মোঃ দিলশাদ মিয়া
পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষের প্রথম মাসের প্রথম দিন। বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বাহক পহেলা বৈশাখ বাঙালি সর্বজনিন, সর্ববৃহৎ এবং অসাম্প্রদায়িক উৎসবের দিন। অতীতের ভুলত্র“টি ও ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে নতুন করে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় আনন্দঘন পরিবেশে উদ্যাপিত হয় নববর্ষের প্রথম দিন। দিনটি জাতীয়ভাবে পালিত হয় এবং ঐদিন সকল সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকে।
শুভ নববর্ষ একটি ‘ট্রাডিশন’- একটি ঐতিহ্য। স্বাতন্ত্র্যবোধ, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, ভাষার আবহমানতা বৈশাখী নববর্ষের ভিন্নতর বৈশিষ্ট্য। বাংলাদেশের নানাদিকের সাংস্কৃতিক স্রোতধারা বৈশাখী ঐতিহ্যের বিনির্মাণকারী। নানা ঐতিহ্য- বৈশিষ্ট্যের শুভ নববর্ষের প্রবর্তন বাংলা সনের সূচনাময় থেকে। অর্থাৎ ২ রবিউস সানী ৯৬৩ হিজরি, ১৪ এপ্রিল ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের সময় থেকে বাংলা নববর্ষের যাত্রা শুরু হয়। প্রবর্তনের সময় থেকেই শুভ নববর্ষের ঐতিহ্য আমাদের সমাজে ও রাষ্ট্রে সতত প্রবহমান। বাঙালির লোক জীবনের সাংস্কৃতিক ধারাকে জোরদারের একটি নতুন আবহ সৃষ্টিতে প্রতিবছরই ফিরে আসে বৈশাখী শুভ নববর্ষ।
বাংলা একাডেমি বিশিষ্ট ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে ১৯৬৩ সালে বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি গঠন করে। পরবর্তীতে ‘শহীদুল্লাহ কমিটি’ নামে আখ্যায়িত হয় এ কমিটি। এ কমিটি অন্যান্য সুপারিশের পাশাপাশি ১৪ এপ্রিলকে পহেলা বৈশাখ নির্ধারণের সুপারিশ করে। পরবর্তীতে ‘বাংলা বর্ষপঞ্জী সংস্কার কমিটি’ নামে আরেকটি কমিটির সুপারিশের আলোকে বাংলা একাডেমির (বাংলা ২৮.০৫.১৪০১) নামে ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৯৪ অনুষ্ঠিত সভায় ১৪ এপ্রিলকে পহেলা বৈশাখ ধার্য করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এরপর ২৯ শ্রাবণ ১৪০২ (১৩ আগষ্ট ১৯৯৫) এ দু’সভার মাধ্যমে গঠিত টাস্কফোর্স ১৪০২ সালের ১ বৈশাখ থেকে অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল ১৯৯৫ থেকে এটি কার্যকরের সিদ্ধান্ত নেয়। এভাবেই পহেলা বৈশাখরূপে (শুভ নববর্ষ) প্রতিবছরই হাজির হয় ১৪ এপ্রিল।
১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলার সাধারণ নিবার্চনে মুসলিম লীগ উৎখাত হয়ে যাওয়ার পর যুক্তফ্রন্ট সরকার ও তার মূখ্যমন্ত্রী এ কে ফজলুল হক বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করেন এবং সে বছর বিপুল উৎসাহে বাঙালি তার নববর্ষ উৎসব উদযাপন করে। এরপর ১৯৫৮ সালে আইয়ুবের সামরিক শাসন জারি হওয়ায় মুক্তবুদ্ধির চর্চা, গণমুখী সংস্কৃতির চর্চা একেবারেই মুখ থুবড়ে পড়ে। এরপর ১৯৬৪ সালে বাঙালিত্বের চেতনার তীব্র চাপে প্রাদেশিক সরকার বাংলা নববর্ষে ছুটি ঘোষণা করে। এরপর বাংলা নববর্ষকে জাতীয় উৎসবে রূপ দিয়ে রমনার বটমূলে অনুষ্ঠানের আয়োজন শুরু করে ১৯৬৮ সালে। সেই থেকে বাংলা নববর্ষ সকল বাঙালির জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে।
গ্রামীণ অঞ্চলের সীমানা পেরিয়ে শহরাঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়েছে নববর্ষ উৎসব। নানা কর্মসূচিতে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান এবং চারুকলা ইনষ্টিটিউটের আয়োজন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সংস্কৃতি বিকাশী নববর্ষ- উৎসব এর নানন্দিক আয়োজনের ফলে বাংলা সংস্কৃতির বিস্তার ত্বরান্বিত হয়। যেমন- বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, নজরুল ইন্সটিটিউট, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, নজরুল একাডেমি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরসহ নানা সাংস্কৃতিক সংগঠন। মূলত বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও বাংলা নববর্ষ নিবিড় ঘনিষ্ঠতায় আবদ্ধ। তাই বাংলা সংস্কৃতি ও কৃষ্টি বিকাশে শুভ নববর্ষের ভূমিকা সর্বাধিক। কেননা বাঙালির কৃষ্টিগত স্বাতন্ত্র্য বিকাশে যেসব উৎস ও উপকরণ মৌল ভূমিকা পালন করেছে বাংলা নববর্ষ তার অন্যতম।
নববর্ষে বাংলাদেশে যে সকল উৎসব পালন করা হয় হালখাতা: নতুন বাংলা বছরের হিসাব পাকাপাকিভাবে টুকে রাখার জন্য ব্যবসায়ীদের নতুন খাতা খোলার আনুষ্ঠানিক উদ্যোগ ‘হালখাতা’। এতে তাদের কাজ-কারবারের লেনদেন, বাকি-বকেয়া, উসুল আদায় সবকিছুর হিসাব-নিকাশ লিখে রাখার ব্যবস্থা করা হয়।
পুণ্যাহ : সাধারণত জমিদারি আমলেই অনুষ্ঠিত হতো পুণ্যাহ অনুষ্ঠান। এটি ছিল খাজনা আদায়ের একটি আনুষ্ঠানিক প্রীতিপূর্ণ অনুষ্ঠান। মূলত এটি ছিল কৃষিভিত্তিক অনুষ্ঠান।
গম্ভীরা: প্রচলিত সামাজিক সমস্যা নিয়ে তৈরি লোকগীতি ও লোকনৃত্যের আঞ্চলিক অনুষ্ঠান গন্তীরা। এটি ভারতের মালদহ এবং বাংলাদেশের রাজশাহী অঞ্চলের আঞ্চলিক অনুষ্ঠান।
বলী খেলা: বলী খেলা কেবল চট্টগ্রামেই সীমাবদ্ধ। পুরো বৈশাখব্যাপী এ খেলার আয়োজন করা হয়। এ খেলায় কুস্তিগীররা তাদের শারীরিক শক্তির পরিচয় দিয়ে থাকে। বিজয়ী কুস্তিগীরকে নগদ অর্থ ও কাপড় পুরস্কার দেয়া হয়।
আমানি: বাংলা নববর্ষের খুবই প্রচলিত অনুষ্ঠান। চৈত্র মাসের শেষ দিন সন্ধ্যায় গৃহিনীরা এক হাঁড়ি পানিতে অল্প পরিমাণ চাল ভিজিয়ে তার মধ্যে একটি কচি আমের ডাল বসিয়ে রাখেন। পহেলা বৈশাখে সূর্যোদয়ের আগে বাড়ির সবাই এ ভিজা চাল খেয়ে থাকে। আর হাঁড়িতে ডুবানো আমের শাখা দিয়ে গৃহিনীরা সকলের গায়ে পানি ছিটিয়ে দেন। বাঙালির বর্ষবরণের আনন্দ আয়োজনে মিশে আছে মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে প্রতিবছরই পহেলা বৈশাখে এ মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। এ শোভাযাত্রায় চারুকলার শিক্ষক শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। এ শোভাযাত্রায় বিভিন্ন ধরণের প্রতীকী শিল্পকর্ম বহন করা হয়। আরও থাকে বাংলা সংস্কৃতির পরিচয়বাহী নানা প্রতীকী উপকরণ, রং বেরংয়ের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিলিপি। ১৯৮৯ সালে প্রথম শোভাযাত্রায় ছিল পাপেট, ঘোড়া ও হাতি। ১৯৯০ এর আনন্দ শোভাযাত্রায় নানা ধরণের শিল্পকর্মের প্রতিকৃতি স্থান পায়। এ শোভাযাত্রার ইতিহাস খুব একটা পুরানো নয়। ১৯৮৬ সালে যশোরে চারুপীঠ নামের একটি সংগঠন প্রথমবারের মতো বর্ষবরণ করতে আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা ইন্সটিটিউটের উদ্যোগে ১৯৮৯ সালে প্রথম আনন্দ শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়। ১৯৯৫ সালের পর থেকে এ আনন্দ শোভাযাত্রাই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করে।
বৈসাবি উৎসব প্রতিবছর ইংরেজি এপ্রিল মাসের ১২, ১৩ ও ১৪ তারিখ এবং বাংলা চৈত্র মাসের ৩০ ও ৩১ তারিখ এবং নতুন বছরের বৈশাখের ১ তারিখ পালন করা হয়। বাংলা বছরের শেষ দুই দিন ও নতুন বছরের প্রথম দিন দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীসমূহ বিঝু, সাংগ্রাই, বৈসু, বিষু, বিহু প্রভৃতি নামে এ উৎসব পালন করলেও সমতলে এটি ‘বৈসাবি’ নামে পরিচিত। বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ভিন্ন নামে ডাকলেও বৈসাবির উদ্যাপনরীতি একই। চাকমারা এ উৎসবকে ‘বিঝু’, ত্রিপুরারা ‘বৈসু’, মারমারা ‘সাংগ্রাই’ এবং তঞ্চৈঙ্গারা ‘বিসু’ নামে আখ্যায়িত করে। ‘বৈসাবি’ নামকরণ করা হয়েছে তিনটি উৎসবের আদ্য অক্ষরগুলো নিয়ে- ‘বৈ’ শব্দটি ত্রিপুরাদের ‘বৈসু’ থেকে, ‘সা’ শব্দটি মারমাদের ‘সাংগ্রাই’ থেকে এবং ‘বি’ শব্দটি চাকমাদের ‘বিঝু’ থেকে। এ তিন শব্দের সম্মিলিত রূপ হলো ‘বৈসাবি’। তিন দিনব্যাপী এ উৎসবের প্রথম দিনকে চাকমা ভাষায় ‘ফুল বিঝু’; দ্বিতীয় দিনকে ‘মূল বিঝু’ এবং তৃতীয় দিনকে ‘নুয়াবিঝু’ (নতুন বছর) বা ‘গেজ্যা পেজ্যা’ বলা হয়।
সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক ও সর্বজনীন উৎসব বৈশাখী মেলা। এ মেলা সাধারণত একদিন থেকে তিনদিন অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সাতদিনও স্থায়ী হয়। এ দেশে জমিদারি আমলে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যেই সম্ভবত বৈশাখী মেলার পত্তন ঘটে। বস্তুত বৈশাখী মেলা বাঙালির সার্বজনিন উৎসবের এক ভগ্নাংশ মাত্র। এটি বর্তমানে একটি সাংস্কৃতিক লোক-উৎসবে পরিণত হয়েছে সারাদেশে। এটি কোন ধর্মীয় এতিহ্য, কিংবদন্তী কিংবা বিভিন্ন পালা-পার্বন নির্ভর অনুষ্ঠান নয়। সে কারণেই এটি সমস্ত বাংলা ও বাঙালির সার্বজনিন উৎসব। বাঙালির লোকায়ত সংস্কৃতির বিভিন্ন পলিমাটির সমন্বয়েই এটি গড়ে উঠেছে। বৈশাখী মেলা শহরের চেয়ে গ্রাম-গঞ্জেই অধিক বসে। তাই বৈশাখী মেলা শহরের চেয়ে গ্রাম-গঞ্জেই অধিক বসে । তাই বৈশাখী মেলা যেন গ্রাম জীবনের জাগরণের প্রতীক হয়ে ওঠে । আশা- আকাক্সক্ষা ও অনন্দের প্রতীক বৈশাখী মেলা ছন্দহীন জীবনে আনন্দের জোয়ার । শিশু- কিশোরদের জীবনে আনে অনির্বচনীয় সুখ ও উল্লাস। বস্তুুত গ্রাম বাংলার লোকজীবনের সঙ্গে বৈশাখী মেলার আবেদন অত্যন্ত নিবিড় ও গভীর।
সম্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি দিল্লি সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন ৯৬৩ হিজরি মোতাবেক ১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে। ঊনত্রিশ বছর রাজত্ব করার পর তিনি পঞ্জিকা ও বর্ষপঞ্জি সংস্কারের উদ্যোগ নেন। হিজরি সন ও সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহণের বছরকে যুক্ত করে বাংলা সন প্রবর্তিত হয়। বলা হয়ে থাকে , ফসল কাটার মৌসুম খাজনা আদায়ের সুুবিধার জন্য এ সন চালু করা হয়েছিল। হিজরি সন থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র কৃত্তিকা থেকে কার্তিক অগ্রাহইনি থেকে অগ্রহায়ন, পুষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফাল্গুনি থেকে ফাল্গুন এবং চিত্রা থেকে চৈত্র।
বাংলা সন আমাদের জাতীয় সন। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে ইংরেজি সন প্রচলিত হলেও বাংলাদেশের বৃহত্তম গ্রামীন জনগোষ্ঠীর মধ্যে নিত্যকর্মে বাংলা সনের বহু প্রচলন রয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর সরকারী কাজকর্মে ইংরেজি সনের পাশাপাশি বাংলা সনের তারিখ লেখার জন্য ১ জানুয়ারী ১৯৮৭ এক নির্দেশ জারি করে সরকার। এছাড়া ১৯ জুন ১৯৮৮ বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীপরিষদে গৃহিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাংলা একাডেমি ১৯৬৬ প্রস্তাবিত পঞ্জিকা অনুযায়ী নির্ধারিত বাংলা সনের বর্ষপঞ্জি (শহিদুল্লা বর্ষপঞ্জি) অনুসরণে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় এবং সকল সরকারী মন্ত্রণালয়, বিভাগ পরিদপ্তর ও স্বায়ত্বশাসিত সংস্থাসমূহ এবং নির্দেশ পালিত হতে থাকে।
লেখক :কলামিস্ট, প্রভাষক (সমাজবিজ্ঞান) আউশকান্দি রশিদিয়া পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ নবীগঞ্জ, হবিগঞ্জ।