কাজিরবাজার ডেস্ক :
হাওর-বাঁওর, পাহাড়সহ দুর্গম এলাকা ও নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে দীর্ঘ ৮ বছর পর অবেশেষে এমপিওভুক্ত (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) হতে যাচ্ছে বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ মাসেই এমপিওর জন্য আড়াই হাজারেরও বেশি বেসরকারী স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশ করবে মন্ত্রণালয়। কাজ দ্রুত শেষ হলে এ সপ্তাহেও তালিকা প্রকাশ করা হতে পারে। গত ১ জুলাই থেকেই প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি কার্যকর হবে।
এমপিওর জন্য গঠিত ‘প্রতিষ্ঠান বাছাই কমিটি’র সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ১০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিওর জন্য আবেদন করলেও তাদের মধ্যে যোগ্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। প্রযোজ্য চার শর্ত শতভাগ পূরণ করতে পেরেছে খুব কম প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ যাচাই-বাছাই শেষে আড়াই হাজারের কিছু বেশি প্রতিষ্ঠানের তালিকা সংযুক্ত সার-সংক্ষেপ ইতোমধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য পাঠানো হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পর এ তালিকা প্রকাশ করা হবে। ১ জুলাই থেকেই প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি বাস্তবায়ন হবে।
জানা গেছে, গত বছরের ৫ আগষ্ট এমপিওভুক্তির লক্ষ্যে আবেদন গ্রহণ শুরু হয়। দীর্ঘ যাচাই-বাছাই শেষে চূড়ান্ত করা হয় দুই হাজার ৭শ’ মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে সাধারণ স্কুল ও কলেজ রয়েছে প্রায় এক হাজার সাত শ’। বাকি প্রতিষ্ঠান কারিগরি ও মাদ্রাসা। স্কুল ও কলেজ এমপিওভুক্তি করতে বছরে খরচ হবে প্রায় সাড়ে সাত শ’ কোটি টাকা। কারিগরি ও মাদ্রাসা এমপিওভুক্ত করতে লাগবে সাড়ে পাঁচ শ’ কোটি টাকা। কর্মকর্তারা বলছেন, যোগ্য প্রতিষ্ঠানই এমপিওভুক্ত হচ্ছে। নীতিমালা অনুসারেই সব কাজ হচ্ছে। ফলে এমন উপজেলাও রয়েছে যেখানে একটি প্রতিষ্ঠানও এমপিওভুক্তির তালিকায় নেই। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সোহরাব হোসাইন বলেছেন, পুরো তালিকা নিয়মের মধ্যেই হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের পরই পরিপত্র জারি করা হবে। তবে যেদিনই পরিপত্র জারি করা হোক না কেন গত ১ জুলাই থেকে তা কার্যকর হবে।
গত বছরের ৫ থেকে ২০ আগষ্ট বেসরকারী স্কুল ও কলেজের কাছ থেকে অনলাইনে এমপিওভুক্তির আবেদন নেয়া হয়। ৯ হাজার ৬১৪ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনলাইনে আবেদন করে। নতুন এমপিও’র জন্য চারটি শর্ত দিয়ে আবেদন করার নির্দেশ দেয়া হয়। শর্ত চারটি হলো প্রতিষ্ঠানের একাডেমিক স্বীকৃতির বয়স, শিক্ষার্থী সংখ্যা, পাবলিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ও পাসের হার। যেসব প্রতিষ্ঠান এসব শর্ত পূরণ করেছে তাদের মধ্য থেকে স্বয়ংক্রিয় গ্রেডিংয়ের মাধ্যমে তালিকা করে মন্ত্রণালয়।
নীতিমালা অনুযায়ী হাওড়, চরাঞ্চল, পাহাড়ী এলাকা, নারী শিক্ষা ও প্রতিবন্ধী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ শিক্ষায় অনগ্রসর এলাকার কিছু সংখ্যক প্রতিষ্ঠানকে শর্ত শিথিল করে এমপিওভুক্তির তালিকায় রাখা হয়েছে। এমপিও নীতিমালায় এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে বিশেষ বিবেচনায় শর্ত শিথিলের সুযোগ রয়েছে।
এমপিও নীতিমালা ২০১৮ অনুযায়ী, একটি প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্তি পেতে প্রধান চারটি শর্ত রাখা হয়েছে। এগুলোর জন্য রাখা হয়েছে ১০০ নম্বর। এতে একাডেমিক স্বীকৃতির তারিখের জন্য রাখা হয়েছে ২৫ নম্বর।
প্রতি দুই বছরের জন্য পাঁচ নম্বর এবং দশ বা তার বেশি বছর হলে পাবে ২৫ নম্বর। শিক্ষার্থীর কাম্য সংখ্যা থাকলে ওই প্রতিষ্ঠান পাবে ১৫ নম্বর এবং এর পরবর্তী ১০ শতাংশ বৃদ্ধির জন্য পাবে পাঁচ নম্বর, সর্বোচ্চ ২৫ নম্বর।
’১০ সালের পর থেকে এমপিওভুক্তি বন্ধ থাকায় দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করেছেন শিক্ষকরা। শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, বাজেটে অর্থ বরাদ্দ না থাকায় এমপিওভুক্তি করা যায়নি।
বর্তমানে দেশে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আছে ২৭ হাজার ৮১০। এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারীর সংখ্যা চার লাখ ৯৬ হাজার ৩৬২। প্রতি মাসে এদের বেতনভাতা বাবদ সরকারের খরচ হয় প্রায় সাড়ে নয় শ’ কোটি টাকা।
দেশে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে বেশি এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে রাজশাহী বিভাগে। এরপর রংপুর ও খুলনা বিভাগে। এখন পর্যন্ত বরিশাল বিভাগে এমপিওভুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে দুই হাজার ৭০১, চট্টগ্রামে দুই হাজার ১৫, কুমিল্লায় এক হাজার ৯৮৪, ঢাকায় তিন হাজার ২৭, খুলনায় তিন হাজার ৫৭৯, ময়মনসিংহে তিন হাজার ৫৭, রাজশাহীতে চার হাজার ১০৮, রংপুরে তিন হাজার ৯৯৭ ও সিলেট বিভাগে মাত্র এক হাজার ৮৯।
এমপিওর জন্য গঠিত ‘প্রতিষ্ঠান বাছাই কমিটি’র সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রায় ১০ হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এমপিও’র জন্য আবেদন করলেও তাদের মধ্যে যোগ্য প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। এমপিও’র জন্য প্রযোজ্য চার শর্ত শতভাগ পূরণ করতে পেরেছে দুই হাজারেও কম প্রতিষ্ঠান। তবে দীর্ঘদিন এমপিও বন্ধ থাকার কথা বিবেচনায় নিয়ে আরও কিছু প্রতিষ্ঠানকে এমপিওভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। কমিটির একাধিক সদস্য জনকণ্ঠকে বলেছেন, হাওড়-বাঁওড়, পাহাড়ীসহ দুর্গম এলাকা ও নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে অগ্রাধিকার দিয়ে তালিকা করায় মোট প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কিছুটা কেড়েছে।
২০১০ সালের পর গত ৮ বছরে এমপিওভুক্ত হয়নি কোন বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। অথচ এই সময়ে ৭ হাজারেরও বেশি বেসরকারী স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ১০ সালের আগে একাডেমিক স্বীকৃতি পাওয়া নন-এমপিও প্রতিষ্ঠানও আছে প্রায় তিন হাজার। সব মিলিয়ে ১০ হাজারেরও বেশি সরকার স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান আছে এমপিও’র অপেক্ষায়। এসব প্রতিষ্ঠানের কয়েক লাখ শিক্ষক কর্মচারী বছরের পর বছর ধরে অপেক্ষা করছেন এমপিওর জন্য। ১১ সাল থেকেই চলছে এমপিও’র দাবিতে আন্দোলন। বিভিন্ন সময় এমপি নিজ এলাকার প্রতিষ্ঠান এমপিও’র জন্য একই দাবিতে সোচ্চার হয়েছেন। তবে শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবার নিশ্চিত করছে এমপিও নিয়ে অপেক্ষার অবসান হচ্ছে।
এমপিওর দাবিতে বহুদিন ধরে আন্দোলন করছে এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীদের সংগঠন ‘নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী ফেডারেশন’। ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে আছেন অধ্যক্ষ গোলাম মাহামুদুন্নবী ডলার ও সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ ড. বিনয় ভূষণ রায়। সম্প্রতি এ ইস্যুতে শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকও করেন নেতারা। তারা বলছেন, এ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় যেহেতু প্রধানমন্ত্রী নিজে বলেছেন যে এমপিওভুক্তির জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের জোগান রাখা হয়েছে, তাই আমরা আশা করব সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একযোগে এমপিওভুক্ত করা হবে। সরকারের পক্ষ থেকে একটি প্রতিষ্ঠানের স্বীকৃতিই এমপিওভুক্ত হওয়ার প্রধান যোগ্যতা। এখানে অন্য কোন মানদন্ড বিবেচনায় আসতে পারে না।