১৮ বছরেও নিষ্পত্তি হয়নি রমনা বটমূলের বোমা মামলা

23

কাজিরবাজার ডেস্ক :
দীর্ঘ ১৮ বছরেও রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনায় করা দুটি মামলা (হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন) নিষ্পত্তি হয়নি। দুটি মামলার মধ্যে হত্যা মামলাটির রায় নিম্ন আদালত থেকে ঘোষণা করা হলেও বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলাটির নিষ্পত্তি হয়নি। হত্যা মামলায় ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ড নিশ্চিতকরণ) এবং আসামিদের আপীলের শুনানি হাইকোর্টে নিষ্পত্তি হয়নি। মামলাটি শুনানির জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় এ নিয়ে ক্ষোভও রয়েছে ভোক্তভোগীদের মধ্যে। তবে রাষ্ট্রপক্ষ আশা করছে, দন্ডিত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপীল শুনানির জন্য হাইকোর্টের কার্যতালিকায় রয়েছে। শীঘ্রই এ মামলার শুনানি শুরু হবে। অন্যদিকে বোমা হামলার বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলাটি সাক্ষীর অভাবে ঝুলে আছে। এ ছাড়া বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে নারীদের ওপর শ্লীলতাহানির ঘটনার চার বছর পার হলেও সাক্ষীর অভাবে অদ্যাবধি এর কোন বিচার শুরু হয় নি। একমাত্র আসামির বিরুদ্ধে চার্জ (অভিযোগ) গঠন হলেও এখনও সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়নি। রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, সাক্ষী আনার দায়িত্ব পুলিশের।
হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চের ডেপুটি এ্যাটর্নি জেনারেল মোঃ মনিরুজ্জামান (রুবেল) বলেন, বিচারপতি মোঃ রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এএসএম আব্দুল মোবিন সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চে মামলাটি কার্যতালিকায় রয়েছে। ২০১৪ সালের বিচারিক আদালতের রায় ঘোষণার পরে মামলাটি ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাইকোর্টে আসে। একইসঙ্গে জেল আপীল হয়। পরে পেপারবুক প্রস্তুত করে মামলাটি একটি বেঞ্চে ছিল। ওই বেঞ্চের এখতিয়ার পরিবর্তন হওয়ায় উল্লিখিত বেঞ্চে কার্যতালিকায় আসে মামলাটি। মামলাটি শুনানির জন্য কার্যতালিকার টপের দিকে (শীর্ষে) রয়েছে। মামলাটি গত বৃহস্পতিবারও কার্যতালিকার ২৪ নম্বর ছিল। এখন শুধু ক্রমানুযায়ী শুনানির অপেক্ষা।
এ প্রসঙ্গে এ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলার ডেথ রেফারেন্স শুনানি শুরু হয়েছিল। পরে ওই বেঞ্চ থেকে এটি আউট অব লিস্ট হয়ে গেছে। এখন আবার শুনানির জন্য রয়েছে। মামলাটি দ্রুত শুনানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বহুল আলোচিত রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনায় আনা এ মামলায় ন্যায়বিচারের স্বার্থে রাষ্ট্রপক্ষ তৎপর রয়েছে।
এদিকে মহানগর পিপি আব্দুল্লাহ আবু বলেন, বিস্ফোরক আইনে যে মামলাটি আছে তাতে ২৬ জনের সাক্ষী হয়েছে। আর কিছু সাক্ষী নিয়ে মামলাটি ক্লোজ করে দিব। বোমা হামলা মামলার হত্যা মামলায় মূল আসামিদের শাস্তি হয়েছে। এখন মামলা শেষ হওয়া উচিত। অন্যদিকে হাইকোর্টে হত্যা মামলাটির ডেথ রেফারেন্সটিও শেষ হওয়া উচিত। ইতোমধ্যে নিম্ন আদালতে হত্যা মামলাটি নিষ্পত্তি হয়েছে। ঐ মামলাটির শান্তি কার্যকর হলে বিস্ফোরক মামলাটি বাদ হয়ে যাবে।
২০০১ সালের পহেলা বৈশাখের দিন ভোরে রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের ঘটনাস্থলে দুটি বোমা পুঁতে রাখা হয় এবং পরে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে তা বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। সকাল ৮টা ৫ মিনিটে একটি এবং ১০-১৫ মিনিট পর আরেকটি বোমা বিস্ফোরিত হয়। বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই নয় জন মারা যায়। পরে আরও একজন মারা যায়। আর ২০-২৫ জন আহত হন।এ ঘটনায় দুটি (হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ) মামলা হয়। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নানসহ ১৪ জঙ্গিকে এ মামলার আসামি করা হয়। হামলার ঘটনায় বিচারিক আদালতে দায়ের করা হত্যা মামলার রায়ে মুফতি হান্নানসহ আটজনের মৃত্যুদন্ড এবং ছয়জনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। মামলায় সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর ভাই মাওলানা তাইজউদ্দিনসহ চার আসামি এখনও পলাতক। হত্যা মামলায় ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপীল শুনানি শুরু হয়। পরে তা কার্যতালিকা থেকে বাদ যায়। বর্তমানে শুনানির জন্য রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলার ঘটনায় মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও জেল আপীল হাইকোর্টের কার্যতালিকায় রয়েছে। বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এএসএম আব্দুল মবীনের হাইকোর্ট বেঞ্চে মামলাটি কার্যতালিকায় রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার এটি কার্যতালিকায় ২৪ নম্বর তালিকায় ছিল। এ্যাটর্নি কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সালের বিচারিক আদালতের রায় ঘোষণার পরে মামলাটি ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাইকোর্টে আসে। একইসঙ্গে জেল আপীল হয়। পরে পেপারবুক প্রস্তুত করে মামলাটি একটি বেঞ্চে ছিল। ওই বেঞ্চের এখতিয়ার পরিবর্তন হওয়ায় বর্তমান কোর্টের কার্যতালিকায় আসে মামলাটি। আশা করা হচ্ছে অচিরেই মামলাটির শুনানি শুরু হবে। রাষ্ট্রপক্ষ এ বিষয়ে শুনানির জন্য প্রস্তুত রয়েছে বলে জানা গেছে। রমনা বটমূলের ঘটনায় দায়ের করা হত্যা মামলায় ২০১৪ সালের ২৩ জুন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ রুহুল আমিন রায় দেন। রায়ে বিচারিক আদালত নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নানসহ আটজনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদন্ডাদেশ এবং ছয়জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয় বিচারিক আদালত। মৃত্যুদন্ডে দন্ডিতরা হলেন-মুফতি আব্দুল হান্নান, মাওলানা আকবর হোসেন, আরিফ হাসান সুমন, মাওলানা তাইজউদ্দিন, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, মাওলানা আবু বকর ওরফে মাওলানা হাফেজ সেলিম হাওলাদার, মাওলানা আবদুল হাই ও মাওলানা শফিকুর রহমান। এর মধ্যে সিলেটে প্রাক্তন ব্রিটিশ হাইকমিশনার অনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার মামলায় মুফতি হান্নানের মৃত্যুদন্ড কার্যকর করা হয়েছে। মাওলানা আকবর হোসেন, আরিফ হাসান সুমন ও মাওলানা আবু বকর ওরফে মাওলানা হাফেজ সেলিম হাওলাদার কারাগারে এবং বাকিরা পলাতক রয়েছেন। যাবজ্জীবন কারদন্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- শাহাদাতউল্লাহ জুয়েল, মাওলানা সাব্বির, শেখ ফরিদ, মাওলানা আব্দুর রউফ, মাওলানা ইয়াহিয়া ও মাওলানা আবু তাহের।
২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে বোমা হামলার নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির তৎকালীন সার্জেন্ট অমল চন্দ্র চন্দ রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা করেন। হত্যা মামলায় রায় ঘোষণা হলেও অন্য মামলাটি এখনো বিচারাধীন। ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর দুই মামলায় ১৪ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) সিআইডির পরিদর্শক আবু হেনা মোঃ ইউসুফ ২০০৮ সালের ৩০ নবেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। দুটি মামলারই অভিযোগপত্র একসঙ্গে দাখিল করা হয়। পরে বিচারের জন্য মামলা দুটি ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে যায়। ওই আদালতে একই বছরের ১৬ এপ্রিল পৃথকভাবে মামলা দুটিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২০১৪ সালের ২৩ জুন বিচারিক আদালত হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন। এরপর ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের জেল আপীল ও ফৌজদারি আপীলের শুনানির জন্য মামলাটি হাইকোর্টে আসে। ২০১৭ সালের ১৭ জানুয়ারি বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি সহিদুল করিমের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদ- অনুমোদন) ও আপীল শুনানি শুরু হয়। পরে সেটি কার্যতালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। যা এখন বিচারপতি রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি এএসএম আব্দুল মবীনের হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
বোমা হামলায় বিস্ফোরক মামলা : রমনা বটমূলে বোমা হামলার ঘটনায় দুটি মামলা হয়। একটি হত্যা মামলা অপরটি বিস্ফোরক মামলা। হত্যা মামলাটিতে নিম্ন আদালতে রায় হবার পর সেটি হাইকোর্টে রয়েছে। অন্যদিকে বিস্ফোরক মামলাটি এখনও ঝুলে আছে। বিস্ফোরক মামলাটি ঢাকার দ্রুতবিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এ বিচারাধীন। ৮৪ সাক্ষীর মধ্যে মাত্র ২৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়েছে।এ বিষয়ে মহানগর পিপি আব্দুল্লাহ আবু বলেছেন, বিস্ফোরক আইনে যে মামলাটি আছে তাতে ২৬ জনের সাক্ষী হয়েছে। আর কিছু সাক্ষী নিয়ে মামলাটি ক্লোজ করে দিব। বোমা হামলা মামলার হত্যা মামলায় মূল আসামিদের শাস্তি হয়েছে। এখন মামলাটি শেষ হওয়া উচিত। শ্লীলতাহানি মামলা : এদিকে ২০১৫ সালের ১৪ এপ্রিল বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে টিএসসি এলাকায় নারীদের শ্লীলতাহানি আলোচিত ঘটনার চার বছর পার হলেও এর বিচার হয়নি। ২০১৮ সালের ১৯ জুন এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় একমাত্র আসামির বিরুদ্ধে চার্জ (অভিযোগ) গঠন করা হলেও অদ্যাবধি মামলায় কোন সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি। সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন রয়েছে। মামলাটি নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ মামলাটি বিচারাধীন।
এ প্রসঙ্গে মহানগর পিপি আব্দুল্লাহ আবু বলেছেন, এ মামলাটিতে একটিও সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়নি। মামলায় একজন আসামি রয়েছে। ২০১৫ সালের ঘটনা। তিনটি আদালত ঘুরে বর্তমানের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৮ এ মামলাটি রয়েছে। সাক্ষী না এলে আসামির বিরুদ্ধে কিছু করা যাবে না। সাক্ষী আনতে হলে অবশ্যই পুলিশকে তৎপর হতে হবে। পুলিশের দায়িত্ব যাদের নামে সমন পাঠানো হয়েছে, তাদের হাজির করা। সাক্ষ প্রমাণ দিয়েই আসামিকে শাস্তি দিতে হবে। সে জন্য অপেক্ষায় রয়েছি।