলররা দলের সভাপতি শেখ হাসিনার ওপরই কমিটি গঠনের সব দায়িত্ব ছেড়ে দেন। আমার বিশ্বাস, এবারের সম্মেলনের মাধ্যমে নবীন-প্রবীণের সমন্বয় ঘটবে। সম্মেলনের মাধ্যমে অনেক নতুন মুখের জায়গা কমিটিতে হবে। সহযোগী সংগঠনগুলোতেও এমনটা হবে।
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা মনে করছেন, এবার দলের মধ্যে বড় ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে। সম্প্রতি সাংগঠনিক বিষয় নিয়ে দলীয় সভানেত্রীর কঠোর মনোভাবের কারণে অনেকে মনে করছেন, এবার শুধু জেলা উপজেলায় নয়, কেন্দ্রীয় কমিটিতেও বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
গত ১৪ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে দলের সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে আহ্বায়ক ও সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে সদস্য সচিব এবং কেন্দ্রীয় সব নেতাকে সদস্য করে জাতীয় সম্মেলনের কমিটি গঠন করা হয়। সম্মেলন সম্পন্ন করতে ১১টি উপকমিটি গঠনের কাজ চলছে। এসব উপকমিটির আহ্বায়ক ও সদস্য সচিব পর্যায়ক্রমে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন করবেন। সম্মেলন জাঁকজমকপূর্ণ করে তুলতে বড় রকমের পরিকল্পনা করেছেন দলের নেতারা।
দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটিতে বিতর্কমুক্ত ও পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতৃত্ব আনতে চান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এ লক্ষ্যে তিনি সংগঠনগুলোর শীর্ষ নেতাদের নির্দেশনাও দিচ্ছেন নিয়মিত। আগে অন্যান্য সময় আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের সহযোগী সংগঠনের সম্মেলনের বিষয়টি দেখাশোনার দায়িত্ব দিতেন। এবার এখন পর্যন্ত কোন নেতাকেই সুনির্দিষ্ট কোন সংগঠনের সম্মেলনের বিষয়ে দায়িত্ব দেননি তিনি। নিজেই দেখভাল করছেন সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্মেলন থেকে শুরু করে নতুন নেতৃত্ব আনার বিষয়গুলো। মূলত বিতর্কমুক্ত নেতৃত্ব বাছাইয়ের সতর্কতা হিসেবেই তিনি এ প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছেন বলে জানা গেছে। কারণ, এর আগে সহযোগী সংগঠনগুলোর দায়িত্ব দলের অন্য নেতাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে খুব একটা ভাল ফল পাননি তিনি। যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে চলমান শুদ্ধি অভিযানে।
আগামী ২০-২১ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের ত্রিবার্ষিক জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া আগামী ৬ নভেম্বর কৃষক লীগ, ৯ নভেম্বর জাতীয় শ্রমিক লীগ, ১৬ নভেম্বর আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ২৩ নভেম্বর যুবলীগ এবং ২৯ নভেম্বর মৎস্যজীবী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠেয় সব সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকতে পারেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া ইতোমধ্যে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের নেতাদের দ্রুত সম্মেলন আয়োজনের নির্দেশ দিয়েছেন। এ দুটি সহযোগী সংগঠনও দ্রুত বর্ধিত সভা ডেকে সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করবে বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক নেতারা জানিয়েছেন, টানা তিন মেয়াদে আওয়ামী লীগ সরকারী দলে। এর ফলে আওয়ামী লীগের সংগঠনের অনেক নেতাকর্মীই ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন। বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না আওয়ামী লীগ প্রধান। এ কারণে তিনি নিজ দলের নেতাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। অভিযুক্তদের সংগঠন থেকে বাদ দিয়ে তাদের জায়গায় পরিচ্ছন্ন ভাবমূর্তির নেতৃত্ব আনতে চান তিনি। তিনি সংশ্লিষ্ট নেতাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, অভিযুক্ত কাউকে যেন সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিতে না রাখা হয়।
গণভবন সূত্রে জানা গেছে, সম্মেলনের আগে ৫ সহযোগী সংগঠনের সঙ্গেই আলাদাভাবে বসবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আসন্ন সম্মেলনে সহযোগী সংগঠনগুলোতে নেতা নির্বাচনের গাইডলাইন দেবেন তিনি। আজ রবিবার আওয়ামী যুবলীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসে সম্মেলনের প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা দিতে পারেন তিনি। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, যুবলীগের হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনতে নেতৃত্ব নির্ধারণে ছাত্রলীগের মতো বয়সসীমা নির্ধারণ করে দেয়া হতে পারে। বুড়োলীগের পরিবর্তে তারুণ্যনির্ভর যুবলীগ গঠন করার আভাস এখন স্পষ্ট। যদি যুবলীগের নতুন নেতৃত্বের ক্ষেত্রে বয়সসীমা ৫০-৫৫ বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়, সেক্ষেত্রে বর্তমানে কমিটিতে থাকা অধিকাংশ শীর্ষ নেতাই তাদের পদ হারাবেন।
অন্যদিকে স্বেচ্ছাসেবক লীগ, জাতীয় শ্রমিক লীগ, কৃষক লীগকেও সম্মেলনের মাধ্যমে ঢেলে সাজাতে চায় আওয়ামী লীগ। এ তিনটি সংগঠনের ক্ষেত্রেও বিতর্কিত এবং অনিয়ম-দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের সরাসরি বাদ দিয়ে সাংগঠনিক ও স্বচ্ছ ইমেজের নেতাদের বড় বড় পদে আসীন করা হতে পারে। অন্যদিকে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগেও সম্মেলনের মাধ্যমে বড় ধরনের শুদ্ধি অভিযান চালাতে চান দলটির হাইকমান্ড। বিতর্কিত, হাইব্রিড ও অনুপ্রবেশকারীদের বাদ দিয়ে ত্যাগী ও পরীক্ষিত নেতাদের এনে এ দুটি সংগঠনকেও ঢেলে সাজাতে চাইছে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা।
এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা জানান, যাদের বিরুদ্ধে অনিয়ম, দুর্নীতি, মাদক, সন্ত্রাসের মতো অপকর্মের অভিযোগ রয়েছে তারা আমাদের মূল দলে এবং সহযোগী সংগঠন- কোথাও কোন স্থান পাবেন না বলে একাধিকার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। সহযোগী সংগঠনের সম্মেলনগুলোতেও তার নির্দেশনার বিষয়টির প্রতিফলন ঘটবে। আর প্রধানমন্ত্রীর এমন কঠোর অবস্থানে কেন্দ্রীয় ও সহযোগী সংগঠনগুলোতে বড় বড় পদে থাকা অনেক নেতাই পদ হারানোর আতঙ্কে ভুগছেন।
সম্মেলন সামনে রেখে আওয়ামী লীগের বড় ধরনের এই শুদ্ধি অভিযানের আভাসে নড়েচড়ে বসেছেন দলটির সাবেক ছাত্রনেতারা। ইতোপূর্বে সহযোগী সংগঠনগুলোতে স্থান না পাওয়ায় দীর্ঘদিন ধরেই পরিচ্ছন্ন ইমেজ থাকলেও বেশকিছু সাবেক ছাত্রনেতাকে আওয়ামী লীগে শুধু উপকমিটির সহসম্পাদক পদ নিয়েই চলতে হয়েছে। এ পদের পরিচয় ছাড়া এতদিন বড় বড় পদে থাকা এসব সাবেক ছাত্রনেতার অন্যকোন পরিচয় ছিল না আওয়ামী লীগে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে আসন্ন সম্মেলনে ঢাকার দুই মহানগর কমিটি ছাড়াও চার সহযোগী ও ভাতৃপ্রতীম সংগঠনগুলোতে নেতৃত্ব পাওয়ার আশায় তৎপরতা চালাচ্ছেন এসব সাবেক ছাত্রনেতা। সহযোগী সংগঠন ছাড়াও আওয়ামী লীগের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদেও পদ পাওয়ার আশায় প্রায় প্রতিদিনই দলের সকল কর্মসূচীতে সামনের সারিতে থেকে শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করছেন তারা।