বিএনপিতে চরম অস্থিরতা ॥ তৃণমূল নেতাকর্মীরা হতাশ, কোন জ্যেষ্ঠ নেতাই এ বিষয়ে পদক্ষেপ নিচ্ছেন না

32

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বিএনপিতে এখন চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। খালেদা জিয়া কারাবন্দী থাকায় কারো ওপর কারো নিয়ন্ত্রণ নেই। তাই যে যখন যা খুশি তাই করছে। এ নিয়ে দলীয় কর্মকান্ডে স্থবিরতা বিরাজ করছে। এমতাবস্থায় তৃণমূল নেতাকর্মীরা চরম হতাশ। তাদের হতাশা কাটাতে সিনিয়র নেতাদের পক্ষ থেকেও কোন পদক্ষেপ নেই। সূত্র জানায়, বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া কারাবন্দী হওয়ার আগে দলের সব কর্মকান্ড তাঁর নির্দেশেই পরিচালিত হতো। তবে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তিনি সিনিয়র নেতাদের মতামত নিতেন। গত বছর ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা মাথায় নিয়ে তিনি কারাবন্দী হন। তবে কারাবন্দী হওয়ার আগেই তিনি সিদ্ধান্ত দিয়ে যান তার অনুপস্থিতিতে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যরা মিলে যে সিদ্ধান্ত নেবেন তারেক রহমানের মতামত নিয়ে সে সিদ্ধান্ত যেন বাস্তবায়ন করা হয়। কিন্তু খালেদা জিয়া জেলে যাওয়ার পর স্থায়ী কমিটির সদস্যরা কোন সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করতে পারছেন না। তারেক রহমান লন্ডনে বসে যখন যে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিয়েছেন তাই দলে কার্যকর হয়েছে। এ নিয়ে সিনিয়র নেতাদের ক্ষোভ থাকলেও দলের পদ হারানোর ভয়ে সরাসরি প্রতিবাদ করছেন না।
খালেদা জিয়া কারাগারে ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে থাকায় মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকেও অন্য নেতারা মানতে চাচ্ছেন না। এ জন্য মির্জা ফখরুল যখন যা ভাল মনে করেন তখন তাই করার চেষ্টা করেন। আবার কখনও কখনও খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের নির্দেশ পেয়ে কোন কোন সিদ্ধান্ত নেন। অবশ্য মহাসচিবের সিদ্ধান্ত মানতে চান না দলের অন্য জ্যেষ্ঠ নেতারা। তাই মহাসচিবের সঙ্গে যোগাযোগ না করেই তারা একেক সময় একেক রকম কথা বলেন। এ ধরনের কথার কারণে দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা বিব্রত হন। আবার তারেক রহমান নিজে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দলের গুরুত্বপূর্ণ নেতা নন অথচ তার ঘনিষ্ঠ অনুসারীদের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের কথা জানিয়ে দেন। এ বিষয়টিকেও দলের নেতারা ভালভাবে নিতে পারেন না।
এদিকে দলের চেয়ারপার্সন ও ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনের অনুপস্থিতিতে দলীয় কোন বক্তব্য মিডিয়ার কাছে তুলে ধরার কথা মহাসচিবের কিংবা তিনি যাকে বলবেন তার। কিন্তু বিএনপির ক্ষেত্রে তেমনটি দেখা অধিকাংশ সময়ই যায় না। দেখা যায় একই বিষয়ে সকালে সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এবং বিকেলে সংবাদ সম্মেলন করেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল। কখনও কখনও দেখা যায় একেক সংবাদ সম্মেলনে একেক নেতা একেক রকম কথা বলেন। এর ফলে মিডিয়া ও দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের কাছে ভুল বার্তা পৌঁছায়। আবার দেখা যায় একেক অনুষ্ঠানে একেক নেতা একেক রকম কথা বলেন। কখনও কখনও এক নেতা অন্য নেতার সমালোচনা করেও বক্তব্য রাখেন। দলের ভেতর চরম অস্থিরতার কারণেই এমনটি হচ্ছে বলে অভিজ্ঞমহল মনে করছে।
২৫ এপ্রিল বিএনপি দলীয় এমপি জাহিদুর রহমান স্পীকারের কাছে শপথ নিলে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। আবার জাহিদুর রহমানের শপথের পর কারাবন্দী খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়ে মিডিয়ার কাছে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এ ছাড়া দলীয় সিদ্ধান্তেই তিনি শপথ নিয়েছেন বলেও মিডিয়াকে জানান। এ নিয়ে দলের নেতাকর্মীরা বিভ্রান্ত হন। কোনটি ঠিক আর কোনটি ঠিক নয় তা নিয়েও সাধারণ নেতাকর্মীরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েন।
২৯ এপ্রিল বিএনপির ৪ সাংসদ শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়ার কয়েক মিনিট আগে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেন দলীয় এমপিদের শপথ নিতে নাকি সরকার চাপ প্রয়োগ করছে। কিন্তু ৪ এমপির শপথের পর বিএনপির গুলশান কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ৪ এমপির শপথ দলীয় সিদ্ধান্তে হয়েছে এবং দলের পক্ষে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান তাদের শপথ নিয়ে সংসদে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন বলে তিনি জানান মির্জা ফখরুল। কিন্তু ফখরুলের সংবাদ সম্মেলনের সময় তার পাশে আর কোন নেতা ছিলেন না। এ ছাড়া আগে একজনসহ ৫ জন সংসদে যোগ দেয়ার আগে দলের কোন সিনিয়র নেতা ছাড়াই শেরেবাংলানগরে জিয়ার মাজার জিয়ারত করেন। এটিও দলের নেতাকর্মীদের চোখ এড়াতে পারেনি।
ওদিন মির্জা ফখরুলের সংবাদ সম্মেলনের পর বিএনপির বিভিন্ন নেতাকে বিচ্ছিন্নভাবে মির্জা ফখরুলের অবস্থানের বিপক্ষে কথা বলতে শোনা যায়। নেতাদের কেউ কেউ এমন প্রশ্নও তোলেন, ৪ এমপি যদি দলের সিদ্ধান্তে সংসদে গিয়ে থাকেন তাহলে মহাসচিব মির্জা ফখরুল গেলেন না কেন? তিনি কি তাহলে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে। অবশ্য পরদিন এক অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল নিজের সংসদে না যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, ৪ এমপির সংসদে যাওয়াও দলের সিদ্ধান্ত এবং তার সংসদে না যাওয়াও দলেরই সিদ্ধান্ত, তাই এ বিষয়ে ভুল বোঝাবুঝির কোন সুযোগ নেই। মির্জা ফখরুলের মুখে কথা শুনে খোদ বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যেই সমালোচনার ঝড় ওঠে। মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার সময়ও এ বিষয়ে বিএনপির অনেক নেতা অনেক রকম কথা বলেন।
সর্বশেষ শুক্রবার এক অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর রায় দলীয় ৫ এমপির সংসদে যোগদান এবং এক এমপির যোগ না দেয়া নিয়ে কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, বিএনপিতে এখন চিন্তা চেতনার সমন্বয়ের অভাব রয়েছে। মির্জা ফখরুলের সংসদে না যাওয়ার বিষয়ে কঠোর সমালোচনা করে গয়েশ্বর প্রশ্ন তোলেন এটি কি তার চমক? দলীয় ৬ জনের মধ্যে ৫ এমপি সংসদে গেলেও মির্জা ফখরুল কেন যাননি, আশা করি তার ব্যাখ্যা তিনি দেবেন। হয়তো পরবর্তী সময়ে আমরা জানতে পারব এটি তার একটি চমক। মির্জা ফখরুলের সংসদে না যাওয়ার ব্যাখ্যা চেয়ে গয়েশ্বর বলেন, প্রশ্ন উঠেছে বিএনপির সবাই সংসদে গেল মহাসচিব গেল না কেন? এটা আমার কাছেও খটকা লাগে। দলের সিদ্ধান্তে সবাই গেলে মহাসচিব যাবেন না কেন? আলাদা কারো ভাল থাকা বা আলাদা কারো হিরো হওয়ার সুযোগ নেই। গয়েশ্বরের এ কথার পর মির্জা ফখরুল ও তার অনুসারী নেতাদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সঞ্চার হয়। তবে মির্জা ফখরুলের অনুরোধে এ বিষয়ে কেউ গয়েশ্বর রায়ের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত প্রতিক্রিয়া দেননি।
এর আগে ঢাকা জেলা বিএনপির নবগঠিত কমিটি নিয়ে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর রায় ও বিএনপি চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা আমানউল্লাহ আমানের অনুসারীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়। নয়াপল্টনে ভাসানী ভবনে এ কমিটির পরিচিতি সভায় দুপক্ষের মধ্যে দলে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এ সংঘর্ষ ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে গয়েশ্বরপন্থীদের ভাসানী ভবনে কয়েক ঘণ্টা অবরুদ্ধ করে রাখে আমানপন্থী নেতাকর্মীরা। ২৭ মার্চ তারেক রহমানের নির্দেশে সালাউদ্দিনকে সভাপতি ও খন্দকার আবু আশফাককে সাধারণ সম্পাদক করে ঢাকা জেলার ২৬৬ সদস্যের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণার পর থেকে এখন পর্যন্ত দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধ চললেও নেতাদের মধ্যে কেউ কাউকে না মানায় মহাসচিব কিংবা অন্য কোন সিনিয়র নেতা দুপক্ষের বিরোধ নিরসনে পদক্ষেপ নিচ্ছেন না।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর দলীয় এক অনুষ্ঠানে নাম উচ্চারণ না করে পরোক্ষ ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মির্জা ফখরুলের সমালোচনা করেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। তারা অবিলম্বে জাতীয় কাউন্সিলের মাধ্যমে দলের নতুন নির্বাহী কমিটি গঠনের দাবি জানান। ত্যাগী ও যোগ্য নেতাদের নিয়ে কমিটি গঠন করে দলকে এগিয়ে নেয়ার তাগিদ দেন তারা। এ দাবির পক্ষে আরও ক’জন সিনিয়র নেতা বক্তব্য রাখলেও কিছুদিন পর লন্ডন থেকে তারেক রহমান তার অনুসারীদের মাধ্যমে জানিয়ে দেন আপাতত জাতীয় কাউন্সিল করা যাচ্ছে না। এক পর্যায়ে তিনি জাতীয় কাউন্সিল ছাড়াই বিভিন্ন স্তরের কমিটি পুনর্গঠনের কাজ শুরু করেন। আর কাউকে কিছু না বলে কমিটি পুনর্গঠন করতে গিয়ে হোঁচটও খান। কারণ যখনই কোন কমিটি ঘোষণা করা হয় পরস্পরবিরোধী কেন্দ্রীয় নেতাদের উস্কানিতে এ নিয়ে দ্বন্দ্বসংঘাত সৃষ্টি হয়। এর ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করে সৃষ্টি হয় হতাশা।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, একটি বড় রাজনৈতিক দলে নানা মত ও পথের লোকজন থাকে। আর এ কারণে কোন বিষয় নিয়ে একেকজন একেক রকম মতামত দিতেই পারেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একই দলে ভিন্ন মত থাকলেও এতে কোন সমস্যা হয় না। সকল মতামতকে বিশ্লেষণ করেই এক সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। আর নেতাদের মধ্যে ভিন্নমতের কারণে কারো কারো মধ্যে সাময়িক হতাশা দেখা দিলেও এক সময় সেই হতাশা কেটে যায়।