তারেক রহমানের সিদ্ধান্তে বিএনপির চার এমপি শপথ নিলেন ॥ মির্জা ফখরুলও স্পীকারের কাছে চিঠি দিয়েছেন

15

কাজিরবাজার ডেস্ক :
বহু নাটকীয়তার পর অবশেষে দলীয়ভাবে একাদশ সংসদে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। দলীয় সিদ্ধান্তে দলের মহাসচিব বাদে বাকি চারজনও সোমবার সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছে। এ নিয়ে একমাত্র বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ছাড়া বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সকল সংসদ সদস্য শপথ নিলেন। শপথ গ্রহণ শেষে বিএনপি এমপিরা বলেন, লন্ডনে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান ও দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শপথ নিয়েছি। সংসদে গিয়ে জনগণের অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে চাই। পরে সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল বলেন, দলীয় এবং তারেক রহমানের সিদ্ধান্তেই সংসদে যোগ দিচ্ছেন এমপিরা।
জানা গেছে, বিএনপি মহাসচিব শপথ না নিলেও অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে শপথ অনুষ্ঠান পিছিয়ে দিতে স্পীকারেরর নিকট চিঠি দিয়েছেন। ফখরুল এ বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, সময় হলে দেখতে পাবে। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সংসদ সচিবালয় থেকে এই ধরনের চিঠি পাওয়ার কোন খবর জানা যায়নি।
এদিকে সোমবার সন্ধ্যায় বিএনপি সদস্যদের শপথ গ্রহণ নিয়ে এক জরুরী সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, গণতন্ত্র এবং দলীয় প্রধানের মুক্তির স্বার্থে সংসদে কথা বলতে বিএনপি দলীয়ভাবে এই সংসদে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একই সঙ্গে তিনি একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে পুনরায় নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এই সংসদ ভোটাধিকার বঞ্চিত। ব্যাপক কারচুপির এই নির্বাচন বিএনপি অনেক আগেই প্রত্যাখ্যান করেছে। ফলে বিএনপির যারা নির্বাচিত হয়েছেন তাদের শপথ গ্রহণ না করার জন্য আগেই আহ্বান জানানো হয়েছে।
তিনি বলেন, বিএনপি একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। গণতান্ত্রিভাবে পরিচালিত একটি নির্বাচনের মাধ্যমেই সরকার গঠনকে তারা বিশ্বাস করে। কিন্তু এই সরকার নির্বাচনকে ক্ষমতায় থাকার হাতিয়ারে পরিণত করেছে। ব্যাপক কারচুপির মাধমে নির্বাচন পরিচালনা করেই তারা সরকার গঠন করেছে। ফলে বিএনপির এখন একটি নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি করছে। তিনি বলেন, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সিদ্ধান্তেই নির্বাচিতদের শপথ এবং সংসদের যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
গুলশানে বিএনপি চেয়ারপার্সনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে জরুরী সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরও জানান, দলীয় প্রধানের মুক্তি এবং গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবির পক্ষে কথা বলতেই এই চার নেতা সংসদে গেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের সিদ্ধান্তেই চার নেতা সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ নিয়েছেন।
তবে দলের ৫ জন শপথ নিলেও এখনও দলীয় এই মহাসচিব শপথ নেননি। সোমবার ছিল সংসদ সদস্য হিসেবে শপথ গ্রহণের শেষদিন। আইনে স্পীকারের কাছে চিঠি দিয়ে শপথের সময় আরও বাড়িয়ে নেয়ার বিধান রয়েছে। আইন অনুযায়ী সংসদের প্রথম বৈঠক থেকে পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যে শপথ নিতে হবে। সংবাদ সম্মেলনে নিজের গ্রহণ সম্পর্কে মির্জা ফখরুল সাংবাদিকদের বলেন, সময় হলে দেখতে পাবেন। আপনার পক্ষ থেকে সময় চেয়ে স্পীকারের কাছে আবেদন করেছেন কিনা? প্রশ্নের জবাবে ফখরুল বলেন, সেটাও সময় হলে জানতে পারবেন।
সোমবার সকাল থেকেই বিএনপির সংসদ সদস্যদের শপথ অনুষ্ঠানের জন্য প্রস্তুত ছিল সংসদ সচিবালয়। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে একে একে সংসদ ভবনে প্রবেশ করেন বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে বিজয়ী ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উকিল আবদুস সাত্তার ভূইয়া, বগুড়া-৪ আসনের মোঃ মোশাররফ হোসেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ আসনের আমিনুল হক এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ আসনের মোঃ হারুনুর রশীদ। সন্ধ্যা পৌনে ৬টায় স্পীকারের জাতীয় সংসদ ভবন কার্যালয়ে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী তাদের শপথবাক্য পাঠ করান। এর আগে গত ২৫ এপ্রিল বিএনপির আরেক এমপি ঠাকুরগাঁও-৩ আসনের জাহিদুর রহমান শপথ নেন। গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। নির্বাচনে মাত্র আটটি আসনে জিততে পারে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। এরপর নির্বাচনে অনিয়ম ও কারচুপির অভিযোগ এনে ওই আটজন শপথ অনুষ্ঠান বর্জন করেন। এরমধ্যে ৬ জন বিএনপির ও দুইজন গণফোরামের। নির্বাচিতদের মধ্যে একমাত্র বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ গ্রহণে বাকি থাকলেন। এর আগে গণফোরাম মনোনীত দুই জনের মধ্যে মৌলভীবাজার-২ আসনে বিএনপির ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচিত ডাকসুর সাবেক ভিপি সুলতান মোহাম্মদ মনসুর গত ৭ মার্চ শপথ নিয়ে সংসদে যোগ দেন। আর গত ২ এপ্রিল সিলেট-২ আসন থেকে গণফোরামের প্রতীক উদীয়মান সূর্য নিয়ে বিজয়ী মোকাব্বির খানও শপথ গ্রহণ করেন। শপথ অনুষ্ঠান থেকে বিএনপির ৫ সংসদ সদস্য দলের প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের মাজারে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে সংসদে ফিরে অধিবেশনে যোগদান করেন।
সারাদেশে বিএনপির নির্বাচিত এমপিদের শপথ গ্রহণের বিষয়টি পরিণত হয়েছিল টক অব দ্য কান্ট্রিতে। মাত্র একদিন আগে রবিবার বিএনপির শীর্ষ নেতারা নির্বাচিত চার এমপিকে শপথ না নেয়ার জন্য বলেছিলেন। কিন্তু নির্বাচনে ভরাডুবির পর বিএনপিতে চেন অব কমান্ড যে সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়েছে, দলটির রাজনৈতিক অস্তিত্ব যে ক্রমেই খাদের কিনারায় যাচ্ছে; বিএনপির একজন বাদে সব এমপির শপথ গ্রহণের মাধ্যমে আবারও জাতির সামনে তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
শপথ গ্রহণ শেষে স্পীকারের কার্যালয়ে পারস্পরিক আলোচনায় শপথ নেয়া বিএনপি এমপিরা সংসদে আলোচনার জন্য পর্যাপ্ত সময় দাবি করেন। বিএনপির এমপি আমিনুল ইসলাম বলেন, সংসদে আমরা সংখ্যায় কম হলেও সারাদেশে আমাদের বিপুল জনসমর্থন রয়েছে। তাই আমাদের সময় বেশি দিতে হবে। সময় দেয়ার বিষয়ে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী তাদের আশ^স্ত করে সংসদ অধিবেশনে যোগদানের আহ্বান জানান।
শপথ গ্রহণের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় হারুনুর রশীদ বলেন, এই সংসদ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছে না। জনগণের ভোটে এই সরকার নির্বাচিত হয়নি। নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক আছে। এই নির্বাচন বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্ট প্রত্যাখ্যান করেছে। যে কারণে আমরা দলীয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিলাম। সর্বশেষ দলীয় সিদ্ধান্ত, বিশেষ করে আমাদের পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের নির্দেশক্রমে আজকে শপথ গ্রহণ করেছি। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে মানুষ যে ফলাফল প্রত্যাশা করেছিল, সেই ফল পায়নি। তারপরও আমরা শপথ নিয়েছি। আগে আমাদের জাহিদুর রহমান শপথ নিয়েছেন। এ নিয়ে আমাদের দলের ৬ জনের মধ্যে ৫ জন শপথ নিলাম। দেশে যে সঙ্কট তৈরি হয়েছে, সেই বিষয়ে কথা বলার জন্য তারা সংসদে এসেছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবি করে তিনি বলেন, তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী, যিনি বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য আপোসহীনভাবে লড়াই করেছেন। সেই দেশনেত্রীকে আজকে কারাগারে বন্দী রাখা হয়েছে। নিম্ন আদালত থেকে ফরমায়েশী রায়ের মাধ্যমে সরকারের হস্তক্ষেপে সাজা দেয়া হয়েছে। তাকে জামিন দেয়া হচ্ছে না। অথচ দেশে ফাঁসির আসামি, মাদক মামলার আসামিরা জামিনে মুক্তি পায়। দ্রুত তাকে জামিনে মুক্তি ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করার দাবি জানান তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিএনপির মহাসচিব কেন শপথ নিলেন না, সেটা আমার বলার বিষয় নয়। সেটা মহাসচিবকেই জিজ্ঞেস করুন। এর আগে জাহিদুর রহমান শপথ গ্রহণের পর দল থেকে তাকে বহিষ্কার সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, উনি (জাহিদুর রহমান) আজ আমাদের পার্টির চেয়ারপার্সনের সঙ্গে কথা বলেছেন। উনি ভুল স্বীকার করেছেন, উনি বলেছেন, আমার আরও অপেক্ষা করার দরকার ছিল, আপনার (তারেক রহমানের) সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকার দরকার ছিল। হয়ত উনি দলের কাছে লিখিত ক্ষমা চাইলে দল বিবেচনা করতে পারে।
শপথ গ্রহণের মাধ্যমে সরকারের বৈধতা দেয়া হচ্ছে কিনা জানতে চাইলে হারুনুর রশীদ বলেন, এই সংসদকে বৈধতাদানের জন্য আমরা সংসদে আসিনি। দেশে আইনের শাসন নেই। অরাজকতা চলছে। এ কথাগুলো বলতে, বিশেষ করে ১৭ কোটি মানুষের কথা বলতে এসেছি।
একই প্রতিক্রিয়া জানান এ নিয়ে পাঁচবার নির্বাচিত প্রবীণ সংসদ সদস্য উকিল আবদুস সাত্তার। তিনি বলেন, দলীয় মনোনয়নে নির্বাচিত হয়েছি। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমানের নির্দেশে শপথ নিয়েছি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ না নেয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে সোমবার আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেন, দুটি কারণে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ নিচ্ছেন না। এর একটি হচ্ছে যেই দলে কোন গণতন্ত্র নেই, লন্ডন থেকে পরিচালিত হয় সেই দলের বিরুদ্ধে গিয়ে শপথ নিলে পদ হারাবেন। মূলত পদ হারানোর ভয়েই মির্জা ফখরুল ইসলাম শপথ নেবেন না বলে ঘোষণা দিয়েছেন। আরেকটি কারণ হলো, বগুড়া থেকে নির্বাচিত হয়েছেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। উনার নিজ এলাকার ভোটারদের প্রতি দায়বদ্ধ থাকলেও বগুড়ার ভোটার, এমনকি জনগণের প্রতি উনার কোন দায়বদ্ধতা নেই। তাই তিনি শপথ নিচ্ছেন না।
উল্লেখ্য, কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী নির্বাচনে বিজয়ী কোন সংসদ সদস্য ওই সংসদের প্রথম অধিবেশন শুরুর ৯০ দিনের মধ্যে শপথ না নিলে তার আসন শূন্য হবে। একাদশ জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন গত ৩০ জানুয়ারি শুরু হয়। সেই হিসেবে শপথ না নিলে ৩০ এপ্রিলের পর তাদের আসন শূন্য হবে।