বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে ছাত্রলীগের কমিটি পুনর্গঠনে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ॥ আমি তো হাইব্রিড ছাত্রলীগ চাইনি, আমি চেয়েছি ত্যাগী ছাত্রলীগ

25

কাজিরবাজার ডেস্ক :
সদ্য ঘোষিত ছাত্রলীগের ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটিতে ঠাঁই পাওয়া বিতর্কিতদের বাদ দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে যোগ্যদের অন্তর্ভুক্ত করে কমিটি পুনর্গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। কমিটি পুনর্গঠনের দাবিতে ছাত্রলীগের একটি বড় অংশের বিক্ষোভ ও তাদের ওপর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক সমর্থকদের হামলার ঘটনায় সমালোচনার মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী এ নির্দেশ দেন।
বুধবার দুপুরে ছাত্রলীগের সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে গণভবনে ডেকে সংগঠনের অভিভাবক হিসেবে তিনি এ নির্দেশ দিয়েছেন বলে জানা গেছে। সূত্রগুলো বলছে, ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন এবং সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে ধমক দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছাত্রলীগের সর্বোচ্চ অভিভাবক হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শোভন-রাব্বানীর ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘আমি তো হাইব্রিড ছাত্রলীগ চাইনি, আমি চেয়েছি ত্যাগী ছাত্রলীগ।’
এ সময় ৩০১ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটির সবার বিষয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের একটি তালিকা প্রধানমন্ত্রী তাদের হাতে ধরিয়ে দেন।
এর মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে তদন্ত করে প্রমাণ পাওয়া সাপেক্ষে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেন শেখ হাসিনা। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই বিতর্কিতদের পদ বিলুপ্ত করে সেই পদে ত্যাগী ও যোগ্য ছাত্রলীগ নেতাদের পদ দেয়ার বিষয়েও নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
এ সময় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক, উপ-দফতর সম্পাদক ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী বিপ্লব বড়ুয়া এবং কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য এসএম কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন। গণভবন থেকে ফিরে এসে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন বলেন, কমিটিতে যেগুলো সম্পর্কে কথা হচ্ছে, তাদের ব্যাপারে তদন্ত কমিটি গঠন করে সত্য প্রমাণিত হলে সেই পদগুলো শূন্য ঘোষণা করে ত্যাগী ও যোগ্যদের মূল্যায়ন করব। তবে কমিটি বর্ধিতকরণের ব্যাপারে কোন নির্দেশনা দেননি।
তবে গোলাম রাব্বানী বলেন, আপা (প্রধানমন্ত্রী) খুব খুশি হয়েছেন। কমিটির প্রতি তিনি সন্তুষ্ট। এবারের কমিটিতে বিকেন্দ্রীকরণে; মানে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের বাইরের অনেক শিক্ষার্থী পদ পেয়েছে। বিভিন্ন জেলা থেকেও গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছে। তবে তিনি অসঙ্গতি থাকলে তাদের ব্যাপারে তদন্ত কমিটি করে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন।
এদিকে মধুর ক্যান্টিনে হামলা ও এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফের দেয়া বক্তব্যের প্রতিবাদে বুধবার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে মানববন্ধন করেছেন পদবঞ্চিত ও প্রত্যাশিত পদ না পাওয়া নেতাকর্মীরা। নেতাকর্মীরা হানিফের বক্তব্যের কড়া সমালোচনা করে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন, ‘নারী নেত্রীরা আর কতটা লাঞ্ছিত হলে আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছে তা বড় ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হবে?’
মধুর ক্যান্টিনে পদবঞ্চিত পক্ষের নারী নেত্রীসহ কয়েকজনের ওপর ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সমর্থকদের হামলার ঘটনা তদন্তে গঠিত কমিটির ভূমিকা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেছেন তারা।
সোমবার মধুর ক্যান্টিনে নারী নেত্রীদের ওপর হামলা ও শারীরিক লাঞ্ছনার প্রতিবাদে এ মানববন্ধনের আয়োজন করা হয়। পূর্ণাঙ্গ কমিটিকে ‘বিতর্কিত’ আখ্যা দিয়ে সংবাদ সম্মেলন করতে গেলে তাদের ওপর হামলা হয় সেদিন মধুর ক্যান্টিনে। এ ঘটনা নিয়ে মঙ্গলবার সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল আলম হানিফ বলেন, ‘এটা অত্যন্ত সামান্য ঘটনা, এটা নিয়ে আমার মনে হয় খুব বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করার কিছু নেই। ছাত্রলীগ সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকই এই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন।’
তার বক্তব্যের সমালোচনা করে মানববন্ধনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শামসুন নাহার হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও ডাকসুর সদস্য (ছাত্রলীগের নতুন কমিটির সংস্কৃতিবিষয়ক উপসম্পাদক) নিপু ইসলাম তন্বী বলেন, আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের প্রতি শ্রদ্ধা রেখেই প্রশ্ন রাখতে চাই, মধুর ক্যান্টিনের ঘটনাটি কোন পর্যায়ে গেলে তাদের মনে হতো এটি একটি বিশাল আকারের ঘটনা? আমাদের আর কতটুকু লাঞ্ছিত করলে তাদের মনে হতো ছাত্রলীগের নারীদের ওপর নির্যাতন হয়েছে? প্রশ্ন ওঠে, আমরা মারা যাওয়ার পরে কি তাহলে ঘটনাটির সত্যতা প্রকাশ পেত?
নিপু ইসলাম তন্বী আরও বলেন, ‘মধুর ক্যান্টিনের মতো জায়গায় যখন ছাত্রলীগের কিছু ছোট ও বড় ভাইয়ের হাতে আমরা নির্যাতিত হই, সত্যিকার অর্থেই এরপরে কোন বাবা, মা, ভাই কিংবা বোন ছাত্রলীগ করার জন্য তাদের ঘরের সন্তানকে পাঠাবেন না। নারী নেতৃত্বের ওপর আর কত আঘাত এলে টনক নড়বে? কবে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছ থেকে আমরা বিবৃতি পাব যে ছাত্রলীগের নারী নেতৃত্বের ওপর হামলা হয়েছে?’
মধুর ক্যান্টিনের ঘটনায় ছাত্রলীগের তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির বিষয়ে তন্বী বলেন, ওই তদন্ত কমিটি আমরা যারা ভুক্তভোগী, তাদের সঙ্গে কোন ধরনের আলোচনায় আসেনি। তাহলে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়ে যে তদন্ত কমিটি করা হলো, সেটি কি আমাদের সঙ্গে শুধুই প্রহসন করা হলো না? তদন্ত কমিটিকে বেঁধে দেয়া সময় আজই শেষ হচ্ছে। এর মধ্যে কমিটি আমাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ করেনি।
রোকেয়া হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি এবং ডাকসুর কমনরুম ও ক্যাফেটারিয়া সম্পাদক লিপি আক্তার (ছাত্রলীগের নতুন কমিটির সংস্কৃতিবিষয়ক উপসম্পাদক) বলেন, নতুন কমিটি ছাত্রলীগের গৌরব-ঐতিহ্যের সঙ্গে যায় না। নতুন কমিটির ৫৯ জনের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে। এর বাইরে ২২ জন এবারই প্রথম পদ পেয়েছেন। আমরা মনে করি, বিগত দিনে দু-একটা পোস্ট পেরিয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগে আসা উচিত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদ ছাত্রলীগের সভাপতি শরিফুল হাসান শুভ বলেন, অনেক ত্যাগী কর্মীকে বঞ্চিত করে নিজেদের অনুগতদের কমিটিতে পদ দেয়া হয়েছে। যারা শুরু থেকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করেছে তাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। উল্টো এর প্রতিবাদ করলে আমাদের বোনদের ওপর হামলা চালিয়েছে তারা। বিতর্কিত এই কমিটি মানি না। অবিলম্বে কমিটি বাতিল করে নতুন কমিটি ঘোষণার জোর দাবি জানাই।
মানববন্ধনে অন্যদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রলীগের আগের কমিটির প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক সাইফ বাবু, কর্মসূচি ও পরিকল্পনা সম্পাদক রাকিব হোসেন, কবি জসীম উদ্দীন হল শাখার সাধারণ সম্পাদক শাহেদ খান, রোকেয়া হল শাখার সভাপতি বিএম লিপি আক্তার, স্কুলছাত্র বিষয়ক সম্পাদক জয়নাল আবেদীন, সাবেক সদস্য তানভীর হাসান সৈকত, শামসুন নাহার হল শাখার সভাপতি নিপু ইসলাম তন্বী, সাধারণ সম্পাদক জিয়াসমিন শান্তা প্রমুখ।