কাজিরবাজার ডেস্ক :
হঠাৎ ‘ছেলেধরার গুজব রটিয়ে গণপিটুনির নামে দেশের পরিস্থিতি অশান্ত করার নেপথ্যে কারা? তাদের চিহ্নিত করতে মাঠে নেমেছে পুলিশ ও গোয়েন্দারা। পুলিশ ইতোমধ্যে গণপিটুনির নেপথ্য নায়কদের বিশেষ ‘কুচক্রী মহল’ বলে ঘোষণা দিয়েছে। গত ক’দিনে ছেলেধরার গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনির সঙ্গে জড়িত ক’জনকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, তাদের জিজ্ঞাসাবাদে এ গুজবের নেপথ্য নায়কদের খুঁজে বের করা হবে।
এদিকে একের পর এক গণপিটুনির ঘটনায় জনমনে চরম আতঙ্ক বিরাজ করছে। গণপিটুনিতে সাধারণের কোন বিচার বা শাস্তি হয় না বলেই এ ধরনের অপরাধ ঘটছে বলে অপরাধ বিশেষজ্ঞদের ধারণা। তাদের মতে, প্রকাশ্যে শত শত লোকের সামনে খুন করেও নির্বিঘেœ পার পেয়ে যাওয়ার এক ভয়ঙ্কর হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে ‘গণপিটুনি’। মামলার এজাহারে শুধু ‘গণপিটুনি’ বা গণ শব্দটি থাকলেই যেন সাতখুন মাফ! এর কোন তদন্ত হয় না, চার্জশীট হয় না, বিচারিক প্রক্রিয়ায় শাস্তি তো দূর অস্ত। গত এক দশকের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, গণপিটুনির কোন একটি মামলারও বিচার সম্পন্ন হওয়ার নজির নেই। এ সম্পর্কে এক সাবেক আইজিপি বলেন, বাংলাদেশ দন্ডবিধিতে গণপিটুনি নামের কোন শব্দই নেই। সাবেক আইজিপি নুরুল আনোয়ার বলেন, গণপিটুনি নামে কোন অপরাধের সংজ্ঞাই নেই বাংলাদেশ দন্ডবিধিতে। কাজেই গণপিটুনির মতো জঘন্য অপরাধকে আলাদা করে বিশেষায়িত করে বেনিফিট নেয়ার কোন অবকাশ নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দন্ডবিধিতে গণপিটুনির কোন সংজ্ঞা না থাকলেও মানুষের মাঝে বদ্ধমূল ধারণা গণপিটুনি দিয়ে কাউকে হত্যা করলে ঘাতকদের কোন দায় থাকে না। খুন করেও সহজেই পার পাওয়া যায়। উপযুক্ত সাক্ষী প্রমাণ থাকায় গণপিটুনিতে অংশগ্রহণকারীরা শাস্তি থেকে রক্ষা পেয়ে যায়। সাবেক এই পুলিশ প্রধানের মতে- গণপিটুনির ক্ষেত্র তৈরির সবচেয়ে মোক্ষম কৌশল হচ্ছে ‘গুজব’ রটানো। গুজব রটিয়ে মানুষকে যত সহজে উত্তেজিত বা ক্ষেপিয়ে তোলা যায় অন্য কোন পন্থায় তা ততো সহজ নয়। এ জন্য দেশের অধিকাংশ গণপিটুনির নেপথ্যে গুজবকে মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগানো যায়।
আরও ভয়ঙ্কর তথ্য মিলেছে গণপিটুনির নামে অনেক ক্ষেত্রেই চলে পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি পূর্বপাড়া আল-আমিননগরে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নিহত হন সিরাজ। তাকে পরিকল্পিত হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি সিরাজের ভাই ও এলাকাবাসীর। সহজ-সরল এ প্রতিবন্ধীর হত্যাকারীদের বিচার দাবি করে এলাকায় মিছিল হওয়ার পর পুলিশের টনক নড়ে।
গণপিটুনির ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য পুলিশ সদর দফতর, মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও আইন মন্ত্রী দেশবাসীকে সতর্ক হওয়ার আহŸান জানিয়েছেন। তারা বলছেন, গণপিটুনিতে যারাই অংশ নেবে তাদেরই আইনের আওতায় আনা হবে। কারণ গণপিটুনি সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ। কেউ আইন নিজের হাতে তুলে নিতে পারে না।
গণপিটুনি আর আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার সম্পর্ক বিষয়ে সাবেক আইজিপি নুরুল আনোয়ার বলেন, বাংলাদেশ দন্ডবিধিতে কোথাও গণপিটুনি শব্দটি লেখা নেই। পিটুনি শব্দটি রয়েছে। সেটা হাল্কা হতে পারে, মারাত্মক হতে পারে ও ভয়ঙ্কর হতে পারে। আঘাতের ধরনভেদে সাত বছর, দশ বছর ও যাবজ্জীবনের মতো শাস্তি হতে পারে। আবার হত্যার ধরন হতে পারে দু’ধরনের। পরিকল্পিত ও উদ্ভূত পরিস্থিতিজনিত হত্যাকান্ড। ঠান্ডামাথায় কাউকে সুপরিকল্পিত হত্যা করার বিচার করা হয় দন্ডবিধি ৩০২ ধারায়। অন্যদিকে হঠাৎ উদ্ভূত পরিস্থিতির যেমন পাখি শিকার করতে গিয়ে বন্দুকের গুলিতে ভুলে কাউকে মেরে ফেলা, অসাবধানবশত গাড়ি চালিয়ে কাউকে হত্যা কিংবা ভুলক্রমে কাউকে মেরে ফেলার অপরাধের বিচার হয় ৩০৪ ধারায়। কিন্তু গণপিটুনি দিয়ে কাউকে হত্যা করার বিচারও ৩০২ ধারায় করতে হয়। গণপিটুনির যেহেতু কোন আলাদা সংজ্ঞা বিশেষায়িত করা হয়নি দন্ডবিধিতে সেহেতু এটাকে সরাসরি হত্যাকান্ড হিসেবে দেখতে হবে। যারা এতে জড়িত তাদের সবাইকে মামলায় আসামি করে বিচারের মুখোমুখি করা আবশ্যক। হামলাকারীর সংখ্যা বেশি না হলেও তারা কেউই দায় এড়াতে পারবে না। বাড্ডার ঘটনায় পুরো হত্যাকান্ডের ভিডিও ফুটেজে হামলাকারীরা সুস্পষ্ট, চিহ্নিত। তারা কতটা পৈশাচিক কায়দায় রেণুকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আঘাত করেছে, মৃত্যুর পরও তার শরীরে আঘাত করতে দেখা যায়। গুটিকয়েক হামলাকারী এতে অংশ নেয়। বাকিরা সবাই ছিল নীরব দর্শক। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে যারা নীরব দর্শক ছিল তারা কতটা অপরাধী। দন্ডবিধিতে বলা আছে, কাউকে হত্যা করতে দেখা গেলে বা চোখের সামনে এমন ঘটনা পড়ে গেলে তার দায়িত্ব ভিকটিমকে উদ্ধারের চেষ্টা করা বা হামলাকারীদের বিরত রাখা। এটা না করে নীরব দর্শকের মতো হামলার ঘটনা দেখে মজা নেয়াটা হামলাকারীদের উৎসাহ না মদদ দেয়া যা অবশ্যই অপরাধ। আর দলবেঁধে হত্যাকান্ডের আদ্যন্ত নীরব দর্শকের মতো দেখা যেটা চলমান গণপিটুনিতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে-তা আরও বড় অপরাধ। বাড্ডায় রেণুকে পেটানোর সময় ১০/১২ জনকে সরাসরি আঘাত করতে দেখা গেছে। বাকিরা তাতে সমর্থন দিয়েছে। এখানে উভয়পক্ষই ঘাতক। যাদের হত্যার দায় নিতেই হবে।
এদিকে পুলিশের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত দুই দশকে সারাদেশে অন্তত ৫০টি গণপিটুনির ঘটনায় কমপক্ষে তিন শতাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটেছে। এসব ঘটনায় কারোর কোন সাজা হওয়ার নজির নেই। বিচার হয় না বলেই গণপিটুনি ক্রমশ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছে। পুলিশ প্রশাসন শুরু থেকেই আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়ার আহŸান জানিয়ে একে ফৌজদারি দন্ডবিধির মতো অপরাধ বলে সবাইকে হুঁশিয়ারি করেছে। পুলিশ কাউকে সন্দেহ হলে গণপিটুনি নয়, ৯৯৯ এ জানাতে পরামর্শ দিয়েছে। গুজবে গণপিটুনি ঠেকাতে সারাদেশে এসপিদের কাছে বার্তা পাঠানো হয়েছে। গুজব ছড়ানো এবং আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া যে দন্ডনীয় অপরাধ, সে বিষয়েও নাগরিকদের সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। সোমবার এক তথ্য বিবরণীতে গুজব ও গণপিটুনি নিয়ে এই সতর্কবার্তা দেয়া হয়। তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, একটি স্বার্থান্বেষী মহল গুজব ছড়িয়ে ছেলেধরা সন্দেহে নিরীহ মানুষ পিটিয়ে হতাহত করা সংক্রান্ত খবরের প্রতি সরকারের দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। ভিত্তিহীন ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত যে কোন ধরনের গুজব ছড়ানো ও আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া দেশের প্রচলিত আইনের পরিপন্থী ও গুরুতর দন্ডনীয় অপরাধ।
এতে আরও বলা হয়, কোন বিষয়ে কাউকে সন্দেহজনক মনে হলে নিজের হাতে আইন তুলে না নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানানোর জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। এ ধরনের পরিস্থিতিতে ৯৯৯ এ কল করে দ্রুত পুলিশের সাহায্য নেয়া যেতে পারে।
কারও গতিবিধি সন্দেহজনক হলে অথবা কেউ যদি অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকে তাহলে জনসাধারণের কাজ হচ্ছে তাকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে সোপর্দ করা। আইন হাতে তুলে নেয়ার কোন সুযোগ নেই। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি আস্থাহীনতায়ই মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নেয়- এমন অভিযোগও আছে। এই আস্থার সঙ্কট দূর করতে হবে। কেউ যেন কোন গুজব রটাতে না পারে সেদিকেও জোর নজর দিতে হবে। যে কোন মূল্যে গণপিটুনিতে হত্যা বন্ধ করতে হবে। না হলে যে কেউ যে কোন স্থানে এর শিকার হতে পারে।
সোমবার পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক সাঈদ তারিকুল হাসান সারাদেশের পুলিশের ইউনিটকে এই বার্তা পাঠান। বার্তায় উলেখ করা হয়, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ব্লগ এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ছেলেধরা-সংক্রান্ত বিভ্রান্তিমূলক পোস্টে মন্তব্য বা গুজব ছড়ানোর পোস্টে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে হবে। বার্তায় মোট চারটি উপায়ে ছেলেধরার গুজব ও গণপিটুনি প্রতিরোধে পুলিশের ইউনিটগুলোকে কাজ করার নির্দেশনা দেয়া হয়। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি, স্কুলে অভিভাবক ও গবর্নিং বডির সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময়, ছুটির পর অভিভাবকরা যাতে শিক্ষার্থীকে নিয়ে যায়, সে বিষয়েও নিশ্চিত করার জন্য স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা, প্রতিটি স্কুলের ক্যাম্পাসের সামনে ও বাইরে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন, মেট্রোপলিটন ও জেলা শহরের বস্তিতে নজরদারি বৃদ্ধির নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
এ দিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেলেধরা ও মাথাকাটার গুজব ছড়ানো কুচক্রী মহলের বড় ষড়যন্ত্রের অংশ বলে জানিয়েছেন ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম। ডিএমপির মিডিয়া সেন্টারে সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ কথা জানান তিনি। মাহবুব আলম বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেলেধরা গুজবকে ভিত্তি করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নির্যাতন ও খুনের ঘটনা ঘটেছে। গুজব ছড়িয়ে এমন অপকর্মের নেপথ্যে একটি চক্র কাজ করতে পারে। তাদের বড় একটি ষড়যন্ত্রের অংশ এ ছেলেধরা গুজব। তারা গুজব রটিয়ে বিশেষ ফায়দা নেয়ার চেষ্টা করছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে খারাপ করার জন্য এ অপচেষ্টা।