৷৷কৃষিতে নারী৷৷ কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম

56

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর “নারী”কবিতায় লিখেছেন …

এ বিশ্বে যত ফুটিয়াছে ফুল, ফলিয়াছে যত ফল, নারী দিলো তারে রূপ-রস-মধু গন্ধ সুনির্মল…।
শস্যক্ষেত্র উর্বর হলো, পুরুষ চালাল হাল, নারী সেই মাঠে শস্য রোপিয়া করিল সুশ্যামল।
নর বাহে হাল, নারী বহে জল, সেই জল মাটি মিশে
ফসল হইয়া ফলিয়া উঠিল সোনালী ধানের শীষে।

কথায় আছে Agriculture is the Pioneer of all culture and Women is the pioneer of Agriculture. নারীর কোমল হাতের পরশে অতনু বীজ সর্বপ্রথম মাটির গভীরে প্রোথিত হয়েছিল, পরে তা অঙ্কুরিত হয়ে উজ্জীবিত হয়ে, শাখা প্রশাখা ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে মানুষের অন্ন বস্ত্র আশ্রয় সেবা ওষুধ পুষ্টি বিনোদনের সহায়ক হয়েছিল। দুদণ্ড শান্তির পসরা বিকোশিত করে দিয়েছিল মানুষের জন্য। নারী মমতাময়ী বলেই মাটির মতো মায়ের মতো এ ধরণীতে কেবল প্রশান্তির জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছে আজীবন আমরণ। নারীর উৎসর্গীপনা জীবন জীবনান্তে স্বর্ণ অক্ষরে লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। অথচ বাংলার নারী আজো অবহেলিত বিভিন্নভাবে ভিন্ন আঙ্গিকে। কোথাও কোথাও কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারী তার মর্যাদা পাওয়া শুরু করেছে। এ ধারা আরো বিকশিত হোক তীব্র হোক যৌক্তিকতা স্থায়ী হোক প্রত্যাশার ডালাভরে সে আশা করছি সেখানেই পৌঁছতে হবে আমাদের। কৃষি নারী ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য আলোকিত গল্প। নারীর অনেক কাজের মধ্যে কৃষিই উল্লেখযোগ্য। কৃষিতে নারীর ভূমিকা আর অবদান এবং সংশ্লিষ্ট সমস্যার সাথে তার উপযুক্ত সমাধানের অভীষ্ট লক্ষ্য নিয়ে এগোতে পারলে আমরা সব কিছু নিয়ে আরো গর্বিত অর্জন করতে পারব আলোকিত সীমান্তে।

দেশে বর্তমান জনসংখ্যার অুনপাত পুরুষ:মহিলা হলো ১০৬ঃ১০০। আমাদের এ দেশে ৯২% পরিবার পুরুষ শাসিত আর মাত্র ৮% পরিবার মহিলা শাসিত। শহরের তুলনায় গ্রামের মহিলাদের প্রভাব একটু বেশি। সাধারণভাবে শিক্ষার হার পুরুষ ৪৫.৫% আর মহিলা ২৪.২%। শহরে একটু ভিন্ন। শহরে ৫২.৫% আর গ্রামে ২০.২০%। একই পরিমাণ সময় একসঙ্গে কাজ করার পর পুরুষরা মহিলাদের চেয়ে বেশি মজুরি পান, অথচ দেখা যায় মহিলারা পুরুষের তুলনায় বেশি কাজ করেন। মোট মহিলাদের মধ্যে ৭১.৫% কৃষি কাজে নিয়োজিত আর সে তুলনায় ৬০.৩% পুরুষ কৃষি কাজে নিয়োজিত। মোট কৃষি ৪৫.৬% বিনামূল্যে মহিলারা শ্রম দেন আর বাকি ৫৪.৪% অংশ শ্রম টাকার বিনিময়ে কেনা হয়।
 

যে নারী কৃষির অগ্রদূত, যে নারী আমাদের কৃষি সমাজ সংসারকে মহিমান্বিত করেছে জীবনের সবটুকু বিনিয়োগ দিয়ে তার কষ্টগাথা আসলেই এখনো অমানবিক। এ দেশে ৮৫% নারীর উপার্জনের স্বাধীনতা নেই। মাত্র ১৫% নারী নিজের ইচ্ছায় উপার্জনের স্বাধীনতা পান। আর যারা আয় করেন তাদের প্রায় ২৪% এরই নিজের আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। তবে গ্রামের তুলনায় শহুরে নারীদের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা বেশি। দেশে ৮৫% নারী কোনো না কোনো কারণে ভিন্নতর নির্যাতনের শিকার। বিবিএসের জরিপে জানা যায় ৯২% খানার প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি স্বামী। আর মাত্র ২.২% নারী পরিবারের প্রধান উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। তবে অল্পসংখ্যক স্বামীই নারীকে উপার্জনের স্বাধীনতা দেন। সেসব স্বামীর ৯৩.১৯% স্ত্রীর উপার্জন করার বিষয়টিকে ভালো চোখে দেখেন না।
 

জমির মালিকানায় পুরুষের আছে ৮১%। আর নারীর মাত্র ১৯%। বাড়ির মালিকানা ক্ষেত্রে ৮৬% পুরুষের বিপরীতে নারীর হার মাত্র ১৪%। ৪৬% নারীর স্বাস্থ্য সেবা নেওয়ার জন্য স্বামীর অুনমতি নিতে হয়। এখনো মেয়ে জন্ম দেওয়ার কারণে ৬% নারী স্বামীর হাতে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আমাদের নারীরা আমাদের দুমুঠো অন্ন জোগাবার জন্য জ্বালানি সংগ্রহের জন্য যত্ন আত্তি সেবা দেওয়ার জন্য আকুল থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, মাস পেরিয়ে বছর এবং আজীবন আমরণ। 
 

 নারী শ্রম শক্তির মধ্যে ৬৮ শতাংশই কৃষি, বনায়ন ও মৎস্য খাতের সাথে জড়িত। কর্মক্ষম নারীদের মধ্যে কৃষিকাজে সবচেয়ে বেশি নারী নিয়োজিত রয়েছেন। ফসলের প্রাক বপন প্রক্রিয়া থেকে শুরু করে ফসল উত্তোলন, বীজ সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এমন কি বিপণন পর্যন্ত অনেক কাজ নারী এককভাবেই করে। বলা চলে কৃষি ও এর উপখাতের মূল চালিকাশক্তি হচ্ছে নারী। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক কোনো পরিসংখ্যানে কৃতজ্ঞচিত্তে নারীর এ উপস্থিতির কোনো হিসাবে স্বীকৃতি নেই। এমনকি কৃষি কাজে জড়িত এ বিপুল নারী শ্রমিকের তেমন কোনো মূল্যায়নও করা হয় না। এখনো গ্রামীণ সমাজে কৃষি ও চাষের কাজকে নারীর প্রাত্যহিক কাজের অংশ বলে বিবেচনা করা হয়। সেখানে মজুরি প্রদানের বিষয়টি অবান্তর। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নামমাত্র মজুরি দেয়া হয়।  সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পুরুষ শ্রমিকের সমান কাজ করলেও কৃষিখাতে নারী শ্রমিকের বৈধ পরিচিতি নেই। কাজ করে নারী নাম কেনে পুরুষ। এ ছাড়া অন্যান্য অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতের অন্য নারী শ্রমিকের মতোই কৃষিখাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকেরাও তীব্রভাবে বৈষম্যের শিকার হন। কাজে স্বীকৃতির অভাব চরমভাবে লক্ষণীয়। এ ছাড়া নিয়মহীন নিযুক্তি, দীর্ঘ কর্মঘণ্টা, নারীর অধিক আন্তরিকতা, অল্প মজুরি, মজুরি বৈষম্য, দুর্ব্যবহার এবং আরো নানা ধরনের নিপীড়ন তো রয়েছেই।
 

২০০৫-০৬ সনের শ্রমশক্তির জরিপ অনুযায়ী বর্তমানে দেশে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ নারী শ্রমিকের ৭৭ শতাংশই গ্রামীণ নারী। দেশে গত এক দশকে অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সাথেযুক্ত প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ বাড়তি শ্রমশক্তির ৫০ লাখই নারীশ্রমিক। ১৯৯৯-২০০০ থেকে ২০০৯-২০১০ সময়ে দেশে কৃষি, বন ও মৎস্য, পশুপালন, হাঁস-মুরগি পালন, মাছচাষ, কৃষিকাজে নিয়োজিত নারীশ্রমিকের সংখ্যা ৩৭ লাখ থেকে বেড়ে প্রায় ৮০ লাখ হয়েছে। এ বৃদ্ধির হার ১শ’ ১৬ শতাংশ। যদিও এসব নারীশ্রমিকের ৭২ শতাংশই অবৈতনিক পারিবারিক নারীশ্রমিক। ক্ষুধার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত এসব নারীর অবদানের স্বীকৃতি আলোচনার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। শ্রমিক হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের কোনো স্বীকৃতি নেই। অথচ এ সময় এ খাতে পুরুষশ্রমিকের সংখ্যা কমেছে ২.৩ শতাংশ। ২০০২-০৩ সময়ের তুলনায় বর্তমানে কৃষি, বন ও মৎস্য খাতে পুরুষশ্রমিকের অংশগ্রহণ কমেছে ১০.৪ শতাংশ। বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, উন্নয়নকর্মী, সম্প্রসারণকর্মী, গবেষক ও নারী নেত্রীরা মনে করছেন দেশের কৃষি ও কিষাণ-কিষাণীর সার্বিক উন্নতির স্বার্থে সামগ্রিক কৃষি সংস্কার কর্মসূচি জরুরিভিত্তিতে হাতে নিতে হবে। সে সাথে সরকারকে গ্রামীণ নারীশ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার রক্ষায় প্রাতিষ্ঠনিক ব্যবস্থা ও কৃষিতথ্য পৌঁছে দেয়ার বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। ৭৭ শতাংশ গ্রামীণ নারী কৃষিসংক্রান্ত কাজে নিয়োজিত থাকলেও তাদের স্বীকৃতি সেভাবে নেই। কৃষিতে কিষাণীর অবদানের রাষ্ট্রীয়ভাবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের আওতায় স্বীকৃতি ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে।
 

শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী ১৫ থেকে ৬৫ বছর বয়সী মানুষ যারা কাজ করছেন, কাজ করছেন না কিন্তু কাজ খুঁজছেন জনগোষ্ঠীর এমন অংশকেই শ্রমশক্তি হিসেবে ধরা হয়। গত এক দশকে ১ কোটি ২০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে কৃষি, বন ও মৎস্য খাতেই যুক্ত হয়েছে ৩০ লাখ কর্মসংস্থান। অর্থনীতির উদ্বৃত্ত শ্রমের ধারণায় কৃষিতে পারিবারিক শ্রমের প্রাধান্য থাকায় শ্রমের প্রান্তিক উৎপাদনশীলতা কখনো কখনো শূন্য হয়ে দাঁড়ায়।  শ্রমশক্তির সংজ্ঞানুযায়ী, ২৯ শতাংশ নারীই কেবল শ্রমশক্তির অংশ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন। বাকিরা নিশ্চিতভাবে নানান অবৈতনিক পারিবারিক কাজে নিয়োজিত থাকার পরও শ্রমশক্তির অংশ হিসেবে অদৃশ্যই থাকছেন। সিএসআরএলের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৮১ শতাংশ নারী গৃহকর্মে সরাসরি অবদান রাখছেন। তাদের অনেকে কিষাণী, তবে তা শ্রমশক্তির বিবেচনায় অদৃশ্য। কৃষিখাতের ২১টি কাজের ধাপের মধ্যে নারীর অংশগ্রহণ ১৭টি ধাপে অথচ কৃষি কাজে সেভাবে নারীর স্বীকৃতি মর্যদা সম্মান নেই। একজন গ্রামীণ নারী প্রতিদিন তার ঘর গোছানো রান্না পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা জ্বালানি সংগ্রহ সব মিলিয়ে অন্তত ১৫ থেকে ১৭ কিলোমিটার হাঁটাহাঁটি করেন। আমরা ভাবছি সে আমার মা, সে আমার বোন, সে আমার স্ত্রী কত কিছু করছেন? তার বিনিময়ে করুনা নয় তার যথাযোগ্য প্রাপ্যটুকু আমরা মেটানোর চেষ্টা করলেই তো অনেক হয়ে যায়। আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমেই কেবল টেকসই কৃষি ব্যবস্থার পাশাপাশি কৃষক ও কৃষি শ্রমিক উভয়ের স্বার্থরক্ষা সম্ভব। নারী কৃষি শ্রমিকদের নিবন্ধন ও পরিচয়পত্র প্রদান, একই ধরনের কাজে পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করা, বেশি কাজে বেশি সম্মান স্বীকৃতি, সরকারি কৃষি কর্মকাণ্ডে নারীদের অগ্রাধিকার দেয়া, কৃষিকাজে নারী শ্রমিকদের পেশাগত স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, প্রান্তিক সুবিধাদি ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিতে নারী কৃষিশ্রমিক তথা কৃষাণীদের অগ্রাধিকার দেয়াসহ আরো বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেন।
 

কৃষিতে নারীর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য হিসেবে বেছে নিয়েছিল ১৯৮৪ কৃষিতে নারী, ১৯৯৯ অন্ন জোগায় নারী এ স্লোগান নির্ধারিত হয়েছিল। ১৯৯৫ সনে জাতিসংঘের উদ্যোগে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে ১৮৯টি দেশের প্রায় ৩০ হাজার প্রতিনিধির উপস্থিতিতে সর্বসম্মতভাবে নারী উন্নয়নের সামগ্রিক রূপরেখা হিসেবে বেইজিং ঘোষণা ও প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশন গৃহীত হয়। নারী উন্নয়নের বৈশ্বিক নির্দেশিকা হিসেবে এ প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশনের আলোকে নিজ নিজ দেশে নারী উন্নয়ন নীতি ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়। প্ল্যাটফরম ফর অ্যাকশনের মূল লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে পূর্ণ এবং সমঅংশীদারিত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয় ও ব্যক্তিগত জীবনের সব পরিম-লে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের পথে বাঁধাগুলো দূর করা। সে সাথে গৃহ, কর্মক্ষেত্র ও জাতীয়-আন্তর্জাতিক সব পরিসরে নারী-পুরুষের মধ্যে সমতা এবং দায়দায়িত্ব সমবণ্টনের নীতি প্রতিষ্ঠিত করা। এরই আলোকে ২০১১ সনে নারী উন্নয়ন নীতি প্রণীত ও মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়েছে। 
 

জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ সনে মোট ৩টি ভাগে ৪৯টি অধ্যায় রয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে ১৬.১-বাংলাদেশ সংবিধানের আলোকে রাষ্ট্রীয় ও জনজীবনের সব ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করা, ১৬.৮-নারী পুরুষের বিদ্যমান বৈষম্য নিরসন করা, ১৬.৯-সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিম-লে নারীর অবদানের যথাযথ স্বীকৃতি প্রদান করা, ২৩-৫-সম্পদ, কর্মসংস্থান, বাজার ও ব্যবসায় নারীকে সমান সুযোগ ও অংশীদারিত্ব দেয়া,২৩.৭-নারী-পুরুষ শ্রমিকদের সমান মজুরি, শ্রমবাজারে নারীর অংশগ্রহণ ও কর্মস্থলে সমসুযোগ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত এবং চাকরির ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা, ২৩.১০-সরকারের জাতীয় হিসাবে, জাতীয় উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে কৃষি ও গার্হস্থ্য শ্রমসহ সব নারী শ্রমের সঠিক প্রতিফলন মূল্যায়ন নিশ্চিত করা, ২৬.১-নারী শ্রমশক্তির শিক্ষিত ও নিরক্ষর উভয় অংশের কর্মসংস্থানের জন্য সর্বাত্মক উদ্যোগ গ্রহণ করা, ২৬.৫-নারীর বাড়তি হারে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ, অবস্থান ও অগ্রসরমানতা বজায় রাখার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় পরিবেশ গড়ে তোলা, ২৬.৬-নারীর ব্যাপক কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সব অইন, বিধি ও নীতির প্রয়োজনীয় সংস্কার করা, কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে খাদ্য নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে কৃষির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
 

কৃষিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নারীর শ্রম ও অংশগ্রহণ বিশ্বব্যাপী সর্বজনবিদিত। ৩১.১-জাতীয় অর্থনীতিতে নারী কৃষি শ্রমিকের শ্রমের স্বীকৃতি প্রদান করা, ৩১.২-জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগের কারণে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতা দূরীকরণে নারী কৃষি শ্রমিকদের সব রকম সহায়তা প্রদান করা, ৩১.৩-কৃষিতে নারী শ্রমিকের মজুরি বৈষম্য দূরীকরণ এবং সমকাজে সমমজুরি নিশ্চিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। এসব ধারা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হলে কৃষি নারী শ্রমিদের অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত হবে এ কথা জোর দিয়ে বলা যায়। শুধু তা-ই না এ দেশের কৃষি উন্নয়নসহ অন্যান্য উন্নয়ন সমৃদ্ধি আরো বেগবান হবে।
 

কোনো দেশে প্রতিটি উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারীকে সম্পৃক্ত করার বিষয়টি গুরুত্ব দিলে বৈষম্য থেকে এ অর্ধেক জনগোষ্ঠীকে রক্ষা করা সম্ভব। সমাজ তথা রাষ্ট্রে নারীর ক্ষমতায়নে নারীর কাজের সামাজিক ও আর্থিক স্বীকৃতি আবশ্যক। রাষ্ট্রীয় সামাজিক বা পারিবারিকভাবে কৃষির সাথে জড়িত নারীর কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে। সে সাথে এ খাতে নারীর মজুরি বৈষম্যসহ সব প্রতিবন্ধকতা দূর করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। কৃষিনির্ভর অর্থনীতির দেশে কৃষিকে যেমন উপেক্ষা করা যায় না, তেমনি এ খাতে নারীর অবদানকেও আজ অস্বীকার করার উপায় নেই। কৃষিখাতে নিয়োজিত নারী শ্রমিকের স্বীকৃতি ও ন্যায্য মজুরি প্রদান নিশ্চিত করতে পারলে দেশের কৃষি উৎপাদন কাজে নারীরা আরো আগ্রহী হবে। এর ফলে কৃষিখাতের উৎপাদন বাড়বে, জিডিপিতে কৃষির অবদানও বাড়বে। তাই কৃষিকাজে জড়িত নারী শ্রমিকদের মূল্যায়নে সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
 

কৃষিতে নারীর সংশ্লিষ্টতা অবদান ব্যাপক ও বিস্তৃত। এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য হলোÑ বীজ সংরক্ষণ; বীজ বাছাই, শোধন ও অঙ্কুরোদগম বীজ শোধন; বীজতলায় বীজ বপন; চারা তোলা; চারা রোপণ; কৃষি পঞ্জিকা পুষ্টিসম্মত রান্না কৌশল; খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ; কর্তন উত্তর কৌশল; শস্য সংরক্ষণ; কৃষি উৎপাদন পরিকল্পনা; কৃষি শ্রমিক ব্যবস্থাপনা; জৈবকৃষি;  মুরগি পালন; হাঁস পালন; ছাগল পালন; গরু পালন; দুধ দোহন; গরু মোটাতাজাকরণ; ডিম ফোটানো; হাঁস-মুরগি পালন; বসতবাড়িতে শাকসবজি ফল  ফুল চাষ; ভেষজ চাষ; কবুতর পালন; কোয়েল পালন; নার্সারি ব্যবস্থাপনা; মাতৃগাছ ব্যবস্থাপনা; মৌচাষ ; শীতল পাটি হোগলা তৈরি; অঙ্গজ বংশবিস্তার; বায়োগ্যাস কার্যক্রম; বনসাই/অর্কিড/ক্যাকটাস চাষ; কুল বার্ডিং; খাঁচায় মাছ চাষ; পুকুরে আধুনিক উপায়ে মাছ চাষ; জ্যাম জেলি আচার কেচাপ স্যুপ আমসত্ত্ব তালসত্ত্ব; মাছের সাথে হাঁস-মুরগির চাষ; ভাসমান সবজি চাষ; ঘাস চাষ; উন্নত চুলায় রান্না; কুটির শিল্প; মাশরুম চাষ; আলুর কলার চিপস; চানাচুর তৈরি; ছাদে বাগান; বাহারি মাছ; পারিবারিক শাকসবজি সংগ্রহ; পারিবারিক শাক ফলমূল সংরক্ষণ; জ্বালানি সংগ্রহ; কৃষি বনায়ন; সামাজিক বনায়ন…। এর সবগুলোতেই নারী সংশ্লিষ্ট। কোনটাতে এককভাবে আবার কোনটাতে যৌথভাবে। উল্লেখ করলাম কিছু থেকে গেল তার চেয়েও বেশি। ভাবতে হবে নারী আমাদের উন্নয়ন সমৃদ্ধির আবশ্যকীয় অংশীদার। সুতরাং তাদের মান মর্যদা পাওনা স্বীকৃতি যৌক্তিকভাবে যথাযথভাবে দেয়া নিশ্চিত করতে পারলে আমরা আরো দূরের আলোকিত বাতিঘরে পৌঁছতে পারব কম সময়ের মধ্যে।
সিডিপির সংলাপে জানা যায় একজন নারী প্রতিদিন গড়ে ১২.১টি কাজ করে ব্যয় করেন ৭.৭. ঘণ্টা। পুরুষ করেন ২.৭টিতে করেন ২.৫ ঘণ্টা। অর্থাৎ নারী পুরুষের তুলনায় ৩ গুণ বেশি কাজ করেন। জাতীয় আয়ে নারীর যে পরিমাণ কাজের স্বীকৃতি আছে তার চেয়ে ২.৫ থেকে ২.৯ গুণ কাজের স্বীকৃতি নেই। নারী যে পরিমাণ কাজে স্বীকৃতি আছে সে হারে ২.৫ গুণ কাজের স্বীকৃতি নেই। নারী ঘরে করে এমন কাজের আর্থিক মূল্য গত অর্থবছরের জিডিপির ৭৬.৮০ শতাংশ। চলতি টাকার মূল্যে তা ১০ লাখ ৩৭ হাজার ৫০৬ কোটি টাকা। স্থায়ী মূল্যে এটা ৫ লাখ ৯৪ হাজার ৮৪৫ কোটি টাকা। আমাদের নারীদের গৃহস্থালির কাজ রান্না, বাড়িঘর পরিষ্কার, পরিচ্ছন্নতা, সদস্যদের সেবা যত্ন পরিচর্যা সহায়তা এগুলোর কোনো মূল্য নেই। যদি এসব শ্রম কিনতে হতো তখন তা দাঁড়াতো জিডিপির ৮৭.২ যার আর্থিক মূল্য ১১ লাখ ৭৮ হাজার ২ কোটি টাকা। স্থায়ী মূল্যে এটি দাঁড়ায় ৬ লাখ ৭৫ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা। কত হাজার টাকার প্রয়োজন হতো। মজুরিবিহীন কাজে সম্পৃক্ত নারীদের তিন চতুর্থাংশ মজুরি পাওয়া যাবে এমন কাজ করতে চান না। শহরে এর সংখ্যা ৮০.১৭% আর গ্রামে ৭১.১১%। মজুরি নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী নন এমন নারীদের ৬০% বলছেন পরিবার চান না তারা বাইরে কাজ করুক। মজুরির টাকা খরচ করেতে ৪০% নারীকে পরিবারের সাথে আলোচনা করতে হয়। আর ৫১.৭% নারী নিজেদের ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারেন। দেশের ৮৯% নারী অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত আছেন যারা কোনো মজুরি পান না।

আমাদের টোটাল মানসিকতা যৌক্তিকভাবে বদলাতে হবে; পুষ্টিতে তুষ্টিতে যুক্তিতে নারীর পাওনা অধিকারকে সমানভাবে প্রাপ্যতা অনুযায়ী সুনিশ্চিত করতে হবে; নারীকেই শিক্ষা প্রশিক্ষণ দিয়ে আরো দক্ষ করে তুলতে হবে; নারী বলে কোনো রকম বৈষম্য অবহেলা করা চলবে না; নারী আইনগত অধিকার, বিনিয়োগী অধিকার, অবদানের স্বীকৃতি যথাযথভাবে দিতে হবে; নারী যেমন পুরুষের কাজে সার্বিক আন্তরিক সহযোগিতা করে তেমনি নারীর কাজেও পুরুষের সার্বিক সহযোগিতা আবশ্যকীয়ভাবে করতে হবে; জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত জন্য জাতীয় হিসাব ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা; গৃহস্থালির কাজের ভার কমানোর জন্য সুনিদর্িৃষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ; নারীর মজুরি বাড়ানো; যারা আয় করেন তাদের ইচ্ছে মতো খরচ করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে; ঘরে বাইরে কাজ করার পর নারীর পর্যাপ্ত বিশ্রাম আবশ্যকীয়ভাবে দরকার; নারীর সব অবদান যথাযথভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে; নারীদের প্রকৃত মর্যদা দিতে হবে;

আমরা সবাই যদি সচেতন হই তাহলে অনেক এগিয়ে যেতে পারব এতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু প্রয়োজন আইন মতো, নীতি মতো, হক মতো এবং মনের আসল চাহিদার সাথে মিলিয়ে বিবেক মতো আমরা সব কাজে এগিয়ে যাবো, এগিয়ে নিয়ে যাবো। আমার মায়ের অবদান জাতীয় জিডিপিতে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। নারীকে অবহেলা করে দূরে রেখে বাইরে রেখে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কখনো সফল হবে না। আমাদের জাতীয় কবির সাথে একমত হয়ে বলি সেদিন সুদূর নয়-যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়। বাংলার নারীর সার্বিক কল্যাণ হোক মঙ্গল হোক।