রুহুল ফারুক
উপমহাদেশের অন্যতম মুবাল্লিগ, মুত্তাকী, ওলিকূল শিরমণি মহান দরবেশ হযরত শাহজালাল মজররদ ইয়ামেনী (রহ.) ১৩০৩ খৃষ্টাব্দে শুভাগমন করেন। ২৬ শাওয়াল ৭০৩ হিজরীতে দ্বীনের ঝান্ডা তুলেন ও সিলেট ফতেহ, বিজয় করেন। (দলিল : শিলালিপি, বিশ্বপর্যটক ইবনে বতুতার সফর নামা)
মহান ওলির আগমনের পর থেকে ধনী-গরীব, সাদা-কালো, নারী-পুরুষ, হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান, সুখী-দুখী, শ্রমিক- মেহনতি, নবাব, রাজা, বাদশাহ, উজির, নাজির রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, কর্মকর্তা, কর্মচারী সহ সর্বস্তরের মানুষ দরগাহ শরীফে আসেন। এই মহান ওলির প্রতি মানুষের এত আকর্ষণের কারণ চুম্বক যেভাবে লোহাকে নিজের দিকে টানে, উনার মাঝে এরূপ অনেক গুণাবলী থাকায় মানুষ আকৃষ্ট হয়। বিশেষ করে আল্লাহর মাহবুব বান্দা হিসেবে রহমত প্রাপ্ত হয়েছেন। যার ফলে বিগত ৭১৫ বৎসরে উনার জীবন ও কর্মের প্রভাবে, আল্লাহর রহমতে সিলেট তথা বাংলাদেশে ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষ সহ-অবস্থান, সহ মর্মীতা বজায় রেখে জীবন যাপন করেছেন। দ্বীন আল ইসলামের প্রচার, প্রসার, হয়েছে, মসজিদ, মাদরাসা হয়েছে। হযরত শাহজালাল (রহ.) নামে (১) বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (২) হযরত শাহজালাল ইসলামী ব্যাংক লি. (৩) হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমান বন্দর (৪) শাহজালাল সার কারখানা (৫) মাসিক শাহজালাল (গভ: রেজি: নং ১০৪) (৬) হযরত শাহজালাল (রহ.) নামে অনেক মসজিদ ও মাদরাসা, (৭) হযরত শাহজালাল (রহ.) নামে অনেক আবাসিক এলাকা (৮) হযরত শাহজালাল (রহ.) নামে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্টান (৯) হযরত শাহজালাল (রহ.) কে নিয়ে গবেষণা ও তিনটি থিসিস হয়েছে, আরোও হচ্ছে, শতাধিক বই প্রকাশিত হয়েছে। বিশেষ করে আমরা হযরত শাহজালাল (রহ.) জীবনের বিভিন্ন দিকগুলি জানার চেষ্টা করি তাহলে শিক্ষা গ্রহণ, বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
১। আল্লাহর মহব্বত (দলিল: সুরা : বাকারা : আয়াত ১৬৫) :
পৃথিবীতে বনী আদমের সন্তানরা, তথা যে কোন মানুষ যে কোন কাজ করার সময় একটি উদ্দেশ্য- লক্ষ্য সামনে রেখে কাজ করেন, একটি স্বার্থ থাকে, একটি আকর্ষণ থাকে, একটি চাওয়া পাওয়া থাকে। হযরত শাহজালাল (রহ.) জীবনের এই চাওয়া পাওয়া, এই আকর্ষণ, এই স্বার্থ এই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল আল্লাহর মহব্বত। (দলিল : সূরা বাকারা : আয়াত : ১৬৫)। আল্লাহর মহব্বতে নবী রাসূলগণ কাজ করে গেছেন। সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী, আল্লাহর হাবীব হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর মহব্বতে কাজ করে গেছেন, খলিফায়ে রাশেদীন, তাবেয়িন, তাবে-তাবেয়ীন, উলামায়ে দ্বীন, পীর মাশায়েখগণ আল্লাহর মহব্বতে কাজ করে গেছেন। হযরত শাহজালাল (রহ.) সুদুর ইয়েমেনের সানা শহরে জন্ম গ্রহণ করে মুর্শিদ হযরত সৈয়দ আহমদ কবির (রহ.) এর নির্দেশে আল্লাহর মহব্বতে বাড়ি-ঘর, এলাকা, দেশ, আত্মীয়-স্বজন ছেড়ে দ্বীন-আল ইসলামের (দলিল : সুরা : আল-ইমরান : আয়াত : ১৯) কাজে আত্মানিয়োগ করেন। সুতরাং যে আল্লাহ আমাদেরকে সৃষ্টি করেছেন; যার কাছে জীবনের সময়সীমা শেষ হলে, মৃত্যু হলে আবার ফিরে যাব সেই আল্লাহর মহব্বতে নিজের সকল কাজ করি; নিজের জীবনকে সফল করি।
২। আল্লাহর রাসূল হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর মহব্বত : (দলিল : সূরা : তওবা ২৪)
হযরত শাহজালাল (রহ.) আখেরী নবী ও রাসূল, আল্লাহর হাবীব হযরত মোহাম্মদ মোস্তফা (সা.)’র প্রতি গভীর মহব্বত রাখতেন। সুতরাং আমরা এই ওলির ভক্ত, অনুসারী ও উত্তরাধীকারী হিসেবে হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর প্রতি মহব্বত রাখি, অনুগত্য করি, ছুন্নতের আমল করি, ছুন্নতের পাবন্দি হই।
৩। হক্্কুল্লাহ (দলিল : সূরা : নুর : আয়াত : ৬২, সূরা হুজুরাত : আয়াত : ১৪) :
হযরত শাহজালাল (রহ.)’র জীবন, কর্ম ও মিশনের প্রধান দুটি দিক ছিল (১) হক্্কুল্লাহ (২) হক্্কুল এবাদ। অর্থাৎ তিনি আল্লাহর রাস্তায় কাজ করেছেন। আল্লাহর হক আদায় করেছেন। আল্লাহর দেয়া দ্বীন আল ইসলামের জন্য সারা জীবন সাধনা করেছেন। বিশেষ করে ঈমান এনে ঈমানের হক আদায় করেছেন।
উল্লেখ্য যে, যিনি ঈমান আনলেন তিনিই মোমীন (দলিল : সূরা হুজুরাত : আয়াত : ১৫)। সুতরাং আল্লাহর উপর ঈমান আনার সাথে সাথেই একজন মোমীন আল্লাহর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে যান। অর্থাৎ আল্লাহ খালিক সৃষ্টিকর্তা এবং মোমীন মাখলুক (সৃষ্ট জীব) হিসাবেÑ
আক্্দ হয় চুক্তিপত্র (ধমৎববসবহঃ), অঙ্গীকার বদ্ধ হন। (দলিল : সূরা : মরিয়ম : আয়াত : ৯)
বাইয়্যাত (ক্রয়-বিক্রয় = ঝধষব – ঢ়ঁৎপযধংব) হয়। (দলিল : সূরা : ফাতহ : আয়াত : ১০)
এই ক্ষেত্রে হযরত শাহজালাল (রহ.) ঈমানের পরীক্ষায় যে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন তা অক্ষরে অক্ষরে সারাজীবন পালন করে নিজেকে এক মডেল হিসেবে গড়ে তুলেছিলেন; আসুন আমরাও আল্লাহর উপর ঈমানের ভিত্তিতে, আল্লাহর মহব্বতে, হযরত শাহজালাল (রহ.) এর ভক্ত হিসেবে দ্বীন আল ইসলামের ৫টি মৌলিক বিধিমালা পালন করি।
ফরজ ঈমানের বিধিমালা (দলিল : সূরা বাকারা : আয়াত ২, ৩, ৪, ২৮৫, ২০৮, ৬২, ২৫৬), (সূরা আল-ইমরান : আয়াত : ৮৪, ১৭৯, সূরা : নূর : আয়াত : ৬২, সূরা : তাগাবুন : আয়াত : ৮)
ফরজ সালাতের বিধিমালা (দলিল : সূরা বাকারা আয়াত : ৪৩, ৪৫, ১১০, ২৩৮)
ফরজ সাওমের বিধিমালা (দলিল : সূরা বাকারা : আয়াত : ১৮৩, ১৮৫)
ফরজ যাকাতের বিধিমালা (দলিল : সূরা তাওবা : আয়াত : ৬০, সূরা রুম : আয়াত: ৩৯)
ফরজ হজ্বের বিধান (দলিল : সূরা বাকারা : আয়াত ১৯৫, ১৯৬, ১৯৭, ১৫৮)
আসুন এই বিধিমালা অনুসরণ করে আমরা নিজেদেরকে কামিলিয়াতের দরজায় নিয়ে যাই।
হক্্কুল এবাদ (দলিল : সূরা : আল- ইমরান : আয়াত : ১১০) :
হযরত শাহজালাল (রহ.) হক্্কুল এবাদ তথা মানুষের হক আদায় করেছেন, আল্লাহর সৃষ্ট জীবের হক আদায় করেছেন। এক্ষেত্রে তিনি মানুষের কল্যাণের জন্যই, মানুষের সেবার জন্যই দেশ থেকে দেশান্তরে গেছেন। এ সম্পর্কে আল-কোরআনে আল্লাহপাক নির্দেশ দিচ্ছেন “এবং তোমাদের মধ্যে এরূপ উম্মত হওয়া উচিত যারা কল্যাণের দিকে আহবান করে এবং ভাল কাজের আদেশ করে ও মন্দ কাজে নিষেধ করে আর তারাই সুফল প্রাপ্ত হবে।” [সূরা : আল-ইমরান : আয়াত ১০৪]। এই আয়াতের আলোকেই হযরত শাহজালাল (রহ.) পূর্ণ জীবন কাজ করেছেন এবং সুফলপ্রাপ্ত হয়েছেন বিধায় ৭১৫ বছর পরও সিলেট সহ সারা বাংলাদেশে উনার প্রতি শ্রদ্ধা, স্মরণ, অনুসরণ ও প্রভাব বিস্তার করছে। এ বিষয়ে একটি জ্বলন্ত উদাহরণ আজও সিলেটে প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত আছে, তা হচ্ছে একজন কাঠুরিয়ার মেয়ের বিবাহের আয়োজন এবং যে টিলা থেকে তিনি কাঠ কেটে এনেছিলেন তা সিলেটের এয়ারপোর্ট রোডে মালনীছড়া ও লাক্কারতুড়া চা বাগানের মধ্যস্থানে অবস্থিত যা সরকারীভাবে নির্ধারিত।
৫। দাওয়াত (দলিল : সূরা : নাহল : আয়াত ১২৫)
হযরত আদম (আ.) থেকে শুরু করে সর্বশেষ নবী ও রাসূল হযরত মোহাম্মদ (সা.) পর্যন্ত সবাই আল্লাহর দ্বীনের দাওয়াত দিয়েছেন। হযরত শাহজালাল (রহ.) নায়েবে রাসূল হিসাবে সারা জীবন দাওয়াত দিয়েছেন। (দলিল : সূরা হা-মীম সিজদাহ : আয়াত : ৩৩; সুরা ইউসুফ : আয়াত : ১০৮)। আসুন আমরা ভক্ত হিসেবে দাওয়াতের কাজ করি।
৬। জীবনের নিয়ত : (দলিল : সূরা : আনআ’ম : আয়াত : ১৬২)
হযরত শাহজালাল (রহ.) এর জীবনের নিয়ত ছিল আল্লাহর মহব্বত অর্জন করা, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা। তাই আসুন আমরাও উনার ভক্ত, অনুসারী হিসাবে জীবনের নিয়ত করে আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করি, রেজা-ই- এলাহী (খড়াব ড়ভ উরারহব) অর্জন করি। দলিল (সূরা আন-আম : আয়াত :১৬২,৭৯, সূরা বাকারা : আয়াত ১৬৫, ২০৭, সূরা লাইল : আয়াত ২০-২১, সূরা ইয়াসিন : আয়াত : ২৩, সূরা যারিয়াত : আয়াত ৫৬, সূরা : যুমার : আয়াত: ১১)
৭। সফল মোমীন (দলিল : সূরা : আল-মুমিনুন : আয়াত : ১-১১) :
হযরত শাহজালাল (রহ.) ছিলেন একজন সফল মোমীন, আসুন আমরা উনার ভক্ত, অনুসারী হিসাবে সফল মোমীন হওয়ার জন্য কোরআনের আয়াত ও নির্দেশনা পালন করি। (দলিল : সূরা : মুমিনুন : আয়াত : ১-১১, সূরা : নুর : আয়াত ৫১, সূরা হুজুরাত : আয়াত ১০, ১১, ১৫, সুরা : আনফাল : আয়াত ২, ৬, ৪, ৭৪, সূরা : তাওবা : আয়াত : ৭১, সুরা : রা’দ : আয়াত : ২৮)
৮। তাকওয়া > মুত্তাকী (দলিল : সূরা বাকারা : আয়াত ২-৪)
হযরত শাহজালাল (রহ.) নিঃসন্দেহে একজন তাকওয়াবান, মুত্তাকী ছিলেন। আধ্যাত্মিক সাধনায় যারা অগ্রবর্তী, সফলকাম, তারা তাকওয়ার পথ অবলম্বন করেন। তাকওয়া ছাড়া কামিলিয়াত হাসিল করা সম্ভব নয়। কারণ তাকওয়া আরবী শব্দ ওয়াকয়া থেকে এর উৎপত্তি। আভিধানিক অর্থে আত্মসুদ্ধি, বিরত থাকা, নিজেকে সকলপ্রকার ক্ষতি থেকে রক্ষা করা, সাবধান হওয়া, শয়তানের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য ও শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আল্লাহর হুকুমের বিরুদ্ধে কাজ করে, আল্লাহর শাস্তি পাওয়াকে ভয় করা অর্থাৎ গুনাহ করলে আল্লাহর আজাব বা শাস্তি পেতে হবে এরই ভয় করা। বিধায় যারা আল্লাহর আশিক তারা তাকওয়ার তরিকা অবলম্বন করেন। এজন্য হযরত শাহজালাল (রহ.) একজন উঁচুদরের মুত্তাকী ছিলেন। বিশেষ করে জানা যায় উনি মৃত্যুর আগে নসিহত করে গেছেন যে তোমরা তাকওয়ার পথ অবলম্বন কর। দলিল : সূরা : তাওবা : আয়াত : ১১৯, সূরা হাশর : আয়াত ১৮, সূরা নুর : আয়াত ৫২, সূরা ইমরান : আয়াত ১০২, সূরা মূলক : আয়াত ১২, সূরা মায়েদা : আয়াত ২, সূরা নাহল আয়াত ১২৮, সূরা হুজুরাত আয়াত ১৩।
৯। ইতা’য়াত (দলিল : সূরা নিছা : আয়াত : ৫৯) :
ইতা’য়াত আরবী শব্দ এর অর্থ আনুগত্য করা; এর বিপরীত শব্দ মাছিয়াত অর্থ অমান্য করা। হযরত শাহজালালাল (রহ.) আল্লাহর এবং আল্লাহর রাসূলের মহব্বতে আনুগত্য করেছেন; দ্বীনের কাজ করেছেন। আসুন আমরাও তার ভক্ত হিসাবে ইতা’য়াত করি; মাছিয়াত থেকে বেঁচে থাকি।
(দলিল : সূরা : আল-ইমরান : আয়াত : ১৩২, সূরা নুর : আয়াত : ৫২, সূরা নিছা : আয়াত : ১৩, ৮০, ৬৯)
১০। লিবাস-উত-তাকওয়া : (দলিল : সূরা : নুর : আয়াত : ৩০) :
হযরত শাহজালাল (রহ.) আধ্যাত্মিক জগতে উন্নতী করায় অত্যান্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে লিবাস-উত-তাকওয়া। প্রচলিত ভাবে লিবাছ বলতে পোষাক বুঝায়; যা দৃশ্যমান বা জাহেরী এবং লিবাস-উত-তাকওয়া অদৃশ্য বা বাতেনী এই জাহেরী লিবাস এবং বাতেনী লিবাস দুটিরই সম্পর্ক গভীরভাবে একত্রিত। এই লিবাস মানুষের ও পশুর মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করে; সুতরাং মানুষ হিসেবে নিজের মান, সম্মান, কল্যাণ, উন্নতির জন্য, লাজ-লজ্জা নিবারণের লিবাস ও লিবাস উত-তাকওয়ার পথ অবলম্বন করি। (দলিল : সূরা : নুর : আয়াত : ৩৯, ৫৯, ১৯, ৬০, সূরা : আরাফ : আয়াত : ২৬, সূরা : আহযাব : আয়াত : ৫৯, ৫৩, ৩২, ৩৩।)
উপসংহার : এই মহান ওলি, মুত্তাকী হযরত শাহজালাল (রহ.) এর আমি এক নগণ্য ভক্ত ও অনুসারী হিসাবে হযরতের নামে প্রকাশিত মাসিক শাহজালাল পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক হিসাবে বিনীত অনুরোধ, আপনারা উপরোক্ত বিষয়গুলি নিজের লাভের জন্য, নিজের কল্যাণের জন্য, নিজের শান্তি, উন্নতি, ছোয়াবের জন্য পড়–ন, আমল করুন। (দলিল : সূরা : তাহরিম : আয়াত : ৬) [আমীন]
লেখক : সম্পাদক, মাসিক শাহজালাল।