অবশেষে রংপুরের পল্লী নিবাসেই হলো এরশাদের শেষ ঠিকানা

32

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বহু নাটকীয়তার পর অবশেষে কর্মী-সমর্থক তথা রংপুরবাসীর ইচ্ছারই প্রতিফলন ঘটল। তাদের দাবি ছিল, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদকে যেন রংপুরেই সমাহিত করা হয়। রংপুরের বাসভবন পল্লীনিবাসের লিচু বাগানে সোমবার বিকেলে যে কবর খনন করা হয়েছিল সেখানেই মঙ্গলবার সন্ধ্যা পৌনে ছয়টায় দাফন করা হয় তাকে। এর আগে সেনাবাহিনীর একটি বিশেষ দল তাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গার্ড অব অনার প্রদান করে এবং তার সম্মানে এক মিনিট নীরবতা পালন করে।

রংপুরে সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জানাযার নামাজের একাংশ।

৯০’র এর গণঅভ্যুত্থানে পতিত সামরিক শাসক এরশাদ ৯০ বছর বয়সে গত রবিবার ইন্তেকাল করার পর তাকে বনানীতে সেনা কবরস্থানে দাফনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল দলের পক্ষ থেকে। কিন্তু শুরু থেকেই রংপুরে দাফনের দাবি জানাচ্ছিলেন জাতীয় পার্টির জেলার নেতারা। মঙ্গলবার দুপুরে লাশ জানাযার জন্য রংপুরে নেয়ার পর আগের সিদ্ধান্তে বাদ সাধেন তারা। নাটকীয়তার পর দুপুরে রংপুর শহরের কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠে জানাযা শেষে এরশাদের কফিন আর ঢাকায় না ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় এরশাদের বাড়ি পল্লীনিবাসে। জাতীয় পার্টির প্রেস উইং থেকে এক বিবৃতিতে তখন বলা হয়, ‘রংপুরের গণমানুষের আবেগ, ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতাবোধে শ্রদ্ধা জানিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে রংপুরেই দাফন করতে অনুমতি দিয়েছেন বেগম রওশন এরশাদ এমপি। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের কবরের পাশে বেগম রওশন এরশাদের জন্য কবরের জন্য জায়গা রাখতেও অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।’ এরশাদের স্ত্রী রওশন জাতীয় পার্টির জ্যেষ্ঠ কো-চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন, সংসদে বিরোধীদলীয় উপনেতাও তিনি। মঙ্গলবার সকালে জানাযার জন্য এরশাদের কফিন নিয়ে রংপুরের উদ্দেশে রওনা দেয়ার আগে তার ভাই জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের সেনা কবরস্থানে দাফনের কথাই জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘উনার শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী বনানীতে সেনাবাহিনীর কবরস্থানেই তাকে সমাহিত করা হবে। এই কবরস্থান ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় হলেও যে কোন সময় যে কেউ সেখানে যেতে পারে।’
ঢাকা সিএমএইচ থেকে এরশাদের কফিন নিয়ে বেলা পৌনে ১২টার দিকে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে পৌঁছায় বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার। ততক্ষণে রংপুর শহরের কালেক্টরেট ঈদগাহ মাঠ ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে রংপুর জেলা পুলিশ। এরশাদের কফিন দুপুরে ঈদগাহ মাঠে নেয়ার পর জানাযার আগে বক্তৃতায় রংপুরের মেয়র ও জাতীয় পার্টির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোস্তাফিজার রহমান মোস্তফা যুক্তি দেন, বনানীর সেনা কবরস্থানে এরশাদকে দাফন করা হলে পরে দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা সহজে সেখানে যেতে পারবেন না, শ্রদ্ধা নিবেদন করতে পারবেন না। এরশাদ নিজেই রংপুরে শায়িত হতে চেয়েছিলেন- এমন দাবি করে সোমবারই পল্লী নিবাসের পাশে লিচুবাগানে কবর খুঁড়ে রাখেন রংপুরের নেতাকর্মীরা। মেয়র মোস্তফা তাদের নেতাকে রংপুরে দাফন করার দাবি আবারও তুলে ধরেন। এরপর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান জি এম কাদের বক্তব্য দিতে শুরু করলে মাঠে উপস্থিত হাজার হাজার নেতাকর্মী হট্টগাল শুরু করেন। এরশাদকে রংপুরে দাফন করার দাবিতে তারা স্লোগান দিতে থাকেন। মিনিট বিশেক এই পরিস্থিতি চলার পর বেলা ২টা ২৫ মিনিটে জানাযা শুরু হয়। জানাজার পরপরই রংপুরের নেতাকর্মীরা এরশাদের মরদেহবাহী গাড়ি ঘিরে ফেলেন এবং রংপুরে দাফনের দাবিতে স্লোগান ধরেন।
এক পর্যায়ে মেয়র মোস্তফা ওই গাড়িতে উঠে পড়েন এবং বিকেল তিনটায় এরশাদের মরদেহ নিয়ে ওই গাড়ি তার বাড়ি পল্লীনিবাসের দিকে রওনা হয়। এই পরিস্থিতিতে জি এম কাদের ও রাঙ্গা দুজনেই সিদ্ধান্ত বদলের কথা জানিয়ে বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদের দাফন রংপুরেই হবে। প্রায় একই সময় জাতীয় পার্টির প্রেস উইং থেকে পাঠানো বিবৃতিতে বলা হয়, ‘রংপুরের গণমানুষের ভালবাসা উপেক্ষা করা সম্ভব নয়। তাদের আবেগ ও অনুরাগেই রংপুরে পল্লীবন্ধুকে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।’ এই সিদ্ধান্তের পর সেনাবাহিনীর একটি প্রতিনিধি দল পল্লী নিবাসের পাশে এরশাদের বাবার নামে গড়া মকবুল হোসেন জেনারেল এ্যান্ড ডায়াবেটিক হাসপাতাল সংলগ্ন লিচু বাগানে কবরের স্থানটি পরিদর্শন করেন।
দাফনের আগে সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান এরশাদকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। তার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সেনাবাহিনীর রংপুর ৬৬ পদাতিক ডিভিশনের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল নজরুল ইসলাম। এরশাদকে রংপুরে দাফনে সন্তোষ জানিয়ে নীলফামারী জেলা জাতীয় পার্টির সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদুল ইসলাম শহীদ বলেন, ‘এটাই ভাল সিদ্ধান্ত হয়েছে। রংপুরে কবর হওয়ায় স্যারের আত্মা শান্তি পাবে।’
গাজীপুর মহানগর জাতীয় পার্টির সহসভাপতি তসলিম উদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘রংপুরে স্যারকে কবর দেয়ার সিদ্ধান্তই সঠিক হয়েছে। তিনি সারাদেশের নেতা হলেও আসলে তো তিনি রংপুরের সন্তান। আমরা চেয়েছিলাম উন্মুক্ত স্থানে কবর হোক। রংপুর অনেক দূরে। তবুও তো আমরা যখন খুশি যেতে পারব।’ জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ফারুক শেঠ বলেন, ‘আমাদের প্রিয় নেতাকে রংপুরে দাফনের সিদ্ধান্ত যথাযথ হয়েছে।’
কুলখানি বুধবার : এরশাদের কুলখানি বুধবার অনুষ্ঠিত হবে বলে জানিয়েছে জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টির প্রেস উইং থেকে জানানো হয়েছে, বুধবার বাদ আছর গুলশানের আজাদ মসজিদে কুলখানি অনুষ্ঠিত হবে।
শোক বইয়ে স্বাক্ষর : এরশাদের মৃত্যুর পর কাকরাইলে জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় অফিস ও বনানীতে এরশাদের রাজনৈতিক কার্যালয়ে শোক বই খুলেছিল জাতীয় পার্টি।
বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও দূতাবাসের প্রতিনিধিরা বনানীতে এসে শোকসন্তপ্ত নেতাদের পাশে দাঁড়ান বলে জানিয়েছে জাপা। মঙ্গলবার বেলা ১১টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বনানী অফিসে এসে তারা শোক বইয়ে স্বাক্ষর করেন তুরস্ক, সুইডেন, মাল্লীপ, ভ্যাটিক্যান সিটির রাষ্ট্রদূত। এছাড়াও মালয়েশিয়ার ভারপ্রাপ্ত হাই কমিশনার, ওমানের চার্জ দ্য এ্যাফেয়ার্স, জাপানের চার্জ দ্য অফেয়ার্স, রাশিয়ার প্রথম সচিব, থাইল্যান্ডের চার্জ দ্য এ্যাফেয়ার্স, আরব আমিরাত দূতাবাসের প্রতিনিধি, সৌদি আরব দূতাবাসের প্রতিনিধি, নেপাল দূতাবাসের প্রতিনিধি, নরওয়ে দূতাবাসের প্রতিনিধি, ফ্রান্স দূতাবাসের প্রতিনিধি বনানী অফিসে এসে শোক বইয়ে স্বাক্ষর করেন।
উল্লেখ্য, জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, সাবেক রাষ্ট্রপতি ও সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ গত ১৪ জুলাই ঢাকায় সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন ইন্তেকাল করেন। তার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। গত ২৬ জুন থেকে এরশাদ সিএমএইচে চিকিৎসাধীন ছিলেন। হিমোগ্লোবিন স্বল্পতা, ফুসফুসে সংক্রমণ ও কিডনির জটিলতায় ভুগছিলেন তিনি। রবিবার বাদ জোহর ঢাকা সেনানিবাস কেন্দ্রীয় মসজিদে তার প্রথম জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। সোমবার বেলা ১১টায় জাতীয় সংসদ ভবনে এরশাদের দ্বিতীয় জানাযা অনুষ্ঠিত হয়। ওই জানাজায় অংশ নেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদসহ মন্ত্রী সভার সদস্য এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে তার সামরিক সচিব শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। স্পীকারের পক্ষে সংসদের সার্জেন্ট এ্যাট আর্মস শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। পরে সোমবার বাদ আসর বায়তুল মোকাররমে তৃতীয় জানাযা পড়ান ওই মসজিদের সিনিয়র পেশ ইমাম হাফেজ মাওলানা মুহাম্মদ মিজানুর রহমান।