কাজিরবাজার ডেস্ক :
ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করায় ভারত ভ্রমণে সবার শীর্ষে বাংলাদেশ। পৃথিবীর সব দেশকে পেছনে ফেলে এ রেকর্ড গড়েছে এদেশের পর্যটকরা। শুধুু ’১৮ জানুয়ারি থেকে এ বছরের মার্চ পর্যন্ত ২৮ লাখ ৭৬ হাজার বাংলাদেশী ভারত ভ্রমণ করেছেন। একই সময়ে দেশটিতে ভ্রমণ করেছেন প্রায় ১০ লাখ মার্কিন নাগরিক। অর্থাৎ ভারত ভ্রমণে বাংলাদেশের পরই যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান। বিপরীতে ভারত থেকে এর সিকি ভাগও আসছেন না। বছরে সেটা ৩ থেকে ৪ লাখের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে। এতে শুধু পর্যটন খাতেই বাণিজ্য ঘাটতি ঘটছে অস্বাভাবিক।
ভারত সম্প্রতি ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করায় আগের তুলনায় অনেক বাংলাদেশী দেশটি ভ্রমণ করছে। মূলত চিকিৎসাসেবা ও ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজেই বাংলাদেশীরা বেশি ভ্রমণ করছে। এছাড়া পড়াশোনা, বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করাসহ ভ্রমণের সব ক্যাটাগরিতেই ভারতে বাংলাদেশীদের যাতায়াত বাড়ছে। এর মধ্যে সব থেকে বেশি যাচ্ছে ‘ভিজিটিং ফ্রেন্ডস এ্যান্ড ফ্যামিলি’ ক্যাটাগরির বাংলাদেশীরা। বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন ও ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
এত বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশীর ভারত ভ্রমণে দৈনিক কমপক্ষে গড়ে ৫ হাজার টাকা ব্যয় করলেও বছরে সেটা দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। এর বিপরীতে ভারত থেকে পর্যটক আসছে না এর সিকি ভাগও। ফলে শুধু পর্যটন খাতেই বাণিজ্য ঘাটতি বা ভারসাম্যহীনতা ঘটছে অস্বাভাবিক। পর্যটক বিশেষজ্ঞ হাকিম আলীর মতে, এ ব্যবধান কমাতে হলে ভারত থেকে ইনবাউন্ড ট্যুরিস্ট আনার সংখ্যা বাড়াতে হবে। বছরে যদি দুই হাজার কোটি টাকা পর্যটকদের মাধ্যমে চলে যায়-তার অন্তত অর্ধেক হলেও ভারতীয়দের মাধ্যমে আনতে হবে দেশে। নইলে শুধু এক পর্যটন খাতেই বাণিজ্য ঘাটতি দেখা দেবে আশঙ্কাজনক হারে।
শুধু গত বছরেই রেকর্ড সংখ্যক বাংলাদেশী ভারত ভ্রমণ করেছেন। ১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত মোট ১ কোটি ৩৭ লাখ ৩০ হাজার ২৮২ বিদেশী ভারত ভ্রমণ করেছে। এর মধ্যে বাংলাদেশীর সংখ্যা ২৮ লাখ ৭৬ হাজার। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ১৮ লাখ ৬৩ হাজার ২৭৮, যুক্তরাজ্যের ১৩ লাখ ৬৯ হাজার ৫৪৮, কানাডার ৪ লাখ ৭৮ হাজার ২২৮, শ্রীলঙ্কার ৪ লাখ ৫১ হাজার ৭৩৬, অস্ট্রেলিয়ার ৪ লাখ ৪৪ হাজার ৩৩, মালয়েশিয়ার ৪ লাখ ১১ হাজার ৫০, রাশিয়ার ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৮৩, চীনের ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৪৪৯ এবং জার্মানির ৩ লাখ ৬০ হাজার ৮৪৩ নাগরিক ভারত ভ্রমণ করে। ভারতে মোট বিদেশী পর্যটকের ৬৫ দশমিক ৬১ শতাংশ এসেছে এ দশটি দেশ থেকে। তবে এদের মধ্যে ’১৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ’১৯ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ভারত মোট ১ হাজার ৯৮২ বিদেশী নাগরিককে ডিপোর্ট বা বিতাড়িত করেছে। এ তালিকায় বাংলাদেশীরাই দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৪৯১। সবচেয়ে বেশি নাইজিরিয়ার ৮৪৭ নাগরিককে বিতাড়িত করেছে ভারত, এছাড়া সোমালিয়ার ১২৪ জন। ভারত ভ্রমণকারী বিদেশী নাগরিকের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ শীর্ষ তালিকায় আসে ’১৫ সালে। সে বছর যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য যথাক্রমে দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে ছিল। এর আগে ’১৪ সালে ভারত ভ্রমণে বাংলাদেশীরা দ্বিতীয় এবং ’১৩ ও ’১২ সালে তৃতীয় অবস্থানে ছিল। পাকিস্তান থেকেও একটা উল্লেখযোগ্যসংখ্যক পর্যটক প্রতিবছর ভারত ভ্রমণ করে।
এ বিষয়ে দেশের শীর্ষ পর্যটন বিশেষজ্ঞ হাকিম আলী বলেন, এটা তো নতুন কিছু নয়। দীর্ঘদিন ধরেই বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশীর ভারত ভ্রমণ করে আসছে। মূলত যোগাযোগ ব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতির ফলে এ প্রবণতা উর্ধমুখী। এ জন্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে ভ্রমণকারীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, দ্বিতীয়টি পর্যটন, তৃতীয়ত চিকিৎসা এবং চতুর্থ কারণটি হচ্ছে ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করা। ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের প্রায় সব মাধ্যমই ব্যবহার করতে পারেন ব্যবসায়ীরা। এটা কি কল্পনা করা যায়, প্রতিদিন শুধু ঢাকা থেকেই বিমান, ইউএস বাংলা, রিজেন্ট, নভো, স্পাইস জেট, এয়ার ইন্ডিয়া, ও ইন্ডিগোর দশটি ফ্লাইট ভারত যাচ্ছে। প্রতিটি ফ্লাইট পূর্ণ থাকে। এছাড়া বাস ট্রেন, জলযান, সীমান্তবাসীরা হেঁটেও যাচ্ছে। শুধু চলতি সপ্তাহেই বেনাপোল দিয়ে ৪০ হাজার বাংলাদেশী কলকাতা গেছেন পূজা দেখতে। যোগাযোগ ব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নতি ঘটায় পণ্য আমদানি-রফতানির খরচ ও সময় দুটোই কমে আসে। ফলে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বাড়ছে, সেই সঙ্গে বাড়ছে দেশটিতে ব্যবসায়িক সফরও।
হাকিম আলীর মতে, দ্বিতীয় বড় কারণ উন্নত চিকিৎসা। ভারতে উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার জন্য চেন্নাই মেডিক্যাল ট্যুরিজমের কেন্দ্র হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে এখন। ফলে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে বিপুলসংখ্যক মানুষ চিকিৎসাসেবা নিতে যাচ্ছে। এছাড়া ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অনেকেরই বন্ধু ও আত্মীয়স্বজন রয়েছে। তাদের সঙ্গে দেখা করতে ‘ভিজিটিং ফ্রেন্ডস এ্যান্ড ফ্যামিলি’ ক্যাটাগরিতে অনেক বাংলাদেশী ভারত সফর করে থাকে। ভারত বাংলাদেশে এত বড় এবং এত বেশি ভিসা সেন্টার করেছে, যা বিশ্বের অন্য কোন দেশে নেই। সেই সঙ্গে ভিসা প্রক্রিয়া আগের থেকে বেশ শিথিল হয়েছে। দুই দেশের রেল, বাস ও ফ্লাইটের সংখ্যা বেড়েছে। সেই সঙ্গে ভাড়া প্রতিযোগিতামূলক হয়েছে। ফলে বাংলাদেশীরা এখন যে কোন উৎসব পার্বণে কেনাকাটা করতে ভারত যাচ্ছে। মূলত এসব কারণেই ভারত ভ্রমণে বিদেশীদের মধ্যে বাংলাদেশীরাই শীর্ষে।
এদিকে ভারতীয় পর্যটকের সংখ্যা অর্থাৎ ইনবাউন্ড ট্যুরিস্ট বাড়াতে হলে বাংলাদেশের পর্যটন খাতের আকর্ষণীয় স্পটগুলোতে ব্র্যান্ডিং করার কোন বিকল্প নেই বলে উল্লেখ করেছেন সচিব মহিবুল হক। তিনি বলেন, পর্যটনের মাস্টার প্ল্যান তৈরির পর অবশ্যই এ খাতের প্রত্যাশিত উন্নতি ঘটবে। শুধু ভারত নয়, সারাবিশ্বের পর্যটক আকর্ষণের জন্য ব্র্যান্ডিং করা হবে।