ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ আলী
নির্বাচনী ইশতেহারে সবচেয়ে চমকপ্রদ এবং দীর্ঘস্থায়ী কাজ হলো বাংলাদেশের প্রত্যেক ইউনিয়ন হেড কোয়ার্টারকে একটি পরিপূর্ণ উপশহরে রূপান্তরকরণ। পদ্মা সেতু যেমন ১৬ কোটি মানুষের সুদীর্ঘ দিনের স্বপ্ন, যা বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে, তেমনি প্রত্যেক ইউনিয়ন হেড কোয়ার্টারে একটি উপশহর গড়ে উঠলে মানুষের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নসহ লাখ লাখ লোকের কর্মসংস্থান এবং জীবনমান উন্নয়ন হবে। এ কাজটি বাস্তবায়ন করতে পারলে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন হবে এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্বের দরবারে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। ৮৭ হাজার ৩১৬ গ্রামের উন্নয়নই বাংলাদেশের উন্নয়ন। সুষ্ঠু উন্নয়ন পরিকল্পনা বদলে দিতে পারে প্রতিটি গ্রামকে, একই সঙ্গে দেশের কাক্সিক্ষত উন্নয়নের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সহায়ক হবে। আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সাধনে যে সকল কর্মপরিকল্পনা সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে তার একটি প্রস্তাবনা।
কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের আগে নেতিবাচক বিষয়সমূহের প্রতি নজর দেয়া প্রয়োজন। পেশাগত বিষয়টি লক্ষ্য করলে দেখা যায় প্রাইমারী, সেকেন্ডারি ও টারসিয়ারিÑ এ তিন পেশার মধ্যে গ্রামের ৮০ ভাগই প্রাইমারী বা উৎপাদনের সঙ্গে সম্পৃক্ত, ১০ ভাগ সেকেন্ডারি ও অন্যান্য পেশা। রাতারাতি পেশা পরিবর্তন করা যাবে না। যারা চাষাবাদের সঙ্গে জড়িত তারা চাষাবাদ করবে তবে তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবাসহ আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দিতে হবে। বর্তমান সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এসব সুযোগ-সুবিধা পৌঁছে দিতে কাজ করছে এবং বিষয়টিকে আরও নিবিড়ভাবে করতে হবে।
বিপণি বিতান, কলকারখানা স্থাপন করে শহরের রূপ দেখা যায়, এক্ষেত্রে গ্রামীণ জনপদের স্বাভাবিক পরিবেশ বিঘ্ন ঘটবে। কেন মানুষ শহরমুখী হতে চায় এবং শহরে আসতে বাধ্য হয় বিষয়টি বিশ্লেষণ করলে সহজে অনুমান করা যায় যে, স্বাস্থ্যসেবা, কর্মসংস্থানের সুযোগ এবং চাহিদামতো উপকরণ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা শহরে রয়েছে। উপশহর গড়ে তোলার কর্মপরিকল্পনায় এ সব বিষয় বিবেচনায় এনে দেখা যায়-
ই-সেবা কেন্দ্র চালু করা, যাকে আমরা ওয়ান স্টপ সার্ভিস বলতে পারি। সরকারী সেবা প্রাপ্তির সুবিধা ছাড়াও সহযোগী সেবা কেন্দ্র চালু করা।
একটি মডেল উপশহরের নিম্নলিখিত স্থাপনা, সুযোগ-সুবিধা থাকতে হবে।
১. একটি ভূমি অফিস যেখানে একজন সহকারী কমিশনার/সাব রেজিস্টার থাকবে। প্রত্যেক এলাকা জনসাধারণের জমিজমা সংক্রান্ত সকল কাজ নাগালের ভেতর থাকবে।
২. সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, কারিগরি) মনিটরিং করার সাব অফিস থাকবে।
৩. ইউনিয়ন পরিষদ ভবনের সঙ্গে একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র ও কমিউনিটি সেন্টার থাকবে।
৪. ধর্মীয় উপাসনালয়।
৫. খেলার মাঠ (মিনি স্টেডিয়াম)।
৬. পশু চিকিৎসা কেন্দ্র।
৭. বর্তমান বাজারকে সংস্কার, বাজারের ভেতরের রাস্তা কাঁচাবাজার, মাছের ইত্যাদি কনক্রিট দ্বারা পাকা করতে হবে।
৮. ডিপটিউবওয়েল স্থাপন করে সুপেয় পানির ব্যবস্থা করা।
৯. কমপক্ষে ৩-৪টি পাবলিক টয়লেট স্থাপন করে পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা।
১০. বিদ্যুতের লাইনগুলো সংস্কার করে গ্রামে গ্রামে বিদ্যুত পৌঁছানো।
১১. বিদ্যুতের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিতকরণে কৃষি কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি মেরামতের কারখানা, মোটরসাইকেল, সাইকেল, রিক্সা ও অটোরিক্সা মেরামতের কারখানা স্থাপনের ফলে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
১২. খাবার, টিভি, ফ্রিজ, হার্ডওয়্যার, স্যানিটারি, দর্জি ওষুধসহ মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় সামগ্রী এবং নির্মাণ সামগ্রীর দোকানপাট স্থাপন করতে হবে।
১৩. উৎপাদিত পণ্যের সহজ বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা। বৃহৎ বিপণি কেন্দ্র তৈরি করে জমির অপচয় নয় তবে উৎপাদিত পণ্য পরিবহন সহজতর করার মাধ্যমেই আধুনিক বাজার ব্যবস্থার সুফল পাওয়া সম্ভব।
উল্লেখ্য, উপরে বর্ণিত স্থাপনা/কাজ ও সুযোগ-সুবিধা কিছু ক্ষেত্রে আংশিক বিদ্যমান আছে, কিছু ক্ষেত্রে নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন প্রতি গ্রামকে শহরে রূপান্তরিত করা মোটেই কঠিন কাজ নয়। নিম্নলিখিত সুযোগ-সুবিধাগুলো সংযোজন করলে প্রতিটি ইউনিয়ন একটি পরিপূর্ণ উপশহরে রূপান্তরিত হতে পারে, যেখান থেকে সারা ইউনিয়নের সব জনসাধারণ শহরের সুবিধাগুলো ভোগ করতে পারবে।
১. বাজারসমূহে বিশেষ করে কাঁচাবাজার, মাছ, মাংসের বাজার কনক্রিট দ্বারা পাকা করতে হবে।
২. গভীর নলকূপ স্থাপন করে সুপেয় পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. ন্যূনতম ৩টি গণশৌচাগার নির্মাণ করে পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে হবে।
৪. বাজারের সঙ্গে গ্রামের সংযোগ কাঁচা সড়কগুলো পাকা করতে হবে।
৫. কমিউনিটি সেন্টার ও শিশু পার্ক নির্মাণ করতে হবে।
৬. খেলার মাঠকে মিনি স্টেডিয়ামে রূপান্তরিত করতে হবে।
৭. ভ্যান, রিক্সা ও অটোরিক্সার স্ট্যান্ডের জন্য নির্ধারিত জায়গা থাকতে হবে।
৮. সম্ভব হলে একটি পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপন করতে হবে।
উল্লিখিত প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রতিটি প্রকল্পে আনুমানিক ১০-১২ কোটি টাকা ব্যয় হতে পারে। বাংলাদেশে ৪ হাজার ৫৫৪টি ইউনিয়ন। তার মধ্যে ৬৮৩টি ইউনিয়ন শহরে অবস্থিত, বাকি ৩ হাজার ৮৭১টি ইউনিয়ন উপশহরে রূপান্তরিত করতে হলে যার আনুমানিক ব্যয় ৩৮ হাজার ৭১০ কোটি টাকার প্রয়োজন। যেহেতু এই প্রচুর পরিমাণ অর্থের জোগান একবারে সম্ভব নয় এবং এত বৃহৎ কর্মযজ্ঞ বাস্তবায়নে কমপক্ষে ৪ বছর সময় লাগবে। সুতরাং পর্যায়ক্রমে কাজটি সম্পন্ন করতে হবে।
উল্লেখ্য, এই প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এলজিইডি, আরইবি, আরএইচডি এবং পিএইচইএর সহযোগিতা বিশেষভাবে প্রয়োজন।
যে সব বিষয় গ্রামীণ উন্নয়নে অন্তরায় স্বাস্থ্য খাত অন্যতম। স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে ডাক্তারের উপস্থিতি নিশ্চিত করা প্রয়োজন। বাস্তবে ডাক্তাররা গ্রামীণ পরিবেশে থাকতে চায় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হয় যে কোন শর্তে চাকরিতে প্রবেশ করতে আগ্রহী হলেও গ্রামীণ পরিবেশে কাজ করতে আগ্রহ থাকে না। সঙ্গত কারণে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত হয় না। প্যারা মেডিক্যাল অর্থাৎ মধ্যবর্তী কোর্স সম্পন্ন ডাক্তারদের নিয়োগ প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা অধিকতর যুক্তিসঙ্গত।
পশু চিকিৎসা ক্ষেত্রেও একই চিত্র। অধ্যয়নশীল শহর জীবনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে কর্মজীবনে দূরগ্রামে কাজ করতে আগ্রহী নয়। শুধু কাগজে কলমে নিয়োগ দিয়ে গ্রামীণ জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করা হয় মাত্র। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মনিটরিং বলতে খবরদারি বোঝায় ব্যবস্থাটি দেখভাল হওয়া প্রয়োজন। শিক্ষকদের সুবিধা-অসুবিধা দেখা এবং বিদ্যালয়ের অবকাঠামোর সুযোগ-সুবিধা দেখাশোনা করা দায়িত্ব পালন উপজেলা শিক্ষা অফিসারের হলেও তার অফিস শহরে তিনি শহরের বাইরে যেতে আগ্রহী নয়। গ্রামের শিক্ষকরাই অফিসে এসে রিপোর্ট দিয়ে যায়। উপজেলা শিক্ষা অফিসারের সঙ্গে ইউনিয়ন পর্যায়ে সহকারী শিক্ষা অফিসার নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন।
কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র শহরকেন্দ্রিক গড়ে উঠেছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করলেই বাস্তবে কর্মমুখী মানব সম্পদ গড়ে তোলা সম্ভব।
সমন্বিত উন্নয়ন কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমে উপশহর প্রকল্প বাস্তবায়ন কাক্সিক্ষত পর্যায়ে উপনীত করা সম্ভব।
লেখক : প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ সেলফ এমপ্লয়েড ইঞ্জিনিয়ার্স এ্যাসোসিয়েশন।