কাজিরবাজার ডেস্ক :
রাজধানীর গুলিস্তান ও মালিবাগে পুলিশকে টার্গেট করে পৃথক দুটি ঘটনা কে বা কারা কি উদ্দেশে ঘটিয়েছে, এখনও সেই রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি তদন্তকারী পুলিশ। এরই মধ্যে গোয়েন্দা সংস্থা আশঙ্কা করছে, চলতি মাসে আবারও আত্মঘাতী জঙ্গি হামলা করতে পারে জঙ্গিগোষ্ঠীর সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্যরা। গুলিস্তান ও মালিবাগে পুলিশের উপর হামলার ঘটনার পর দায় স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস। দাতাদের কাছ থেকে ফান্ড পাওয়ার আশায় পুলিশের উপর হামলা করা হয়েছে বলে দাবি করেছে সিআইডি। তবে পুলিশের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্যই পুলিশের উপর হামলা করা হয়েছে বলে ডিএমপি কমিশনারের দাবি।
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ২৯ এপ্রিল রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় পুলিশের ওপর ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্য আহত হওয়ার প্রায় পাঁচ ঘণ্টা পর ওই ঘটনার দায় স্বীকার করেছিল আইএস। গত ২৬ মে রাজধানীর মালিবাগ মোড়ে বিস্ফোরণে পুলিশের এক সহকারী উপ-পরিদর্শকসহ তিনজন আহত হওয়ার ঘটনারও একই কায়দায় দায় স্বীকার করেছে ইসলামিক স্টেট (আইএস)। পুলিশের উপর হামলার দুইটি ঘটনায় দায় স্বীকারের বিষয়টি জানিয়েছে জঙ্গিগোষ্ঠীর ইন্টারনেটভিত্তিক তৎপরতা নজরদারিতে যুক্ত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাইট ইন্টেলিজেন্স। এই দুইটি পৃথক ঘটনায় সংশ্লিষ্ট থানায় দুইটি মামলা দায়েরের পর তদন্তভার দেয়া হয় জঙ্গিগোষ্ঠী বিষয়ক তদন্ত সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটকে (সিটিটিসি)।
রাজধানীর মালিবাগ মোড়ে বিস্ফোরণটি হয়েছে পুলিশের একটি গাড়িতে। বিস্ফোরণের কারণ বোমা না অন্য কিছু, এ বিষয়ে নিশ্চিত নয় পুলিশ। যেখানে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে তার পাশেই পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কার্যালয়। ঘটনাস্থলটি খুবই স্পর্শকাতর ও গুরুত্বপূর্ণ। গত ২৯ মে রাত পৌনে নয়টার দিকে মালিবাগ মোড়ে পেট্রোলপাম্পের উল্টো দিকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশের একটি পিকআপভ্যানে হঠাৎ বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ভ্যানের পেছনের অংশে আগুন ধরে যায়। ভ্যানটির পাশে তখন ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করছিলেন পুলিশের এক নারী কর্মকর্তা। বিস্ফোরণে তিনি পায়ে আঘাত পান। পথচারী এক নারী এবং এক রিক্সাচালকও আহত হন। বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন তিনজন। তাদের মধ্যে ট্রাফিক পুলিশের এএসআই রাশেদা আক্তার এবং রিক্সাচালক লাল মিয়াকে প্রথমে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখান থেকে তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। এই ঘটনার আগে পুলিশের উপর বোমা হামলা হয়েছে গুলিস্তানে।
গত ২৯ এপ্রিল রাত পৌনে আটটার দিকে রাজধানীর গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্সের সামনে কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালায় আততায়ীরা। ওই হামলায় ট্রাফিক পুলিশের দুই কনস্টেবল ও কমিউনিটি পুলিশের এক সদস্য আহত হন। ঘটনার পাঁচ ঘণ্টা পর আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস হামলার দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয়। বিশ্বব্যাপী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রম প্রচারকারী সংস্থা সাইট ইন্টেলিজেন্স জানায়, হামলাটি ছিল দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশে পুলিশের ওপর আইএসের চালানো প্রথম হামলা। প্রথমে ককটেল বলা হলেও পরে পুলিশ জানায়, যে বস্তুটি দিয়ে হামলা চালানো হয়, সেটি ইমপ্রুভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস বা বোমা। গুলিস্তানে পুলিশের ওপর বোমা হামলাকারীদের এখনও শনাক্ত করতে পারেনি তদন্তকারী পুলিশ। তবে কাজটি যে কোন জঙ্গি অথবা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর, সে বিষয়ে পুলিশ মোটামুটি নিশ্চিত।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গুলিস্তান ও মালিবাগের দুইটি বোমা বিস্ফোরণের পর পুলিশের বম্ব ডিসপোজাল ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলে যান এবং আলামত সংগ্রহ করেন। যে গাড়িতে বিস্ফোরণ হয়েছে, তা পুলিশের এসবির একটি পিকআপ। এর পেছনের অংশের বসার জায়গার এক পাশ পুড়ে গেছে। এ ছাড়া পিকআপের পেছনের দিকের কাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে গুলিস্তানে কর্তব্যরত পুলিশকে উদ্দেশ্য করে বোমা হামলা করে মোটরসাইকেলযোগে বোমা হামলাকারীরা দ্রুত স্থান ত্যাগ করে বলে তথ্য পেয়েছে তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। বোমা বিস্ফোরণের ঘটনা দুইটির বিস্ফোরণের পর ঘটনাস্থলে যান কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের কর্মকর্তারা। সিআইডির প্রধান এডিশনাল আইজিপি মোঃ শফিকুল ইসলাম বলেছেন, দাতাদের কাছ থেকে ফান্ড পাওয়ার জন্য পুলিশের উপর বোমা হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে হামলাকারীরা।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোঃ আছাদুজ্জামান মিয়া বলেছেন, পুলিশের মনোবল ভেঙ্গে দিতে পুলিশের উপর হামলা চালিয়েছে বলে সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছেন তিনি।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের তদন্ত সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, কী কারণে বিস্ফোরণের ঘটনাটি ঘটেছে তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে। এখনই কিছু বলা সম্ভব হচ্ছে না। গুলিস্তানে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনার সঙ্গে মালিবাগের বোমা বিস্ফোরণের ঘটনার কোন যোগসূত্র রয়েছে কি না তা এখনও রহস্যাবৃতই। গুলিস্তানে ও মালিবাগের কান্ড কারা কারা ঘটিয়েছে, সে রহস্য এখনও উন্মোচন করা যায়নি। গুলিস্তান মালিবাগের ঘটনা কীভাবে বা কারা ঘটিয়েছে, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা বলেন, চলতি জুন মাসে আবারও জঙ্গি হামলা করতে পারে জঙ্গিগোষ্ঠী। জঙ্গি হামলা করতে পারে নব্য জেএমবি কিংবা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম। ছোট আকারে থেমে থেমে বিভিন্ন স্থানে এ হামলার ঘটনা ঘটতে পারে আবার সুযোগ পেলে বড় হামলাও চালাতে পারে। নব্য জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম যে জঙ্গি হামলার পরিকল্পনা করছে সেই তথ্য পাওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সতর্ক থাকার জন্য বলেছে গোয়েন্দা সংস্থা।
নব্য জেএমবি ও আনসার আল ইসলামের একটি তরুণ গ্রুপ ইতোমধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে হামলা চালানোর জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করেছে। এই দুইটি জঙ্গি সংগঠনের হাতে বিপুলসংখ্যক আইইডি (ইমপ্রুভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) রয়েছে। গুলিস্তান ও মালিবাগে পুলিশের ওপর বোমা হামলা চালিয়েছে ওই দুই জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরাই। এরপর আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী আইএসের মাধ্যমে দায় স্বীকার করে বহির্বিশ্বেরও প্রচার মাধ্যমে দৃষ্টি আকর্ষণ করার কৌশল নিয়েছে ওই দুই জঙ্গিগোষ্ঠী।
পুলিশ সদর দফতরের এক কর্মকর্তা বলেন, গুলিস্তান ও মালিবাগে পুলিশকে টার্গেট করে দুটি বোমা হামলার ঘটনা আমাদের আবার সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গি তৎপরতার বিপদ স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, যা আবারও জঙ্গি হামলার আশঙ্কার জন্ম দিয়েছে। গুলিস্তান ও মালিবাগ হামলার বিষয়ে তদন্তে এখনও তেমন কিছু বের হয়ে না আসার কারণে জঙ্গিগোষ্ঠীর পক্ষ থেকেও হামলার আশঙ্কা থেকে যাচ্ছে। রাজধানীর দুটি ঘটনায় নারীসহ ছয় পুলিশ সদস্যের আহত হওয়ার ঘটনায় তাদের সক্রিয় উপস্থিতি এবং নির্বিঘেœ হামলা চালানোর সামর্থ্য প্রমাণ দিতে পেরেছে, যা ফের জঙ্গি হামলার ক্ষেত্র তৈরি করেছে বা করতে পারে জঙ্গিগোষ্ঠী। তবে সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্যরা আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার ছক কষছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি।