শাহিদ হাতিমী
বড্ড গরম। ঈদের রাত। গাঢ় অন্ধকারে গোটা পৃথিবী আচ্ছন্ন। আকাশে দু’একটি তারকা ক্ষুদে বিড়ালের চোখের মত মিটমিট করে জ্বলছে। বাতাস স্তব্ধ হয়ে গেছে। গাছের পাতাগুলো পর্যন্ত নড়ছেনা। চারিদিকে এক গভীর নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। দূর থেকে ভেসে আসছে কুকুরের ঘেউ ঘেউ আওয়াজ। এছাড়া কোন শব্দই যেন নেই দুনিয়ায়।
একদিকে রাত পোহালেই ঈদ, অপর দিকে প্রচন্ড গরম। ইচ্ছে করেই ঘুমাচ্ছে না হাদি ও ছাদি। আজ তারা খুব ভোরে বিছানা ছাড়বে। পুকুরে যাবে, গোসল করবে। নতুন জামা পরিধান করবে। দাদুর সাথে ঈদগাহে যাবে। বন্ধুদের সাথে কোলাকুলি করবে, সন্দেশ-পিঠা খাবে, বড়দের সালাম জানাবে, ছোটদের চকোলেট উপহার দিবে, ভাইয়া-আপুদের কাছে গিফট চাইবে ইত্যাদি অনেক কিছুই নিয়ে কথা বলছে। হঠাৎ দাদুর সাড়া পেয়ে দু’ভাই নিশ্চুপ হয়ে গেল। ছাদি-হাদিকে বলল, ভাইয়া! দাদু যদি এখন বের হন তাহলে আজ দাদুকে একটা সারপ্রাইজ দিব। কি সারপ্রাইজ দিবি? বলবো না, সময় হলে বুঝতে পারবে। সময় হওয়ার প্রয়োজন নেই। যদি এখন না বলিস তাহলে আমি তোর সাথে নেই বলে হাদি অন্য বেডে চলে যেতে লাগল।
উহ ভাইয়া! তুমি এত অল্পতে রেগে যাও। একটু রসিকতাও বুঝনা। শোন! দাদু যখন বাহিরে যাবে তখন আমরা দু’জন মিলে ঘরের দরজা বন্ধ করে দেব। দাদু এসে যখন দেখবে দরজা বন্ধ তখন আমাদেরকে ডাকবে। পাশের রুমের জ্যোতি নাহিদারও ঘুম ভেঙ্গে যাবে। আমরা তখন শর্ত সন্ধি করবো। শর্ত সন্ধি সে আবার কি? এই ধর তুমি স্কুলে পড়, আর আমি মাদ্রাসায় পড়ি। আমরা দু’জন সন্ধি করলাম যে, আমি তোমাকে দৈনিক পবিত্র কুরআনের একটি আয়াত অর্থসহ শিখাবো তার পরিবর্তে তুমি আমাকে ইংরেজী একটি বাক্য বাংলা অর্থসহ শিখাবে। হাদি বললো, এবার বুঝেছি। আচ্ছা, শুনি কী করতে চাচ্ছিস। দাদু যখন বাহির থেকে এসে দরজা খোলার কথা বলবে, তখন বলবো দাদু একশর্তে দরজা খুলতে পারি। দাদু অবাক হয়ে জানতে চাইবেন ঈদকী শর্ত? আমরা বলবো আমাদের ঘুম পাচ্ছেনা, আমাদেরকে গল্প শুনাতে হবে। হ্যাঁ.. হ্যাঁ! কী মজা হবে তখন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাদুকে শর্তে রাজি হতে হবে। দাদুকে ঘিরে সারিবদ্ধভাবে বসে আছে সবাই। তাদের সাথে গল্প শোনার জন্য যোগ দিয়েছে সাগর ও রাসেল নামের আরো দু’জন।
দাদু বললেন, তোমাদেরকে আজ অনেক আগের একটি গল্প বলবো, তোমরা কি শুনবে? সবাই সমস্বরে বলে উঠলো অবশ্যই। তাহলে শোন! তখনকার দিন ছিল শান্তি-সুখের। গরীব-ধনীর মাঝে তফাৎ ছিল না। সবাই মোটামুটি শান্তিতে ছিল। কেউ কারো ব্যাপারে খুব একটা হস্তক্ষেপ করত না। একে অন্যের প্রতিহিংসা বিদ্বেষ তেমন একটা পোষণ করতো না। কিছু কিছু ব্যতিক্রম যে ছিলনা তা নয়। শুধু বলা চলে আজকের অশান্ত দুনিয়ার হাহাকার ছিল না। রাজনীতির নামে গুম, খুন বলতেই ছিলো না। ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি, বন্ধুতে ধোঁকাবাজি, পিতা-পুত্রে কাটাকাটি বছরে একটিও শুনা যেতনা। ইন্টারনেট, মোবাইলফোন, কম্পিউটার এগুলো অতি শিক্ষিত লোক ছাড়া অনেকের নামই জানা ছিলো না, রকেট-বিমানের নাম শুনলে মানুষ চমকে উঠতো। জানতে চাইতো সে আবার কি? অনেকে ভয়ে আতংকে বাসা-বাড়িতে বৈদ্যুতিক কানেকশনও নিতে চাইতো না। মহিলারা পর্দানশীন ছিলো। বর্তমান যুগের পশ্চিমা বিবেকি নারীদের ন্যায় এমন অবাধে চলাফেরা করতো না। শহুরে মার্কেট তো দূরের কথা পলি¬র বাজারেও যেতে লজ্জায় হিমশিম খেতো। আপন ধর্ম মোতাবেক মানুষ গ্রষ্টা প্রেমে যথেষ্ট মশগুল ছিলো। বড়রা করতো ছোটদের স্নেহ এবং ছোটরাও ছিলো বড়দের প্রতি নিতান্তই শ্রদ্ধাশীল। সে কালের সমাজ ছিল গ্রামের পঞ্চায়েত শাসিত। গ্রামের মানুষের প্রতি, পাড়া-প্রতিবেশীর প্রতি, ভিনদেশী মুসাফিরের প্রতি, আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি। এমনকি অনাত্মীয় অপরিচিতদের প্রতিও সবাই একটা শ্রদ্ধাবোধ দেখাতো। জহির কিছু বলতে যাচ্ছিল রেখা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল দাদু! রাত এখন শেষ হওয়ার পথে। আর ভূমিকা না বলে আসল গল্পটি বলে ফেলুন তো! আলবত ঠিক আছে, বুঝেছি, তোমাদের আর তর সইছে না।
আর মাত্র দু’দিন পরই ঈদ। গ্রামের প্রায় সকলেই যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী কেনা-কাটা শেষ করেছে। শুধু বাকী রইলো পশ্চিম পাড়ার ছবুর মিয়া। বেচারা নিতান্তই গরীব লোক। সম্পদ বলতে আছে শুধু ঘরের ভিটা। দৈনিক কাজ করে যা পায় তা দিয়ে মোটামুটি পরিবার চলে। সে দিন যুহরের নামায আদায় করে বাড়ী ফেরার পথে দেখা হলো তার সাথে। জিজ্ঞেস করলাম কি ছবুর মিয়া! কোথায় যাচ্ছো? আর কইয়েন না চাচা! আপনার বউকে (তার স্ত্রী) ঈদের শাড়ী কিনে না দেয়ায় সেই সকাল থেকে গাল ফুলিয়ে বসে আছে। অনেক মালিশ করলাম-কিন্তু কিছুতেই পালিশ করতে পারলাম না। তাই সাত পাঁচ ভেবে বাহির হলাম। দেখি কোথাও কিছু একটা পাই কি না। ছবুর মিয়ার কথা শুনে তার প্রতি খুব দরদ হল। মায়া লাগলো। তাই তাকে কিছু টাকা দেয়ার জন্য পকেটে হাত দিলাম। পকেটে দেখলাম একটা পাঁচ টাকার নোট আছে। একটু ইতস্ত করছিলাম সারাটা দিয়ে দিব কি-না। ঠিক তখন এক ঘটনা স্মরণ হয়ে যাওয়াতে পাঁচ টাকার নোটটি তার হাতে দিয়ে বললাম- আজ আর অন্য কাজ না করে বাজারে গিয়ে বউ-বাচ্চাদের জন্য জামা-কাপড় কিনে নিয়ে আসার কথা। পাঁচ টাকা পেয়ে ছবুর মিয়া খুব খুশি হল। যার পর নাই আনন্দিত হল। হয়তো আকাশের চাঁদ হাতে পেলেও ছবুর মিয়া এত খুশি, এমন আনন্দিত হতো না। দাদু কী এমন ঘটনা স্মরণ হল তোমার! যা পাঁচ টাকার আস্ত নোটটা দিতে বাধ্য করলো? ঘটনাটি হলো, আমাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর কন্যা হযরত ফাতেমা (রা.) একদা নতুন একটি জামা এই মাত্র পরিধান করেছেন। এমন সময় এক ভিক্ষুক এসে বললো, মা, আমার জামাটা একেবারে ছিঁড়ে গেছে, আপনার তো এখন নতুন একটা আছে। আমাকে পুরাতন জামাটি দিয়ে দিন। ভিক্ষুকের এমন আকুতি নবী কন্যা ফাতেমা (রা.) কিছুতেই ফিরিয়ে দিতে পারলেন না। বরং তৎক্ষণাৎ তিনি পুরাতন জামাটির পরিবর্তে নতুনটিই দিয়ে দিলেন ভিক্ষুককে।
আচ্ছা দাদু! ছবুর মিয়া বাজার থেকে কী কী কিনে এনেছিল? না-রে সে ভাগ্য আর তার পুরণ হয়নি। কেন? সে এক মর্মান্তিক কাহিনী। দিনের রবিটা আস্তে আস্তে পশ্চিম দিকে ডুব দিচ্ছে। মাত্র কয়েক মিনিট পরই মাগরিবের আযান হবে। ধীরে ধীরে মসজিদের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। এর মাঝে তোদের বড়বাপ, এসে খবর দিল। বাজান কিছু শুনেছেন? বললাম না তো! সে বলল বাজান, পশ্চিম পাড়ার ছবুর মিয়া হাট থেকে ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে। (ইন্না লিলাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন) গ্রামের লোকজন ছবুর মিয়ার মরদেহ আনতে গেছে, আমিও যাবো। আমি তাকে হা-না কিছুই বলতে পারলাম না। নির্বাক হয়ে ওখানেই দাঁড়িয়ে রইলাম। দাদুর শেষ কথাগুলো হাদি শুনতে পায়নি। সে কি এক কাজে বাহিরে ছিল। এসে বললো দাদু আর গল্প শুনবো না। ফজরের আযান হয়ে গেছে। মুসলিম উম্মাহর বাৎসরিক সর্বাধিক আনন্দময়ী উৎসব ঈদের দিনের ভোরের আযান। এসো দাদু পুকুরে যাবো। তুমি অযু করবে আর আমরা গোসল করবো। চঞ্চলমনা ছাদি বললো, দেখলে ভাইয়া! আমরা অনেক গল্প করলাম কিন্তু রাত পোহালো না। আর দাদুর একটি মাত্র গল্পে রাত ইতি হয়ে গেলো।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট, যুগ্মসচিব, জালালাবাদ লেখক ফোরাম সিলেট।