কাজিরবাজার ডেস্ক :
‘ধর্ম-কর্ম-গণতন্ত্রের নিশ্চয়তাসহ সমাজতন্ত্রই মুক্তির পথ…’ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আদর্শিক ও বাম রাজনীতির বাতিঘর অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের কফিনে যখন সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদন পর্ব চলছে ঠিক তার ওপরে ঝুলছিল এরকম লেখা একটি কালো ব্যানার। তার দল ন্যাপের নেতাকর্মীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারাও বলেছেন, সত্যিই তিনি গণতন্ত্রের নিশ্চয়তার জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন। সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মুক্তির পথ খুঁজে বেড়িয়েছেন। তাঁর সংগ্রাম-কর্ম ও রাজনীতি সবকিছুই ছিল সত্যিকার অর্থেই মানুষের জন্য।
তাই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ছেড়ে রাজনীতিতে নেমেছিলেন গণমানুষের পাশে থাকতে। বন্ধুর সেই পথে নিজের আদর্শে অটুট থাকা বরেণ্য সেই রাজনীতিক অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে শেষ বিদায় জানাল সবাই। সবার শ্রদ্ধা জানানোর জন্য শনিবার দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে নেয়া হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)-এর সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফরকে। ৯৭ বছর বয়সে শুক্রবার রাজধানীর একটি বেসরকারী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় প্রবীণ এই রাজনীতিকের। যে মৃত্যুকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ধারায় ‘একটি যুগের অবসান’ বলছেন অনেক রাজনীতিক।
শনিবার সকালে প্রথমে সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে জানাযা হয় সাবেক সংসদ সদস্য অধ্যাপক মোজাফফরের। সেখানে রাষ্ট্রীয় সম্মান জানানোও হয়। জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় জাতীয় পতাকা মোড়ানো কফিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রদ্ধা জানান। এরপর স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারাও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব প্রদানকারী মুজিবনগর সরকারের এই উপদেষ্টার প্রতি। এ সময় ক্ষমতাসীন দলের পক্ষ থেকে আরও উপস্থিত ছিলেন সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামিম, ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ, আফজাল হোসেন প্রমুখ।
এর আগে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদের পক্ষ থেকেও তাঁর কফিনে শ্রদ্ধা জানানো হয়। এ সময় অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করে বিশেষ মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, মন্ত্রী পরিষদ সদস্যবৃন্দ, সংসদ সদসবৃন্দ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ মোনাজাতে শরিক হন। পরে মরদেহ নেয়া হয় ধানম-িতে ন্যাপের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। সেখান থেকে দুপুরে কফিন নেয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে; রাজনৈতিক সহকর্মী, অনুসারীদের ফুলে ফুলে ঢেকে যায় এই রাজনীতিকের কফিন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভেদের রেখা থাকলেও পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের প্রস্তাব পাকিস্তানের আইনসভায় প্রথম উত্থাপনকারী মোজাফফরের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর ক্ষেত্রে মুছে গিয়েছিল সেই রেখা। সকল রাজনৈতিক দলের নেতারা এসে যোগ হয়েছিলেন এক কাতারে। যা সাম্প্রতিক রাজনীতির ইতিহাসে খুব একটা দেখা যায় না। এমনকি সবাই দেশের প্রতি তার অবদানের কথা একবাক্যে স্বীকার করেছেন। জানিয়েছেন অতল শ্রদ্ধা।
আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টি বিএনপি সিপিবি জাসদ ওয়ার্কার্স পার্টির সঙ্গে তার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এসেছিলেন বিভিন্ন বাম রাজনীতিক দলের নেতারাও। এছাড়াও ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, জাতীয় কবিতা পরিষদ, বাংলাদেশ অর্থনীতিবিদ সমিতি, খেলাঘর, বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী পরিষদসহ বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী সংগঠনও শেষ বিদায় জানায় প্রয়াত নেতাকে।
আওয়ামী লীগের পক্ষে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে দলের আইন বিষয়ক সম্পাদক ও পূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বলেন, রাজনীতিতে কীভাবে আত্মোৎসর্গ করতে হয়, কীভাবে সততার দৃষ্টান্ত রাখতে হয়, লোভ-লালসা পরিহার করতে হয়, অনন্তকাল তার অনুপ্রেরণা জোগাবেন অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ।
শ্রদ্ধা জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ জীবনে কোন সম্মাননার পেছনে ছোটেননি। তিনি প্রমাণ করে গেছেন, শুধু পদ-পদবির পেছনে ছোটাই রাজনীতি না। আদর্শের রাজনীতিই হলো প্রকৃত রাজনীতি।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থনের ক্ষেত্রে অধ্যাপক মোজাফফর অনন্য অবদান রেখেছেন। তার মৃত্যু বাংলাদেশের রাজনীতিতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে থাকবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য আবদুল মতিন খসরু বলেন, উপমহাদেশের বাম রাজনীতির অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক মোজাফফর আহমদের মৃত্যুতে জাতির অপূরণীয় ক্ষতি হলো।
জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু শ্রদ্ধা জানিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ ছিলেন একজন জাতীয় নেতা। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছিলেন। বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের আন্দোলন এবং প্রগতিশীল রাজনীতিতে তার অবদান অনেক। তিনি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে আপোসহীন ছিলেন। এজন্যই তিনি জাতীয় নেতা।
সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, অধ্যাপক মোজাফফর সমাজতন্ত্রের জন্য আত্মনিয়োজিত একজন নেতা ছিলেন। তিনি ন্যাপ নেতা ছিলেন বটে, কিন্তু রাজনীতির শুরুতে তিনি কমিউনিষ্ট পার্টিরও একজন সদস্য ছিলেন।
১৯২২ সালে ১৪ এপ্রিল কুমিল্লার দেবিদ্বারে জন্ম নেন এই প্রবীণ রাজনীতিক। ১৯৫৪ সালে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপনা ছেড়ে রাজনীতিতে নিজেকে যুক্ত করেন। সামাজিক নানা বাস্তবতার কারণে জীবনের প্রায় শেষ সময়ে অনেকটা একাই কাটিয়েছেন তিনি। বলা চলে সমাজ থেকে নিজেকে একটু আলাদা করে রাখা। তবে সমাজ উন্নয়ন ও মানুষের মুক্তির চিন্তা থেকে কখনও দূরে সরে যাননি ৯৭ বছর বয়সী এই রাজনীতিবিদ।
দেশ স্বাধীন করতে ন্যাপ-কমিউনিষ্ট পার্টি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলা মোজাফফর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনেও ভূমিকা পালন করেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মন্ত্রিত্ব নিতে অস্বীকার করা মোজাফফর আহমদ; ২০১৫ সালে বাংলাদেশ সরকারের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা স্বাধীনতা পুরস্কারও তিনি নেননি।
মোজাফফরের শ্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক মোঃ আখতারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন কিংবদন্তি ছিলেন তিনি। বাংলাদেশের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, তার অবদান কোন না কোনভাবে আছে। তার লোভ-লালসাহীন রাজনীতি আগামী দিনের রাজনীতিবিদদের কাছে শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা নিবেদন পর্বের পর বায়তুল মোকাররমে জানাজা হয় অধ্যাপক মোজাফফরের। ন্যাপ নেতারা জানিয়েছেন, আজ রবিবার কুমিল্লার দেবিদ্বারে পারিবারিক কবরস্থানে শেষ শয্যা নেবেন এই রাজনীতিক।
শহীদ মিনারে আরও শ্রদ্ধা জানাতে আসেন বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দলের (জেএসডি) সভাপতি আ স ম আব্দুর রব, গণফোরাম, বিকল্পধারা, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, শিক্ষাবিদ মমতাজ রশিদ, মুক্তিযোদ্ধা শফিকুর রহমান, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়েশা খানম, শিরিন আখতার, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া, কামরুজ্জামান আনসারী, সুভাস সিংহ রায়, মুকুল চৌধুরী, ডাঃ শাহাদাত হোসেন প্রমুখ।