জাতীয় আইনী সহায়তা দিবসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী ॥ খুন ধর্ষণ অগ্নিসন্ত্রাস সহ গুরুতর অপরাধের দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই

66
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

কাজিরবাজার ডেস্ক :
আদালতে মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমানোর পাশাপাশি খুন-ধর্ষণ-অগ্নিসন্ত্রাসসহ গুরুতর ফৌজদারি অপরাধগুলোর দ্রুত ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সমাজের সবার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিতে কাজ করার নির্দেশনা দিয়ে সরকারের আইনী সহায়তাকে তৃণমূলে ছড়িয়ে দেয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা চাই প্রতিটি মানুষ ন্যায়বিচার পাক। সেই ব্যবস্থাটা যাতে নেয়া হয়, সেটা আপনারা নেবেন। আমরা চাই না আমরা যেমন বিচার না পেয়ে কেঁদেছি, আর কাউকে যেন এভাবে না কাঁদতে হয়। সকলে যেন ন্যায়বিচার পায়।
মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমাতে সংশ্লিষ্টদের পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমাতে হবে। কারাগারে এখনও অনেকেই আছে, কি কারণে যে জেলে সে জানে না। তাদের দোষটা কি তাও তারা জানে না। কি করে আইনগত সহায়তা পাবে সেটাও জানে না। এই বিষয়টি দেখার জন্য আমি ইতোমধ্যে ব্যবস্থা নিয়েছি। আইন মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে আরও যথাযথ পদক্ষেপ নেবে। গুরুতর ফৌজদারি অপরাধগুলোতে দ্রুত কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, খুন, অগ্নিসন্ত্রাস, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা, ধর্ষণ, নানা ধরনের সামাজিক অনাচার চলছে। এগুলোর বিচার যেন খুব দ্রুত হয় এবং কঠোর শাস্তি হয়, যাতে এর হাত থেকে দেশ জাতি রক্ষা পায়।
রবিবার রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে ‘জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস-২০১৯’- এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী। আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রী আনিসুল হকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু সালেহ শেখ মোঃ জহিরুল হক, জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার পরিচালক আমিনুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার সহযোগিতায় উপকারভোগী মানিকগঞ্জ জেলার রিনা বেগম এবং কুমিল্লার নুরুল ইসলাম নিজেদের অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন। এছাড়াও তিনটি ক্যাটাগরিতে পুরস্কার প্রদান করা হয়। বেসরকারীভাবে মানবাধিকার সংগঠন লিগ্যাল এসিস্টেন্স টু হেল্পলেস প্রিজনার্স এ্যান্ড পার্সনস (এলএএইচপি)’র চেয়ারম্যান তৌফিকা করিম, লিগ্যাল এইডের সেরা প্যানেল আইনজীবী হিসেবে এডভোকেট ফাতেমা বেগম এবং সেরা লিগ্যাল অফিস হিসেবে বরিশাল অফিসকে পুরস্কৃত করা হয়। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে সম্মাননা ক্রেস্ট তুলে দেন আইনমন্ত্রী এ্যাডভোকেট আনিসুল হক।
মায়েরা যেন বাবার সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত না হয়, সম্পত্তি আইনের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছেলে হোক মেয়ে হোক দু’টি সন্তানই যথেষ্ট, এটাই আমাদের স্লোগান। কিন্তু যে মা-বাবার দু’টি সন্তানই মেয়ে, তাদের সন্তান বাবার সম্পত্তির অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিষয়টি আমাদের ভেবে দেখতে হবে। আমি শরিয়া আইনে হাত দিতে বলব না, কিন্তু সম্পত্তি আইনে এর একটি ব্যবস্থা করে দেয়া উচিত। অন্তত পিতার মৃত্যুর পর মেয়েরা যেন সম্পত্তির অধিকার পায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন মেয়াদে অসহায়, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত বিচারপ্রার্থী জনগণের ন্যায়বিচার পাওয়ার লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, দেশে ও সমাজে সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধই সবচেয়ে বেশি। এ বিরোধ কমিয়ে আনতে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন যথাযথ আইন ও তার সঠিক প্রয়োগ। সম্পত্তি নিয়ে পারিবারিক কোন্দল, খুন-খারাবি বা সম্পত্তি থেকে মেয়েদের বঞ্চিত করার দিকগুলো তুলে ধরে তিনি বলেন, যারা অসহায় দরিদ্র তাদের পাশাপাশি অনেক অর্থশালী-সম্পদশালী পরিবারেও সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ প্রকট। বিশেষ করে মা-বাবা মারা যাওয়ার পর অনেক ক্ষেত্রেই মেয়েরা সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়।
ইসলাম ধর্মেই একমাত্র মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার দেয়া আছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধর্মে থাকার পরও অনেক সময় মেয়েরা বঞ্চিত হয়। বাবার সম্পত্তিতে তারা ভাগ পায় না, ভাইয়েরা দিতে চায় না। নিজের কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৯৬ সালে যখন সরকার গঠন করি, তখন বস্তি এলাকায় এবং রাস্তায় রাস্তায় অনেক ছোট ছোট শিশু ঘুরে বেড়াত। আমি তাদের নিয়ে এসে কথা বলি। জানতে চাই, কেন তারা বস্তিতে থাকে? কী কারণে এসেছে?
তিনি বলেন, তখন জানতে পারি সমাজের অন্ধকার দিকের কথা। সেখানে দেখা যায়, ভাই ভাইকে খুন করেছে বা আত্মীয় স্বজন খুন করে সম্পত্তি দখল করে নিয়ে ভাইয়ের ছেলে-মেয়ে স্ত্রীসহ তাদের বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। তাদের স্থান হয়েছে বস্তিতে। ছেলে-মেয়েরা হয়ে গেছে টোকাই। আর নারীর ভাগ্য কী হতে পারে, বুঝতেই পারেন। হয় সে নিজে বাড়ি বাড়ি কাজ করে খাচ্ছে, অথবা পতিতালয়ে স্থান পাচ্ছে। এই যে সামাজিক অবিচারটা হয়, এগুলোর দিকে আমাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি দিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, অনেক অর্থশালী সম্পদশালীদেরও আমি দেখেছি, ভাই মারা গেছে, ভাইয়ের ছেলে নেই, মেয়ে আছে। কিন্তু তাদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। শরিয়া আইনের অজুহাত দিয়ে মা ও মেয়েকে বঞ্চিত করে বাবার সম্পত্তি থেকে মেয়েকে কিংবা স্বামীর সম্পত্তি থেকে স্ত্রীকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত করে সম্পদ কেড়ে নেয়া হচ্ছে। এর কোন সুরাহা করা যায় কি না, তা দেখার জন্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিচারক, আইনজীবী ও আইনজ্ঞদের প্রতি অনুরোধ জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, মানুষের যত বেশি ধন-সম্পদ বাড়ছে, তত লোভও বেড়েছে। এ কারণে মেয়েরা বঞ্চিত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। আমরা শ্লোগান তুলি ছেলে হোক মেয়ে হোক দু’টি সন্তানই যথেষ্ট। তবে দু’টি সন্তানই যদি মেয়ে হয়, তাহলে ওই বাবার সম্পত্তির ভাগ পাওয়ার ক্ষেত্রে মেয়েরা বঞ্চিত হবে। বিষয়টির সুরাহা চেয়ে তিনি বলেন, ‘আমি শরিয়া আইনে হাত দিতে বলব না, কিন্তু সম্পত্তি আইনে এর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সন্তান ছেলেই হোক মেয়েই হোক, অন্তত তার ভাগটা সে পাবে। আমি জানি এটা বলতে গেলে অনেক হুজুর লাফ দিয়ে উঠতে পারেন? কিন্তু তারপরও এই সমস্যাটা সমাধান করা দরকার। আমি আমাদের অনেক ধর্মীয় নেতার সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা করেছি। তাদেরও অনেকের শুধু মেয়েই রয়েছে। তারাও কিন্তু বলেছেন, মেয়েদের অধিকারও সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
মামলার দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে দ্রুততম সময়ে রায় প্রদানের উপায় বের করার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব যেমন বিচারকদের, তেমনি আইন পেশার সঙ্গে জড়িতদেরও। অনেক সংগ্রাম এবং ত্যাগের বিনিময়ে আমরা দেশে গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠা করেছি। গণতন্ত্র না থাকলে আইনের শাসন যেমন সুপ্রতিষ্ঠিত হয় না, তেমনি আইনের শাসন না থাকলে গণতন্ত্র টেকসই হয় না। আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার বিকল্প নেই।
তিনি বলেন, দেশে এখন জমিজমা সংক্রান্ত মামলার সংখ্যাই বেশি। এগুলো আপোস মীমাংসার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা গেলে মামলা জট কমবে। গুরুতর ফৌজদারি অপরাধ যেমন খুন, ধর্ষণ ইত্যাদি আদালতের ওপর ছেড়ে দিতে হবে এমন নির্দেশনা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এতে অপরাধীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা যাবে। তিনি বলেন, আমরা সর্বস্তরে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে একটি উদার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাই। এমন একটি সমাজ বিনির্মাণ করতে চাই যেখানে ধনী দরিদ্রের কোন বৈষম্য থাকবে না এবং জনগণ মৌলিক অধিকারসমূহ ভোগ করে নিজেরা নিজেদের ভাগ্যোন্নয়ন করতে পারবেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমরা প্রত্যেক জেলায় স্থায়ী লিগ্যাল এইড অফিস স্থাপন করেছি। ৬৪ জেলা লিগ্যাল এইড অফিসারের পদ সৃষ্টি করা হয়েছে। বিজ্ঞ বিচারকগণকে এসব পদে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। মামলার পূর্বে সংশ্লিষ্ট পক্ষদের বিরোধ আপোস-মীমাংসার মাধ্যমে দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য প্রি-কেইস মেডিয়েশন বা মামলা পূর্ব বিরোধ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা চালু করেছি। বিগত ১০ বছরে ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৭৯০ জনকে সরকারী খরচে আইনগত সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। একই সময়ে এ কার্যক্রমে আওতায় মোট ১ লাখ ৬৮৮ মামলা নিষ্পত্তি করা হয়েছে বলেও জানান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, বর্তমানে আদালতগুলোতে প্রতিদিন অসংখ্য মামলা দায়ের হচ্ছে, মামলার সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরদিকে আপোসযোগ্য মামলাগুলোও মধ্যস্থতার অভাবে দীর্ঘ সময়ের পরে নিষ্পত্তি হচ্ছে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে সরকার বিকল্প পদ্ধতির মাধ্যমে মামলা ও বিরোধ নিষ্পত্তিকে উৎসাহিত করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিচারিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিরোধ নিষ্পত্তি ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। আলাপ-আলোচনা বা সমঝোতার মাধ্যমে আপোসযোগ্য মামলাগুলো নিষ্পত্তি করা গেলে অতিরিক্ত অর্থ ও সময় ব্যয় ছাড়াই মানুষ প্রতিকার পেতে পারেন। আমরা ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত আইনসমূহ সংশোধনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, লিগ্যাল এইড অফিস মাত্র চার বছরে প্রি-কেইস ও পোস্ট কেইস মিলিয়ে মোট ১৭ হাজার ৯২৯ এডিআর আপোস মধ্যস্থতার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর ফলে ১৬ হাজার ৫১৩ বিচারপ্রার্থী শান্তিপূর্ণভাবে আপোস-মীমাংসার সুফল ভোগ করেছেন। লিগ্যাল এইড অফিসারের মধ্যস্থতায় আপোস-মীমাংসার মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকে সর্বমোট ১ কোটি ৪৩ লাখ ২৪ হাজার ৩২৬ টাকা আদায় করে দেয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, গ্রামের অসহায় অনেক মানুষই গ্রাম্য সালিশ বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হন। কিন্তু সালিশকারী বা মীমাংসাকারীদের অনেকেরই আইন-কানুন সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় প্রায়শই নানা জটিলতা দেখা দেয়। তাই ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে এ সেবা বাস্তবায়নের উদ্দেশে সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে। এর ফলে বিচারপ্রার্থী জনগণ মামলাজটের কবল থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাবে। তিনি বলেন, আইনের প্রতি আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে। বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা মামলার বিচার সাধারণ আদালতে হয়েছে। কিন্তু আমি বলেছি, সাধারণ আদালতে বিচার হবে এবং আদালত যে রায় দেবে, আমরা তা মেনে নেব। আমরা আদালতের রায় মেনে নিয়েছি।