ধানের দাম নিয়ে উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী, শীঘ্রই সমাধান

23

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ধানের দাম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী। দ্রুতই এই সমস্য সমাধানে বিষয়টি নিয়ে সর্বোচ্চ মহলে আলোচনা হবে বলে মন্তব্য করেছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কৃষকদের ক্ষতির হাত থেকে রক্ষার জন্য করণীয় সম্পর্কে নিয়মিত খোঁজখবর রাখছেন ও প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন। সরকারের নেয়া পদক্ষেপের কারণে দেশের কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব সাধিত হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক বেশি ধানের ফলন হয়েছে। ফলে ধান কাটার জন্য শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এটা নিয়ে হতাশ হওয়ার কোন কারণ নেই। দেশে অধিক ধান উৎপাদন এখন বিড়ম্বনা হয়ে দেখা দিয়েছে।
শনিবার রাজধানীর কাকরাইলে অবস্থিত ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে জলবায়ু পরিবর্তন, কৃষি খাতে চ্যালেঞ্জ শীর্ষক এক অনুষ্ঠানে এই মন্তব্য করেন। বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম, কৃষি তথ্য সার্ভিস যৌথভাবে এই সেমিনারের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। আইডিইবির সাধারণ সম্পাদক শামসুর রহমানের সভাপতিত্বে ও বিসিজেএফ সভাপতি কাওসার রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) চেয়ারম্যান ড. খলীকুজ্জমান আহমদ।
অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী আরও বলেন, ধানের দাম কম হলেও এটি সমাধানের চেষ্টা করছে সরকার। এজন্য তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ হিসেবে চাল রফতানির চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। ধান কাটা সম্পন্ন হলে এই বিষয়ে একটা পদক্ষেপ নেয়া হতে পারে। এছাড়াও কৃষিকে আধুনিকীকরণ, যাত্রিকীকরণ এবং বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমেও এখন যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তা সমাধানের উদ্যোগ নেয়া হবে। এ মুহূর্তে ধান কিনে দাম বাড়ানোর সুযোগ সরকারের হাতে নেই। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীকে জানানো হয়েছে। এটা নিয়ে তিনি খুবই চিন্তিত, উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনায় সরকারের একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সবচে বড় যে সমস্যা কৃষক সিলেকশন করা। এত কৃষক রয়েছে যে সিলেকশন করে ধান কেনা সরকারের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। এছাড়া সারাদেশে গুদামের ধারণ ক্ষমতা রয়েছে ২০ লাখ টনের। গুদামে আগের মজুদ রয়েছে ৮ থেকে ১০ লাখ টনের। এছাড়া গুদামের ধারণ ক্ষমতা না থাকায় সব কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনাও সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। আবার কৃষকের কাছ থেকে ১০-১২ লাখ টন চাল কিনেও বাজারের বড় প্রভাব সৃষ্টি করা যায় না। আবার মিল মালিকরাও আমন ধান কিনে তা বেচতে পারছে না। তাদের গুদামেও জায়গা নেই। সব মিলে এই বছর ধানের দাম নিয়ে এই সমস্য দেখা দিয়েছে। তিনি বলেন, দেশে গুদামগুলোর ধারণ ক্ষমতা যদি ৫০ থেকে ৬০ লাখ টন হতো তাহলে নয় একটা ব্যবস্থা নেয়া যেত। তবে তিনি উল্লেখ করেন গুদামগুলোর ধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
এ সময় তিনি জলবায়ু পরিবর্তনে কৃষি খাতের চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে কৃষি খাত। তবে নানা সমস্যা থাকার পরও বাংলাদেশে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ধান উৎপাদন হচ্ছে। আগে উপকূলীয় জেলাগুলোতে এক ফসলের বেশি উৎপাদন করা সম্ভব হতো না। কিন্তু সেসব এলাকায় এখন প্রচুর পরিমাণে সবজি এবং ডাল উৎপাদন হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তনে দেশে কৃষি খাতে এর প্রভাব থাকলে বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও নতুন জাত আবিষ্কারের ফলে দেশে ফসল উৎপাদন আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এক্ষেত্রে সরকার ব্যাপক সাফল্য দেখিয়েছে। কৃষি খাতে বিপ্লব হয়েছে। এটা খারাপ দিক নয়। এটা নিয়ে হতাশারও কিছু নেই। এখন ফ্রান্সের মতো বাংলাদেশেও চাষিরা ড্রাম ভর্তি দুধ রাস্তায় ফেলে দেয়, ট্রাক ভর্তি টমেটো নিয়ে হাইওয়েতে ফেলে দেয়। কৃষি একটা স্পর্শকাতর সেক্টর। আমরা তো সব সময় চাই-খাবারের দাম কম থাকুক, চালের দাম কম থাকুক। বাংলাদেশে অধিক ধান উৎপাদন এখন বিড়ম্বনা হয়ে দেখা দিয়েছে। ধান চাষ উদ্বৃত্ত হয়েছে। ধানের দাম কম হওয়ায় ধান ক্ষেতে আগুন দেয়া প্রসঙ্গে বলেন, দু-একজন ভাবাবেগ হয়ে ধান ক্ষেতে আগুন দিয়েছে। সারাদেশে ওইভাবে আগুন দিচ্ছে না। মানুষ দায়িত্বশীল, তারা নিজের ক্ষেতে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলবে, এটা কোনদিনও হতে পারে না।
তিনি বলেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হচ্ছে কৃষি খাত। কারণ বাংলাদেশ এখনও কৃষিনির্ভর। জিডিপিতে কৃষির অবদান সবচেয়ে বেশি। দেশের ৪০ ভাগ মানুষের কর্মস্থান কৃষিতে। তাদের জীবীকাও এই কৃষিনির্ভর। তাই জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে কৃষি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা এদেশে আগেও ছিল। কিন্তু সম্প্রতি জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এর তীব্রতাও বেড়েছে অনেক। শীতকালের পরিমাণ কমে আসার কারণে গমের উৎপাদন অনেক কমেছে। ফলে প্রতি বছর দেশে ৬০ লাখ টন গম আমদানি করতে হচ্ছে। এ অবস্থায় দেশের বিজ্ঞানীরা চেষ্টা করে যাচ্ছেন উষ্ণতাসহিষ্ণু গমের জাত উদ্ভাবনের। বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টার কারণে লবণাক্ততা সহিষ্ণু ধানের জাত উদ্ভাবন সম্ভব হয়েছে। তিনি বলেন, সরকার পাহাড়ী অঞ্চল, উপকূলীয় এলাকা এবং হাওড় অঞ্চলে ফসলের উৎপাদন বাড়াতে বিজ্ঞানীরা কাজ করছে। দেশের আরেক সমস্যা হচ্ছে মানুষের জন্মহার। জন্ম হার আগের চেয়ে কমলেও প্রতিবছর প্রায় ২২ লাখ নতুন মুখ জন্ম নিচ্ছে। এটা নতুন সমস্যা। মানুষের বসতবাড়ির চাহিদায় কৃষি জমির পরিমাণ কমছে।
তিনি বলেন, দেশের ভূগর্ভস্তরের পানি নিচে নামছে। এর জন্য দায়ী পার্শ¦বর্তী দেশের একতরফা পানি প্রত্যহার। পানি প্রত্যাহারের কারণে নদীতে পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ফলে ভূগর্ভস্থ পানির রিজার্ভ হচ্ছে না। তিনি বলেন, এত সমস্যার পরও দেশে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রয়োজনের অনেক বেশি উৎপন্ন হচ্ছে। এখন সারা বছরই সবজি পাওয়া যাচ্ছে। যে দেশে আগে খাবার পাওয়া যেত না, সেখানে আজ কাজের জন্য শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। এটা ভাল দিক। শ্রমিকরা শিফটে কাজ করছে। তাদের জীবনমান আরও উন্নত হয়েছে। ফলে কৃষিকাজ তারা করতে চাচ্ছে না। এখন সব মেয়েই স্কুলে যায়। বাসাবাড়ির কাজের জন্য গৃহকর্মীর সঙ্কট দেখা দিয়েছে।
সেমিনারে উৎপাদনশীলতার পাশাপাশি গুদাম বাড়ানো এবং ধানের দাম নিয়ে সঙ্কট সমাধানে স্থায়ী কমিশন গঠনের পরামর্শ দেন ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ। তিনি বলেন, দেশে কৃষককে সংগঠিত করতে হবে। কৃষককে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যান্ত্রিকীকরণের ওপর বেশি জোর দিতে হবে। তিনি বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে কৃষি ক্ষেত্রে যে সমস্যা দেখা দিচ্ছে তাতে কৃষি জমির উর্বরতা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এই অবস্থায় উর্বরতা কিভাবে বাড়ানো যায় তা নিয়েও গবেষণা দরকার বলে উল্লেখ করেন।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন বিসিজেএফ সাধারণ সম্পাদক মোতাহার হোসেন। অনুষ্ঠানে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিসিজেএফ প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক প্রসূন আশীষ ও কৃষি তথ্য সার্ভিসের পরিচালক ড.মোঃ নুরুল ইসলাম। আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন সাবেক কৃষি সচিব ড. আনোয়ার ফারুক, চ্যানেল আইয়ের রফিকুল বাসার, চ্যানেল-২৪ এর জোবায়ের আল মাহমুদ ও কোস্ট ট্রাস্টের নির্বাহী পরিচালক মোঃ রেজাউল করিম চৌধুরী।