আত্মশুদ্ধির মাস মাহে রমজান

185

মো: শামসুল ইসলাম সাদিক
অনন্য সাধারণ ও মহিমান্বিত মাস হলো পবিত্র রমজান মাস। এই মাস নি:সন্দেহে অন্যান্য মাস থেকে আলাদা ও শ্রেষ্ঠত্বের দাবি রাখে। আরবি মাসসমূহের নবম মাস হচ্ছে রমজান মাস। সারা বিশ্বের মুসলিমদের জন্য সিয়াম সাধনার পবিত্রতম মাস এটি। ইসলাম ধর্মের পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে রোজা তিন নম্বর। কোরআনে আল্লাহ পাক নিজের সঙ্গে রোজার সম্পর্কের কথা ঘোষণা করেছেন। সব ইবাদত-বন্দেগি থেকে রোজাকে আলাদা মর্যাদাও দিয়েছেন। রোজা শব্দটি ফারসি। এর আরবি পরিভাষা হচ্ছে সওম, বহুবচনে বলা হয় সিয়াম। সওম অর্থ বিরত থাকা, পরিত্যাগ করা অথবা জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেওয়া। পরিভাষায় সওম হলো রাব্বে কারিমের সন্তুটি অর্জনের লক্ষে সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তসহকারে পানাহার ও স্ত্রী সহবাস থেকে বিরত থাকা।
দ্বিতীয় হিজরি শাবান মাসে রমজানের রোজা ফরয করা হয়। নামাযের মতো এই রোজাকে পূর্ববর্তী সকল নবীর শরীয়তেই ফরয করা হয়েছিল। এ সম্পর্কে কোরআনের বলা হয়েছে, হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরয করা হয়েছে যেমন ফরয করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি, যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হতে পারো, পরহেজগার হতে পারো। (সুরা বাকারা: আয়াত- ১৮৩)।
মানবতার মুক্তির সনদ আল কোরআন এ মাসে নাজিল করা হয়। তাই এ মাসের পবিত্রতা, মাহাত্ম্য ও মহিমা নি:সন্দেহে অতুলনীয়। আল্লাহ তায়ালা সুস্পষ্টভাবে এরশাদ করেন, ‘রমজান এমন এক মহিমাময় ও গৌরবামন্বিত মাস, যে মাসে (কালামে পাক) কোরআন শরীফ নাজিল হয়েছে’। নিশ্চয়ই আমি এই কোরআনকে কদরের রাত্রিতে নাজিল করেছি। ‘রমজান মাসে কোরআন নাজিল করা হয়েছে আর এ কোরআন মানবজাতির জন্য সঠিক পথের দিশা, সৎপথের সুস্পষ্ট নিদর্শন, সত্য-ন্যায়ের পার্থক্যকারী’। (সূরা বাকারা: আয়াত- ১৮৫)। ‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি এ মাসটি পাবে সে যেন রোজা রাখবে, যদি সে অসুস্থ হয়ে পড়ে কিংবা সফরে থাকে, সে পরবর্তী সময়ে গুনে গুনে সেই পরিমাণ দিন পূরণ করে দেবে’। ‘আল্লাহ্ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান, তোমাদের জন্য কঠিন করতে চান না, যাতে তোমরা গণনা পূরণ করো এবং তোমাদের হিদায়াত দান করার দরুন আল্লাহর মহত্ত্ব বর্ণনার পর কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো’।
কোরআন শরীফের ন্যায়, পূর্ববর্তী আসমানি গ্রন্থসমূহ ও সহীফাগুলোও রমজান মাসে নাজিল করা হয়। রমজান মাসের পহেলা (অথবা ৩রা তারিখে) হযরত ইব্রাহীম (আ:) সহীফা লাভ করেন, এই মাসের ৬ তারিখে, হযরত মূসা (আ:)-এর কাছে ‘তাওরাত’ নাযিল করা হয়। এই মাসের ১২ তারিখে, হযরত দাউদ (আ:)-এর কাছে ‘জাবুর’ নাযিল করা হয়। আর এই মাসের ১৮ তারিখে হযরত ঈসা (আ:)-এর ‘ইঞ্জিল’ নাযিল করা হয়। এ থেকে সহজেই রমজান মাসের গুরুত্ব, পবিত্রতা ও মাহাত্ম্য বোঝা যায়। ‘উপবাস ব্রত’ পৃথিবীর সকল ধর্মেই রয়েছে। তবে সুদীর্ঘ এক মাসব্যাপী ভোর (সুবহে সাদিক) থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত উপবাস এবং সেই সঙ্গে কঠোর সংযম সাধনার বিধান ইসলাম ছাড়া পৃথিবীতে অন্য কোনো ধর্মে নেই। ‘রমজ’ শব্দ থেকে এসেছে ‘রমজান’। ‘রমজ’ শব্দের অর্থ হলো জ্বালিয়ে দেওয়া, দগ্ধ করা। রমজানের সিয়াম সাধনা মানুষের মনের কলুষ-কালিমা পুড়িয়ে নষ্ট করে দিয়ে মনকে নির্মল ও পবিত্র করে তোলে, পাপরাশিকে সম্পূর্ণরূপে দগ্ধ করে মানুষকে করে তোলে খাঁটি ও পুণ্যবান, তাকওয়া অর্জনের জন্য, গুনাহ বর্জন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য।
রমজানের রোজা তিনটি ভাগে বিভক্ত ‘রহমত’ ‘মাগফেরাত’ ও ‘নাজাত’। প্রথম দশদিন পৃথিবীর উপরে পরম করুণাময় আল্লাহ অসীম রহমত ঝরে পড়তে থাকে, তাঁর রোজাদার বান্দাদের উপরে। দ্বিতীয় দশদিনে পাওয়া যায় ‘মাগফেরাত’ বা ক্ষমা, অন্যায় কাজ ও চিন্তার জন্য ক্ষমা, পাপরাশি ও চারিত্রিক অবক্ষয়ের জন্য ক্ষমা। শেষের দশদিনে পাওয়া যায় মুক্তি-দোজখের আযাব থেকে মুক্তি, পাপ থেকে মুক্তি, যৌন-ক্ষুধা থেকে মুক্তি, কামনা থেকে মুক্তি, অশ্লীলতা থেকে মুক্তি, লোভ-লালসা থেকে মুক্তি, সকল প্রকারের অযৌক্তিক বন্ধন থেকে মুক্তি, সকল অশুভ কার্যকলাপ ও অন্যায় থেকে মুক্তি। আর এই মুক্তির জন্য ইতেকাফের সাধনা। রমজানের এই রোজার মাধ্যমে সংযম সাধনার ফলে মানুষের পক্ষে সম্ভব হয় রাব্বে কারিমের নৈকট্য লাভ করার। কারণ, রমজানের ‘রোজা’ মানুষের মনের পাপাত্মাকে সংযত করে, অসহায়-দরিদ্র ক্ষুধার্তদের কষ্ট ও যন্ত্রণা, ব্যথা ও বেদনা হৃদয়র্টাচ করতে সাহায্য করে, মানুষকে শিক্ষা দেয় ধৈর্য্যের। রমজানের ফজিলত সম্পকে রাসূলে পাক (সা:)-ইরশাদ করেছেন, “আমি সেই মহান সত্ত্বার কসম করে বলিতেছি, যাঁহার হাতে আমার প্রাণ, নিশ্চয় জানিও আল্লাহর নিকট রোজাদারের মুখের দুর্গন্ধ মেশক বা কস্তুরীর চেয়ে অধিক উত্তম। রাসূলে পাক (সা:)- আরো এরশাদ করেছেন, “রোজাদারের নিদ্রা ইবাদতের সমতুল্য। তাহার নীরবতা তসবীহ পড়ার সমতুল্য। সে সামান্য ইবাদতেই অন্য সময় অপেক্ষা অনেক বেশি সাওয়াবের অধিকারী হয়, তার দোয়া কবুল হয় এবং গোনাহ মাফ হয়। ঈমান ও ইতেকাফের সাথে যে ব্যক্তি রোজা রাখবে তার অতীতের সব গোনাহ-অপরাধ মাফ করে দেওয়া হবে”।
‘রোজা’-এর মাধ্যমে মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভের সর্বাত্মক চেষ্টা করা সকল মুসলমানের একান্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য। রোজা, তারাবিহ ও সারা মাস সংযম সাধনার মাধ্যমে আল্লাহর রহমত লাভের এই সুযোগ আর কোনো মাসেই পাওয়া যায় না। রমজান মাসে যেভাবে আল্লাহর রহমত আমাদের উপর বর্ষিত হয়, সে অসাধারণ সুযোগ আমরা কেউ কোনো দিনও হারাতে চাই না। আল্লাহ এরশাদ করেন- “মানুষ যত প্রকার নেকী বা নেক কাজ করে আমি তার সাওয়াব দশগুণ থেকে সাতশত গুণ পর্যন্ত বৃদ্ধি করে দেই। কিন্তু রোজা এই নিয়মের বহির্ভূত। রোজার সাওয়াব এভাবে সীমাবদ্ধ বা সীমিত নয়। রোজার পুরস্কার আমি স্বয়ং নিজ হাতে প্রদান করব।”
হযরত আবু হুরায়রা (রা:)-থেকে বর্ণিত, রাসুলে পাক (সা:)-ইরশাদ করেছেন, যখন রমজান মাস আসে আসমানের দরজাগুলো খুলে দেওয়া হয় এবং দোজখের দরজাগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, আর মানব জাতির প্রকাশ্য শত্রু শয়তানকে শৃঙ্খলিত করা হয়। (বুখারী, মুসলিম)। হযরত শাহ্ ইবনে সা’দ (রা:)-থেকে বর্ণিত, রাসুলে পাক (সা:)-ইরশাদ করেছেন, বেহেশতের ৮টি দরজা রয়েছে। এর মধ্যে ১টি দরজার নাম রাইয়ান। রোজাদার ব্যতিত আর কেউ ওই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। (বুখারী, মুসলিম)। রাসুলে পাক (সা:)-ইরশাদ করেছেন, রোজা মানুষের জন্য ঢালস্বরুপ যতক্ষণ পর্যন্ত তা ফেড়ে না ফেলা হয় (অর্থাৎ রোজা মানুষের জন্য জাহান্নাম থেকে মুক্তির কারণ হবে যতক্ষণ পর্যন্ত তা নিয়ম অনুযায়ী পালন করা হয়)। (ইবনে মাজাহ, নাসাঈ)। রোজাদারের খুশির বিষয় ২টি- যখন সে ইফতার করে তখন একবার খুশির কারণ হয়। আর একবার যখন সে তার আল্লাহ সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রোজার বিনিময় লাভ করবে তখন খুশির কারণ হবে। (বুখারী শরীফ )। আল্লাহ্ এ মাসে বহু রোজাদার ব্যক্তিকে দোযখ থেকে মুক্তি দেন। আর এটা এ মাসের প্রতি রাতেই হয়ে থাকে। (তিরমিযী ও ইবনে মাজাহ)। রাসূলে পাক (সা:)- ইরশাদ করেন, কেউ যদি (রোজা রেখেও) মিথ্যা কথা বলে ও খারাপ কাজ পরিত্যাগ করে না, তবে তার শুধু পানাহার ত্যাগ করা (অর্থাৎ উপবাস ও তৃষ্ণার্ত থাকা) আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই। (বুখারী শরীফ )। এই মাসে যে ব্যক্তি আল্লাহর রহমত লাভের উদ্দেশে ১টি নফল আমল করল সে ওই ব্যক্তির সমান হলো, যে অন্য মাসে ১টি ফরজ আদায় করলো। আর যে ব্যক্তি এই মাসে ১টি ফরজ আদায় করলো সে ওই ব্যক্তির সমান হলো, যে অন্য মাসে ৭০টি ফরজ আদায় করলো। হযরত আবু হুরায়রা (রা:)-থেকে বর্ণিত, রাসূলে পাক (সা:)-ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ইচ্ছাকৃতভাবে শরীয়তের কোনো কারণ ছাড়া রমজানের একটি রোজাও ভাঙে সে রমজানের বাইরে সারাজীবন রোজা রাখলেও এর বদলা হবে না। (তিরমিযী, আবু দাউদ)।
হযরত আবু হুরায়রা (রা:)-থেকে বর্ণিত, রাসুলে পাক (সা:)-ইরশাদ করেছেন, অনেক রোজাদার ব্যক্তি এমন রয়েছে যাদের রোজার বিনিময়ে অনাহারে থাকা ব্যতিত আর কিছুই লাভ হয় না। আবার অনেক রাত জাগরণকারী এমন রয়েছে যাদের রাত জাগার কষ্ট ছাড়া আর কিছুই লাভ হয় না। (প্রার্থনা যদি এখলাস না হয়ে লোক দেখানোর উদ্দেশে হয় তাহলে এর বিনিময়ে কোনো পুণ্য পাওয়া যাবে না)। (ইবনে মাজাহ, নাসাঈ)। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলে পাক (সা:)-ইরশাদ করেছেন, রমজানের জন্য বেহেশত সাজানো হয় বছরের প্রথম থেকে পরবর্তী বছর পর্যন্ত। যখন রমজান মাসের প্রথম দিন উপস্থিত হয় বেহেশতের গাছের পাতা হতে আরশের নিচে বড় বড় চোখ বিশিষ্ট হুরদের প্রতি বিশেষ হাওয়া প্রবাহিত হয়। তখন তারা বলে, হে পালনকর্তা! আপনার বান্দাদের মধ্য হতে আমাদের জন্য এমন স্বামী নির্দিষ্ট করুন যাদের দেখে আমাদের চোখ জুড়াবে এবং আমাদের দেখে তাদের চোখ জুড়াবে। রাব্বে কারিম আত্মশুদ্ধির মহান মাসে ‘রহমত’ ‘মাগফেরাত’ ও ‘নাজাত’সহ আমাদের সবাইকে বেশি বেশি নেক আমল করার তৌফিক দান করুন। আমিন।
লেখক: শিক্ষার্থী, এম.সি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ-সিলেট।