আল কুরআনে বর্ণিত বিশেষ দোয়া

110

॥ মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান ॥
(পূর্ব প্রকাশের পর)
আযাব থেকে নাজাত পাওয়ার দোয়া : কাফের সম্প্রদায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাহি ওয়াসাল্লামকে ঠাট্টা করে বলত, যারা অপনাকে প্রত্যাখ্যান করে তাদের উপর শাস্তি কখন আসবে? আল্লাহ তাকে বলেন, ওদের দুর্ব্যহার ও নির্যাতনে আপনি দুঃখিত ও মনক্ষুন্ন হবেন না; বরং তাদের দুর্ব্যবহারের জবাব সদ্ব্যবহার দ্বারা দেবেন। আর আপনি নিশ্চিত বিশ্বাস রাখবেন, যে শাস্তির ওয়াদা তাদেরকে দেওয়া হয়েছে তা সত্তর হোক বিলম্বে হোক অবশ্যই তাদের উপর আসবে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ পাকের নিকট তখন এ দু’আ করেনÑ‘হে আমার প্রতিপালক, যে শাস্তির বিষয়ে তাদেরকে প্রতিশ্র“তি প্রদান করা হচ্ছে তা যদি আপনি আমাকে দেখাতে চান, তবে হে আমার প্রতিপালক, আপনি আমাকে জালিম সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত করবেন না।’ ৯৩-৯৪ অর্থাৎ সে ভয়াবহ আযাব যদি আমার জীবদ্দশায় অবতীর্ণ হয়, তবে আমাকে সে আযাব থেকে নিরাপদ রাখবেন। যদিও আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অপরাধীদের শাস্তির অন্তর্ভুক্ত কখনো হবেন না, তৎসত্ত্বেও অতিশয় বিনয়াবনত হয়ে এরূপ প্রার্থনা করেছেন। এর দ্বারা সকল মুসলিমকে এ শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে যে, সকলকে সর্বদা আল্লাহ পাকের আযাবের ব্যাপারে এরূপ ভীত সন্ত্রস্ত থাকতে হবে। আল্লাহ তা’আলা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হুকুম দেন যে, তাদের প্রতি শাস্তি না আসা পর্যন্ত আপনি তাদের মন্দ আচরণের মুকাবিলা করুন উত্তম ব্যবহার দ্বারা। ‘হে আমার প্রতিপালক, আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করছি শয়তানের প্ররোচনা থেকে, হে আমার রব, আমি আপনার আশ্রয় প্রার্থনা করি আমার কোনো বিষয় শয়তানদের উপস্থিতি থেকে।-মুমিনুন ৯৭-৯৮
মুমিনের দোয়া : অপরাধীদের জাহান্নামে নিক্ষেপের পর, তারা অর্তস্বর উঠিয়ে শাস্তি থেকে বের হওয়ার প্রার্থনা করবে। আল্লাহ পাক বলবেন, আমার নেককার বান্দাগণকে নিয়ে তোমরা এতো ঠাট্টা-বিদ্রুপ করতে যে, তোমরা আমার কথা বিস্মৃত হয়েছিলে। ফলে তোমাদের জন্য জাহান্নামে অবধারিত হয়েছে। আর পুণ্যবান ও সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদেরকে আমি আজ পুরস্কৃত করেছি। পৃথিবীতে সৎকর্মপরায়ণ বান্দাদের প্রার্থনা ছিলÑ ‘হে আমাদের প্রতি পালক, আমরা ঈমান এনেছি। আপনি আমাদেরকে ক্ষমা করুন ও আমাদের প্রতি দয়া করুন। দয়ালুদের মধ্যে আপনি তো সর্বোৎকৃষ্ট দয়ালূ।’-মুমিনূন ১০৯, আল্লাহ পাক হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে উদ্দেশ করে বলেন, হে নবী, আপনি ও আপনার অনুসারীগণ সর্বদা এই দোয়া করুন ‘‘হে আমার প্রতিপালক, ক্ষমা করুন ও দয়া করুন, দয়ালুদের মধ্যে আপনিই তো শ্রেষ্ঠ দয়ালু।’’-মুমিনূন- ১১৮।
জাহান্নামের আজাব থেকে মুক্তির দোয়া : কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, দয়াময় ও পরম দয়ালু আল্লাহ তাআলার অনুগত বান্দা তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে। তাদেরকে অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করলে তর্কে অবতীর্ণ হয় না বরং শান্তি কামনা করে। যারা প্রতিপালকের উদ্দেশ্য সিজদাবনত হয়ে ও দন্ডায়মান হয়ে রাত্রি অতিবাহিত করে, যারা ব্যয় করার সময় অপচয় করে না, কার্পণ্যও করে না, কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে না, যারা ব্যভিচারে লিপ্ত হয় না, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয় না এবং অসার ক্রিয়াকলাপের সম্মুখীন হলে তা পরিহার করে চলে, যারা তাদের একমাত্র রবের নিকট এই প্রার্থনা করে ‘‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তি বিদূরিত করুন, জাহান্নামের শাস্তি তো নিশ্চিত বিনাশ।’’ ফুরকান-৬৫। ‘‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের জন্য এমন স্ত্রী ও সন্তান সন্তন দান করুন, যারা আমাদের জন্য নয়ন প্রীতিকর হবে এবং আমাদেরকে মুত্তাকীদের জন্য আদর্শস্বরূপ করুন।’’-ফুরকান-৭৪।
বাহনে আরোহণের দোয়া : কুরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে, পরাক্রমশীল ও সর্বজ্ঞ আল্লাহই আকশমন্ডলী ও পৃথিবীর স্রষ্টা, যিনি তোমাদের জন্য এমন নৌযান ও চতুস্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন, যার উপর তোমরা আরোহণ কর, যাতে তোমরা এগুলির পৃষ্ঠে স্থির হয়ে বসতে পার। তারপর তোমাদের জন্য এমন নৌযান ও চুতস্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছেন, যার উপর তোমরা আরোহণ কর, যাতে তোমরা এগুলির পৃষ্ঠে স্থির হয়ে বসতে পার। তারপর তোমাদের প্রতিপালকের অনুগ্রহ স্মরণ কর, যখন তোমরা এগুলোর উপর স্থির হয়ে বস, এবং তখন বল- ‘‘পবিত্র ও মহান তিনি, যিনি এগুলিকে আমাদের বশীভূত করে দিয়েছেন, যদিও আমরা এগুলি বশীভূত করতে সমর্থ ছিলাম না। আমরা আমাদের প্রতিপালকের নিকট অবশ্যই প্রত্যাবর্তন করব।” -যুখরুফ ১৩-১৪। আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সফরের উদ্দেশ্যে বাহনে পা রাখতেন, তিনবার আল্লাহু আকবার বলতেন অতঃপর পাঠ করতেন অতঃপর তিনবার আলহামদুলিল্লাহ ও তিনবার আল্লাহ আকবার পাঠ করতেন।
আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনার দোয়া : আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআলা পবিএ কুরআনে হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছেন, যদি কাফের সম্প্রদায় আপনার আহবানে সাড়া না দেয়, বরং আপনি যে পুর্ণাঙ্গ, পবিএ ও মহান শরীয়ত নিয়ে এসেছেন, তা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় তবে আপনি বলুন, মানুষের বয়স সাধারণত চল্লিশ বছরে উপনীত হওয়ার পরতার জ্ঞানে, বোধশক্তিতে ও আখলাক পরিপক্কতা সৃষ্টি হয়।
নেককাজের তাওফীক লাভের দোয়া : আল্লাহ পাকের ভাগ্যবান বান্দাগণ চল্লিশ বছরে পৌছার পর অর্থাৎ জ্ঞানে পক্কতা আসার পর আল্লাহ পাকের মহান দরবারে এই দোয়া করেন ‘হে আমার প্রতিপালক, আপনি আমাকে সামর্থ্য দিন, যাতে আমি আপনার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারি, আমার প্রতি ও আমার পিতামাতার প্রতি আপনি যে অনুগ্রহ করেছেন তার জন্য এবং যাতে আমি সৎকর্ম করতে পারি যা আপনি পছন্দ করেন। আমার জন্য আমার সন্তানদেরকে সৎকর্মপরায়ণ করুন। আমি আপনারই অভিমুখী হলাম এবং আপনারই নিকট আত্মসমর্পণ করলাম।’-আহকাফ ১৫ উল্লেখ যে, এ দু’আটি যে কোনো বয়সেই করা যায়।
ইসলাম ভ্রাতৃত্বের দোয়া : সাহাবা আজমাঈন আল্লাহ তাআলার মনোনীত জামাআত। তাঁরা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সরাসরি সান্নিধ্যপ্রাপ্ত পুণ্যবান দল। আল্লাহ তাআলা কুরআন মজীদে তাদের প্রশংসায় বলেছেন, তারা আল্লাহ পাকের প্রতি সন্তুষ্ট, আল্লাহ পাকও তাদের প্রতি সন্তুষ্ট। পরবর্তী যুগ থেকে কেয়ামত পর্যন্ত তারাই আল্লাহ পাকের সন্তোষভাজন, যারা সাহাবায়ে কেরামের পদাঙ্ক অনুসারী, যারা এ দু’আকরে- ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদেরকে এবং ঈমানে অগ্রনী আমাদের পূর্ববর্তী ভ্রাতাগণকে ক্ষমা করুন এবং সমকালীন মুমিনদের বিরুদ্ধে আমাদের অন্তরে হিংসা বিদ্বেষ রাখবেন না। হে আমাদের প্রতিপালক, আপনি তো দয়ার্দ্র, পরম দয়ালু।’- সুরা হাশর ১০, এ আয়াতে থেকে জানা গেল যে, সাহাবায়ে কেরামের মাহাত্য ও ভালোবাসা অন্তরে পোষণ করা এবং তাদের জন্য দোয়া করা ঈমানের দাবি। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, শিয়া মতবলম্বীদের মনে সাহাবায়ে কেরামের প্রতি কোনোরূপ আস্থা নেই, ভক্তি ভালোবাসার তো প্রশ্নই আসে না। তারা সাহাবায়ে কেরামের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে। অতএব শিয়ারা আল্লাহ পাকের সন্তোষজনক নয়, বরং বিরাগ ভাজন।
আল্লাহ সমর্পণ : আল্লাহ পাক হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলেছেন আপনি বলুনন, আমার সালাত, আমার ইবাদত, আমার জীবন ও আমার মরণ জগতের প্রতিপালক আল্লাহরই উদ্দেশ্য। তাঁর কোনো শরীক নেই। আমি একথারই আর্দিষ্ট হয়েছি এবং আত্মসমপর্ণকারীদের মধ্যে আমিই প্রথম।’ সূরা আনআম ১৬২-১৬৩ হাকীমূল উম্মত হযরত থানভী রহ বয়ানুল কুরআন বলেছেন, আয়াতের সারানির্যাস এই যে, যেমনিভাবে ইবাদত বন্দেগীর ক্ষেত্রে আল্লাহ পাকের কোনো শরীক নেই, তেমনি জগতের পরিচালনা ও নিয়ন্ত্রণেও আল্লাহ তাআলার কোনো অংশীদার নেই। এ-ই তাওহীদের সমষ্টি। এ কথাই ইসলামের শিক্ষা। আর হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরই আর্দিষ্ট হয়েছেন। এ কথা দ্বারা সুক্ষ্মভাবে সকলের প্রতি আহ্বান করা হযেছে যে, নবীর প্রতি যে বিষয়ের আদেশ করা হযেছে সে আদেশ সকলের পওতি রয়েছে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ দোয়া খানি পশু কুরবানী করার সময় পাঠ করেছেন-রাসূলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসসাল্লাম এ আয়াতখানি দোয়া হিসাবে তাহাজ্জুদ নামাজেও পাঠ করতেন। হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসল্লাম (রাতের নামাযে) সানাা পড়ে আল্লাহ আকবার বলে এ আয়াতখানি পাঠ করতেন।
নবীগণের দোয়া এর সংযুক্তি : হযরত রাসূল কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মনেপ্রাণে কামনা করে যে, কেয়ামতের দিন তাকে পরিপূর্ণ মাপে সওয়াব প্রদান করা হোক, সে যেন তার সকল বৈঠকের শেষে পাঠ করে। মুশরিকরা যা আরোপ করে তা থেকে পবিত্র ও মহান তোমার প্রতিপালক, যিনি সকল ক্ষমতার অধিকারী। শান্তি বর্ষিত হোক রাসূলদের প্রতি। সকল প্রশংসা জগৎসমূহের প্রতিপালক আল্লাহ জন্যে।- কুরতুবী ১৫/ ৯২। হযরত সাঈদ ইবনে আরকাম রা. এর সূত্রে বর্ণিত অপর এক হাদীসে রয়েছে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি প্রত্যেক নামাযের পর এ আযাতগুলি তিনবার পাঠ করবে সে পূণৃমাপে প্রতিদান পাবে।-ইবনে কাসীর ৭/৪৭
পবিত্র কুরআনের তাফসীরকারগণ এই আয়াতের বিশ্লেষণে একখানি হাদীস এনেছেন। হযরত তালহা বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন, তোমার যখন আমার পওতি সালাম পেশ করবে, তখন সকল রাসূলের প্রতি সালাম পাঠ করবে।-ইবনে কাসীর ৭/৪৭
আল্লাহ তাআলা হাশরের দিন হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তার অনুসারী মুমিন মুক্তাকীদের অপদস্থ করবেন না। তারা যখন পুলসিরাতের উপর দিয়ে চলতে থাকবে, তখন তাদের সঙ্গে আল্লাহ প্রদও নূর চলতে থাকবে। সেই মুহূর্তে হঠাৎ করে মুনাফিকদের নূর নির্বাপিত হয়ে যাবে। মুনাফিকদের অবস্থা দেখে মুমিনগণ ভীতু শঙ্কিত হয়ে আল্লাহ পাকের নিকট এ প্রার্থনা করবে- ‘রাব্বানা আতমিম লানা নূরানা ওয়াগফির লানা ইন্নাকা আলা কুল্লি শাইয়িং ক্বাদীর’ ‘হে আমাদের প্রতিপালক, আমাদের নূরকে পূর্ণতা দান করুন এবং আমাদের ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’-তাহরীম ৮। আল্লাহপাক আমাদের আল-কুরআনে বর্ণিত বিশ্বনবী (সা.)-এর উম্মতের জন্য যে দু’আ শিখিয়ে গেছেন, তা আমাদের আমল করার তৌফিক দান করুন-আমীন। (সমাপ্ত)