জিয়া ও এরশাদকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করা যায় না – প্রধানমন্ত্রী

70
সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে জাতীয় সংসদ ভবনে একাদশ জাতীয় সংসদের কার্য উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী এমপির সভাপতিত্বে কার্য উপদেষ্টা কমিটির ৪র্থ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
অনেক কিছু বলার থাকলেও গণতন্ত্রের স্বার্থে অনেক কিছু হজম করে এগিয়ে যাচ্ছি উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের উচ্চ আদালত মার্শাল ল’ দিয়ে জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদের ক্ষমতা দখলকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। এই রায়ের পর এ দু’জনকে (জিয়া ও এরশাদ) আর রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করা যায় না। তবে জেনারেল এরশাদ অমায়িক ছিলেন, মানুষের প্রতি তার দরদ ছিল।
স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে রবিবার জাতীয় সংসদ অধিবেশনের প্রথম দিন প্রয়াত বিরোধী দলের নেতা এইচএম এরশাদসহ আনীত শোক প্রস্তাবের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি আরও বলেন, দোষে- গুণে মানুষ। আমাদেরও অনেক কিছুই বলার আছে। কারণ আমরাই সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী। তারপরও দেশের স্বার্থে, গণতন্ত্রের স্বার্থে, জনগণের উন্নয়নের স্বার্থে অনেক কিছু হজম করে যাচ্ছি। তিনি প্রয়াত বিরোধী দলের নেতা এইচএম এরশাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করেন।
শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনাকালে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জিএম কাদের এবং মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা এইচএম এরশাদের শাসনামলে কারোর মনে আঘাত থাকলে বা কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে তার জন্য দেশবাসীর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন।
শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় আরও অংশ নেন বিরোধী দলের উপনেতা বেগম রওশন এরশাদ, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও সাবেক শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, সাবেক নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙ্গা, ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, মুজিবুল হক চুন্নু, ফখরুল ইমাম, কাজী ফিরোজ রশীদ, ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, আহসান আদিলুর রহমান, পীর ফজলুর রহমান, সালমা ইসলাম, নাজমা আখতার ও তরিকত ফেডারেশনের মুজিবুল বশর মাইজভা-ারী। আলোচনা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে শোক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সংসদ নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিরোধী দলের নেতা যিনি ছিলেন, সেই জেনারেল এরশাদ এক সময় যখন পাকিস্তান থেকে ফিরে আসেন তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তাকে সেনাবাহিনীতে যোগদান করান। এক সময় তিনি সেনাবাহিনীর প্রধান হন। তিনি বলেন, ১৯৮১ সালে যে নির্বাচন হয়েছিল, সেই নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী ছিলেন বিচারপতি সাত্তার। তাকে কিন্তু সেনাপ্রধান হিসেবে সাত্তারকে প্রার্থী করেছিলেন জেনারেল এরশাদ। একটি বিদেশী পত্রিকায় তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন বিচারপতি সাত্তার তার প্রার্থী! সেখানেই আমরা আপত্তি তুলেছিলাম। বিচারপতি সাত্তারকে বলেছিলাম, এ ধরনের প্রার্থী হওয়া উচিত নয়। বরং নির্বাচনটা সুষ্ঠুভাবে হতে দেন, গণতান্ত্রিক ধারা যেন বজায় থাকে। কিন্তু তারা তা করেনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এতে ফলাফল এটাই হয়েছিল যে তখন বেগম খালেদা জিয়া কিন্তু রাজনীতিতে আসেনি। কিন্ত পরবর্তিতে রাজনীতিতে না এলেও হঠাৎ করে বিচারপতি ছাত্তারের বিরুদ্ধে একটা স্টেটমেন্ট দেন। বিচারপতি ছাত্তার ছিল তখন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান। তখন খালেদা জিয়া তাকে চেয়ারম্যান পদ থেকে বিদায় দেয়ার জন্য স্টেটমেন্ট দেয়। তিনি বলেন, ১৯৮২ সালে এরশাদ যে ক্ষমতা দখল করেছিল, সেই ক্ষমতা দখলের সুযোগটা কিন্তু খালেদা জিয়াই করে দিয়েছিলেন। করে দিয়েছিল হয়ত এ কারণেই যে, জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়াকে শুধু দুটি বাড়িই নয়, নগদ ১০ লাখ টাকাসহ অনেক সুযোগ-সুবিধা জেনারেল এরশাদ দিয়েছিলেন। যে কারণে জিয়া হত্যার ব্যাপারে যে মামলা হয়েছিল চট্টগ্রামে, সে মামলা কিন্তু বিএনপি কখন চালায়নি।
তিনি বলেন, বহু বছর পরে ১৯৯৪ সালের দিকে এক সময়ে বা বহু বছর পর এসে জেনারেল এরশাদকে তার স্বামীকে হত্যার জন্য দায়ী করেছেন খালেদা জিয়া। এর পূর্বে কখনও দায়ী করেননি। এগুলো ইতিহাসের একটা অংশ যে, ক্ষমতাটাকে তুলে দেয়া বা সুযোগ করে দেয়া। তবে এর বিরুদ্ধে আমরাই প্রতিবাদ করেছি। কারণ আমরা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দল প্রতিবাদ করেছিলাম এই জন্যই যে, আমরা চেয়েছিলাম গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া। অর্থাৎ এক সামরিক শাসকের ক্ষমতা থেকে আরেক সামরিক শাসকের ক্ষমতা আসুক, এটা কখনও আমাদের জন্য কাম্য ছিল না।
সংসদ নেতা বলেন, অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়ে ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পর অনেক ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আমাকে চলতে হয়েছে। আমি দেশে ফিরে আসার পরে ধানম-ির ৩২ নম্বরে আমাদের বাড়িতে জেনারেল জিয়াকে আমাকে ঢুকতেই দেয়নি। এটাও বাস্তবতা। তিনি বলেন, প্রথমে মার্শাল ল’ জারি করে জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করে। এরপর নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে ক্ষমতা দখল করে নেয়। এই ক্ষমতা দখল প্রথমে জিয়াউর রহমান করে। জাতির পিতাকে হত্যার পর ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে। এরপর জেনারেল এরশাদও নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, উচ্চ আদালত জিয়াউর রহমান ও এইচএম এরশাদের এই ক্ষমতা দখলটাকে অবৈধ ঘোষণা করেছে। উচ্চ আদালত অবৈধ যখন ঘোষণা করেছে, তখন আর এই দুজনের কেউ আর সাবেক রাষ্ট্রপতি হিসেবে কিন্তু থাকে না। তাদের রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করাও হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী বৈধ নয়, বরং সেটা করা যায় না। কারণ একটা রায়ের মধ্য দিয়ে দেশে গণতন্ত্রের ধারাটা অব্যাহত রাখার ধারা যোগ হয়েছে।
জেনারেল এরশাদ অমায়িক ছিলেন এবং মানুষের প্রতি তার দরদ ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীনতার পর জাতির পিতা সাভার স্মৃতিসৌধের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তিতে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসে। জেনারেল জিয়া কিন্তু নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিলেও কখনও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্নগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেয়নি। যেটা করেছেন জেনারেল এরশাদ। তিনি আসার পর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের অসমাপ্ত কাজ বা সাভার স্মৃতিসৌধের অসমাপ্ত কাজ বা মুজিব নগরের স্মৃতিসৌধ সেগুলো তৈরি করেছেন- এতে কোন সন্দেহ নেই।
তিনি বলেন, কেউ যদি ভাল কাজ করে নিশ্চয়ই আমরা তা বলব। তাছাড়া আর একটি কাজ এরশাদ করেছিলেন। নির্বাচনে যাওয়া নিয়ে যখন জেনারেল এরশাদের সঙ্গে সংলাপ করি আমাদের ১৪ জন ছাত্রের বিরুদ্ধে জিয়ার আমলে জারিকৃত মৃত্যুর পরোয়ানা প্রত্যাহারের জন্য এবং তাদের মুক্তি দেয়ার জন্য। তাছাড়া অনেকেই তখন গ্রেফতার হয়ে বন্দী ছিলেন। এরশাদ সকলকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এই মুক্তি দেয়ার মধ্য থেকে তিনি এক একটা পরিবারকে রক্ষা করেছিলেন।
অতীতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই সময় আমি, অনেকবার আমাকে গ্রেফতার করা হয়, কারাবরণ করি। আমাদের একেক সময় গ্রেফতার, কখনও সাবজেলে রাখা হয়, আবার কখনও গৃহবন্দী করা হয়। ১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি লালদীঘির ময়দানে আমাদের সভা করতে বাধা দেয়া হয়। সরাসরি গুলি ছোড়া হয়, সেখানে প্রায় ৩০ জনের মতো মানুষ মারা যায়। এগুলো কিন্তু এরশাদের শাসনামলেই হয়েছিল।
সংসদ নেতা বলেন, আমরা সব সময় গণতন্ত্র চেয়েছি, যেন গণতন্ত্র অব্যাহত থাকে। যে কারণে অনেক প্রতিকূল অবস্থায়ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলাম ১৯৮৬ সালে, যদি সেই নির্বাচনটা সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষভাবে হতো, তা হলে হয়ত তাকে এই ধরনের বিতর্কিত হতে হতো না। একটি গণতান্ত্রিক ধারা প্রতিষ্ঠিত হতো। দল নির্বাচনের পর কারফিউ প্রত্যাহার করা হয়। কারণ জেনারেল জিয়ার আমলে প্রতি রাতে কারফিউ ছিল। তিনি বলেন, ১৯৮৮ সালের নির্বাচন যেটা হয় সেটাও বলতে গেলে কোন দল অংশগ্রহণ করেনি। এরপর আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করেছিলেন খালেদা জিয়া, তখনও কিন্তু কোন দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। আন্দোলনের মুখে খালেদা জিয়া মাত্র দেড়মাসের মধ্যে ক্ষমতা থেকে পদত্যাগে বাধ্য হন। সেটাও জনগণের রুদ্ররোষে। অর্থাৎ জনসমর্থন না থাকলে নির্বাচন নিয়ে যে যত বিতর্কিত হোক, যে কথাই বলুক না কেন, যদি জনসমর্থন না থাকে তবে সে নির্বাচন যদি সত্যিকার ভোট দিয়ে না থাকে তাহলে সেই নির্বাচনে কেউ টিকে থাকতে পারে না। তার প্রমাণ খালেদা জিয়ার ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন। একাদশ জাতীয় নির্বাচনেও জনগণ ভোট দিয়েছে বলেই বিএনপির আন্দোলনের ডাকে দেশের জনগণ সাড়া দেয়নি। যদি নির্বাচনে জনগণ ভোট দিত, তবে তারা আন্দোলন করে আমাদের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারত। তাই অনেক চড়াই-উতরাই পার হয়েই আমরা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছি। দেশ আজ সবদিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে।