কাজিরবাজার ডেস্ক :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ১০ বছরে তার সরকারের আমলে সবদিক থেকে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন, বাংলাদেশ এখন সারাবিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোলমডেল। বাঙালী জাতিকে শোষণ করা পাকিস্তানীরাও এখন বলতে বাধ্য হচ্ছে ‘হামকো বাংলাদেশ বানা দো’। আমাদের (পাকিস্তানী) বাংলাদেশের মতো উন্নত করে দাও, সেটা তারা বলতে বাধ্য হচ্ছে। বিশ্বের কেউ আজকে বাংলাদেশকে অবহেলার চোখে দেখে না। আজ বাংলাদেশকে সম্মানের চোখেই দেখতে হয় যে, বাংলাদেশও পারে।
রবিবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে জাতীয় রফতানি ট্রফি ২০১৬-১৭ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে দেশ থেকে আমরা বাংলাদেশকে মুক্ত করেছিলাম, তারা (পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী) এক সময় বলেছিল, বাংলাদেশের মানুষ গরিব, ওটা (বাংলাদেশ) একটা বোঝা ছিল, চলে গেছে (স্বাধীন) ভাল হয়েছে। অথচ আজকে তারাই বলতে বাধ্য হয়, আমাদের বাংলাদেশের মতো উন্নত করে দাও।
দেশবাসীকে উদ্দেশে করে তিনি বলেন, আজকে উন্নয়নের যে গতি, সেটা যেন কখনও থেমে না যায়। স্বাধীন বাংলাদেশ যেন বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। বাংলাদেশ আজ বিশ্বে যে সম্মান অর্জন করেছে, সে সম্মান ধরে রেখে বাংলাদেশকে আমরা উন্নত- সমৃদ্ধ করতে চাই। ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, সবসময়ই ব্যবসায়ীদের পাশে আছি। আমরা ব্যবসা করতে আসিনি। ব্যবসায়ীদের সবরকম সহযোগিতা দিয়ে দেশ যেন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হয় সেই ব্যবস্থাই সরকার করছে।
দেশের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে প্রয়োজনীয় সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের আশ্বাস দিয়ে নতুন শিল্প কারখানা স্থাপনের ক্ষেত্রে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশের প্রতি মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সরকার ব্যবসা-বান্ধব সরকার। ব্যবসায়ীরাই ব্যবসা করবে, তাদের কাজে আমরা সহযোগিতা করব। রফতানি আরও বাড়াতে নতুন নতুন পণ্য সংযোজন এবং নতুন বাজার অনুসন্ধানের জন্য রফতানিকারকদের আহ্বানও জানান প্রধানমন্ত্রী।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোঃ মফিজুল ইসলাম ও এফবিসিসিআইর সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম। রফতানি ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান বেগম ফাতিমা ইয়ামিন।
দেশের রফতানি খাতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ অনুষ্ঠানে ২৮টি ক্যাটাগরিতে ৬৬টি প্রতিষ্ঠানের মাঝে জাতীয় রফতানি ট্রফি ২০১৬-১৭’র ২৯টি স্বর্ণ, ২১টি রৌপ্য এবং ১৬টি ব্রঞ্জ ট্রফি প্রদান করেন প্রধানমন্ত্রী। ‘জাবের এ্যান্ড জুবায়ের ফেব্রিক্স লিমিটেড’ টানা ষষ্ঠ বারের মতো শ্রেষ্ঠ রফতানিকারক হিসেবে ২০১৬-১৭ সালের রফতানি স্বর্ণ ট্রফি জয় করে। ‘জাবের এ্যান্ড জুবায়ের লিমিটেড’ ২০১৭ সালের সর্বোচ্চ রফতানি আয়ের জন্য আরও একটি স্বর্ণ ট্রফি লাভ করে। অনুষ্ঠানে দেশের রফতানি বাণিজ্যের সম্প্রসারণের ওপর একটি ভিডিও চিত্রও প্রদর্শিত হয়।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রী পরিষদ সদস্যগণ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাগণ, সংসদ সদস্যগণ, পদস্থ সরকারী কর্মকর্তাবৃন্দ, বিভিন্ন ব্যবসায়িক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এবং শিল্প সংস্থার প্রতিনিধি, উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার প্রতিনিধিসহ বিদেশী কূটনীতিক এবং আমন্ত্রিত অতিথিবৃন্দ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
রফতানিকারকদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ইতোমধ্যে আমরা যে পণ্য রফতানি করছি, সেখানে আপনাদের কাছে অনুরোধ থাকবে, আমাদের নতুন নতুন পণ্য সংযোজন করতে হবে রফতানির ক্ষেত্রে। পণ্য সংযোজনের জন্য আমাদের বহুমুখীকরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে পৃথিবীর কোন্ কোন্ দেশে কোন জাতীয় পণ্যের চাহিদা বেশি সেদিকটায় বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। নতুন পণ্য, নতুন দেশ। এই নতুন দেশে নতুন পণ্য খুঁজে যাতে বের করতে পারি আর রফতানি করতে পারি, আমাদের বাজারটা যাতে আরও সম্প্রসারিত হয় সেদিকে আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।
পণ্য উৎপাদন ও রফতানি বাড়ানোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযোগিতার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাংক ঋণ নিতে গেলে অনেক উচ্চহারে সুদ দিয়ে ঋণ নিতে হয় ডবল ডিজিটে। ইতোমধ্যে আমরা নির্দেশ দিয়েছি এটা সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে হবে। কিছু কিছু ব্যাংক মেনেছে, কিছু কিছু ব্যাংক এখনও মানেনি। তবে সেটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। তাদের যা যা সুযোগ-সুবিধা দেয়া সেটাও আমরা করে দিচ্ছি। কাজেই এটাকে আমরা সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে চাই।
ব্যাংক ঋণের সুদের হার এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনার উদ্যোগের কথা জানিয়ে সরকারপ্রধান বলেন, সে ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা আমরা নিয়েছি, যাতে করে বিনিয়োগটা সহজ হয়। তাছাড়া বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অন্যান্য বিষয়ও সহজ করে দেয়া হয়েছে। সবকিছু যাতে অটোমেশনের মাধ্যমে হয় সেই পদক্ষেপও নেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ ও দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলার কাজ করছেন তারা। যখনই আমরা বিনিয়োগের কথা বলি, তখন বলি একটা দক্ষ যুব সমাজ আছে। এই যুব সমাজই আমাদের শক্তি। তাদেরকে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করে দেশে ও বিদেশে কাজে লাগবে। সে ব্যাপারেও ব্যবস্থা নিচ্ছি।
ব্যবসায়ীদের প্রতি অনুরোধ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে শিল্প বা শিল্পাঞ্চল আপনারা গড়ে তুলবেন বা শিল্পোন্নয়ন করবেন পাশাপাশি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রতি আপনাদের গুরুত্ব দিতে হবে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনাটা শুরু থেকেই করতে হবে যেমন, খুব হার্ড কেমিক্যাল ওয়েষ্ট অথবা সলিড ওয়েষ্ট বা অন্যান্য লিকুইড ওয়েষ্টের ব্যবস্থাপনা যদি শুরু থেকেই করেন তাহলে আমাদের পরিবেশ রক্ষায় সহযোগিতা হবে এবং দেশের জন্য, মানুষের জন্য কল্যাণকর হবে। তিনি ব্যবসায়ীদের এদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেয়ার আহ্বান জানান।
এই প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা প্রতিটি শিল্প এলাকায় একটি করে জলাধার রাখার ব্যাপারে নজর দেয়ার জন্যও ব্যবসায়ীদের প্রতি আহবান জানিয়ে বলেন, যেন বৃষ্টির পানি সেখানে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়। যত স্থাপনা হবে সেখানকার বৃষ্টির পানি এখানে সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকতে হবে। যাতে করে অগ্নিকা-সহ বিভিন্ন দুর্ঘটনায় এই পানি ব্যবহার করা যায়। শিল্প এলাকায় একটা জলাধার থাকলে সেখানকার পরিবেশটাও ভাল থাকে উল্লেখ করে তিনি সে স্থানে অধিকহারে বৃক্ষরোপণের পরামর্শ দেন। বলেন, শিল্পাঞ্চলে ব্যাপকহারে বৃক্ষরোপণ করা আমাদের পরিবেশের জন্যই দরকার। আপনারা সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেবেন।
রফতানির ক্ষেত্রে নতুন নতুন পণ্য সংযোজনের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, রফতানি পণ্য সংযোজনের জন্য পণ্যের বহুমুখীকরণ করতে হবে। নতুন বাজার খুঁজে বের করতে হবে। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং হাইকমিশনারদের দেশের রফতানি খাতের সম্প্রসারণে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যে যেই দেশের এ্যাম্বাসেডর সেই দেশে কোন্ পণ্যের চাহিদা রয়েছে সেই পণ্যের মধ্যে কোন্ কোন্টি আমাদের নিজেদের দেশে উৎপাদন করতে পারি, রফতানি করতে পারি এবং সেই সুযোগটা যাতে সৃষ্টি হয় তার জন্য তারা যথাযথভাবে কাজ করবেন এবং আমাদের উৎপাদিত পণ্য সে দেশের মানুষের সামনে যেন তুলে ধরা যায় সে ব্যবস্থাও তারা নেবেন।
তিনি বলেন, শিল্পায়নের জন্য আমরা পরিকল্পনা নিয়ে এগুচ্ছি। কারণ আমাদের কৃষিজমি রক্ষা করতে হবে। সেদিকে লক্ষ্য রেখে সমগ্র বাংলাদেশে ১০০টা অর্থনৈতিক অঞ্চল আমরা প্রতিষ্ঠা করে যাচ্ছি। তবে ব্যবসায়ীদের প্রতি আমি একটিই অনুরোধ করব যে, শিল্পাঞ্চল আপনারা গড়ে তুলবেন এবং শিল্পোন্নয়ন করবেন। সঙ্গে সঙ্গে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং পরিবেশ সংরক্ষণ এ বিষয়টার দিকেও বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে। তিনি বলেন, জাতির পিতা ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার যে স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে স্বপ্ন যেন আমরা পূরণ করতে পারি। সে লক্ষ্য নিয়েই সরকার কাজ করে যাচ্ছে।