সুনামগঞ্জে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত, বিদ্যালয় বন্ধ, ত্রাণ পায়নি মানুষ

128

একে কুদরত পাশা সুনামগঞ্জ থেকে :
ভারী বর্ষণ ও উজানে পাহাড়ি ঢল অব্যাহত থাকায় সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। সুনামগঞ্জে সুরমা নদীর পানি বিপৎসীমার ৮৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলার অন্যান্য নদী ও হাওরে পানি বাড়ছে। প্লাবিত হচ্ছে নতুন নতুন এলাকা। এলাকাগুলোতে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট দেখা দিয়েছে। এতে জেলার বিভিন্ন উপজেলা বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এসব উপজেলার সড়ক, ঘরবাড়ি, ব্যবসা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্লাবিত হয়েছে। স্থগিত করা হয়েছে জেলার শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠদান। জেলা সদর থেকে তাহিরপুর, বিশ্বম্ভরপুর ও সাচনা বাজারের সড়ক পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। উঁচু স্থানের সন্ধান করছে মানুষ ইতোমধ্যে তাহিরপুর জনতা উচ্চ বিদ্যালয় সহ বিভিন্ন বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে বন্যা কবলিত মানুষ। তবে এখনো ত্রাণ সামগ্রি পৌছায়নি মানুষের হাতে।
গত কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার ১১টি উপজেলার মধ্যে আটটি বন্যাকবলিত হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খারাপ অবস্থা তাহিরপুর ও তাহিরপুর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার। এই দুই উপজেলার সঙ্গে জেলা সদরের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তবে জেলা প্রশাসনের হিসাব অনুযায়ী, বন্যায় জেলার পাঁচটি উপজেলায় ১৬ হাজার পরিবারের ৮০ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে।

প্রবল বর্ষণে পাহাড়ি ঢলে হাওরের প্রবল ঢেউ উপেক্ষা করে ধানকুনিয়া-সাস্কা হাওর ঝুঁকিপূর্ণ নৌকায় পাড়ি নিয়ে ধর্মপাশার গোলকপুরের হাজী আব্দুল হাফেজ স্কুল এন্ড কলেজে যাচ্ছে বাবুপুর নুরপুর সহ কয়েক গ্রামের শিক্ষার্থীরা।

এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা যায়, গত ২০ বছরের মধ্যে উজান থেকে এত ব্যাপক পরিমাণে ঢল নামেনি। রাস্তাঘাট, ঘরবাড়ি, বাজার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। মানুষজন অসহায় হয়ে পড়েছে। কিন্তু প্রশাসন বন্যা হয়নি বলে ঢিলেমি করছে। বৃষ্টি বন্ধ না হলে মানুষের ভাগ্যে কি আছে বলা যাচ্ছে না। এভাবে বৃষ্টি চলতে থকালে সকল গ্রাম ডুবে যাবে। মানুষ যাবে কোথায় তাও জানে না। কারণ হাওরে কোন বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র নেই।
তাহিরপুর উপজেলার চেয়ারম্যান করুণা সিন্ধু চৌধুরী বলেন, উপজেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর যেগুলোতে পানি ওঠেনি, সেগুলো আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। কিছু কিছু স্কুলে বন্যাকবলিত লোকজন আশ্রয় নিয়েছে। এই মুহূর্তে মানুষের শুকনো খাবার প্রয়োজন। তাঁরা বিষয়টি জেলা প্রশাসনকে জানিয়েছেন। জেলার দিরাই, শাল্লা, দোয়ারাবাজার, জামালগঞ্জ, ধরমপাশা উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বাড়িঘরে বন্যার পানি প্রবেশ করায় মানুষ ভোগান্তিতে পড়েছে।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. জিল্লুর রহমান জানান, জেলার বিভিন্ন উপজেলার ২০০ শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়েছে। এর মধ্যে ১০১টি বিদ্যালয়ে পাঠদান স্থগিত করা হয়েছে। অবস্থার উন্নতি হলে আবার পাঠদান শুরু হবে। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তাঁরা কোনো স্কুল প্লাবিত হলে বা শিক্ষার্থীদের জন্য ঝুঁকি মনে করলে, সেটির পাঠদান স্থগিত করতে পারবেন।
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ বলেছেন, জেলায় নদী ও হাওরে পানি বাড়ছে। কোথাও কোথাও বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্র পস্তুত রাখা হয়েছে। কেউ চাইলে সেখানে যেতে পারবেন। একই সঙ্গে বন্যাকবলিত মানুষের মধ্যে শুকনো খাবার বিতরণ করা হচ্ছে। বন্যা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়া আছে।
এদিকে বাবরুল হাসান বাবলু জানিয়েছেন : তাহিরপুরে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি শতাধিক গ্রামের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানি বন্ধি। উপজেলার সকল আভ্যন্তরীণ সড়ক পানিতে নিমজ্জিত থাকায় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন, বন্ধ রয়েছে শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, পানির থোরে ভেসে গেছে যাদুকটা নদীর ৫ শতাধিক ব্যবসায়ীর আনুমানিক ১৫ কোটি টাকার মজুদকৃত বালি।
সরজমিন বন্যা আক্রান্ত গ্রামগুলোতে গিয়ে দেখা যায় অনেক বাড়ি ঘরের উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পাহাড়ি ঢলের পানি। অনেক বাড়ি ঘর রয়েছে পানিতে নিমজ্জিত। ঘরে পানি প্রবেশ করায় রান্না করতে গিয়ে বন্যা আক্রান্ত পরিবারগুলো পড়ছেন চরম বিপাকে। আভ্যন্তরীণ সড়ক গুলো পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় উপজেলা সদর ও জেলা সদরের সাথে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা একেবারে বন্ধ রয়েছে। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাতায়াতের বাহন হয়েছে নৌকা, পানিতে নিমজ্জিত থাকায় শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে বন্ধ। একই সাথে যাদুকাটা নদীর দু’তীরে ৫ শতাধিক ব্যবসায়ীর মজুদকৃত ৭০ থেকে ৮০ লক্ষাধিক ফুট বালি পাথর ঢলের পানির থোরে ভেসে গেছে। এতে ব্যবসায়ীদের আনুমানিক ১৫ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে একাধিক ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ও স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেছে। পানিবন্ধি শতাধিক গ্রামগুলোর মধ্যে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হলো বালিজুরী, বড়খলা, আনোয়ারপুর, সোহালা, মাহতাবপুর, পিরিজপুর, দক্ষিণকুল, চিকসা, চানপুর, মাহরাম, নোয়াহাট, পাতারগাঁও, ধরুন্দ, ইউনুছপুর, লক্ষ্মীপুর, চিকসা অন্যতম।
বালিজুরী ইউপি সদস্য দক্ষিণকুল গ্রামের বাসিন্দা বাবুল মিয়া বলেন, হঠাৎ করে রাতের বেলা বাড়ি ঘরে ঢলের পানি ঢুকে পড়লে তখন দিশেহারা হয়ে ওঠা ছাড়া কিছুই করার থাকে না, বর্তমানে পানির মধ্যে আমাদের আতংকে দিনরাত কাটাতে হচ্ছে।
বাদাঘাট ইউনিয়ন পাতারগাঁও সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক স্বপন কুমার রায় বলেন, বন্যার পানি গত ৩ দিন ধরে বিদ্যালয় ভবনের ভেতর প্রবেশ করেছে। একই অবস্থায় রয়েছে আরো শতাধিক বিদ্যালয়ে।
বাদাঘাট ইউনিয়ন পরিষদ সাবেক চেয়ারম্যান ও যাদুকাটা নদীর বালি পাথর ব্যবসায়ী রাখাব উদ্দিন বলেন, ঢলের পানির থোরে তার মজুদকৃত লক্ষাধিক ফুট বালু পানিতে ভেসে গেছে, যার বাজার মূল্য প্রায় ১৮ লক্ষ টাকা। একই অবস্থার কথা জানান আরও অনেকে।
তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ সাবেক চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট বন্যায় তাহিরপুরে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হওয়ার সংবাদ পেয়েছি। পানি বন্ধি একাধিক গ্রাম তিনি সরজমিন ঘুরে দেখেছেন এবং পানি বন্ধি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষজনের পাশে দাঁড়ানোর জন্য সরকারের ঊধ্বর্তন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।