ভারতে লোকসভা নির্বাচন, প্রথম পর্বে ভোট গ্রহণ ॥ বিচ্ছিন্ন সহিংসতায় তিনজন নিহত

23

কাজিরবাজার ডেস্ক :
ভারতে বৃহস্পতিবার ১৭তম লোকসভা নির্বাচনের প্রথম পর্বে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এ পর্বে ২০ রাজ্যের ৯১ আসনে ভোট গ্রহণ চলে। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ারে ভোট গ্রহণ উপলক্ষে নেয়া হয় কড়া নিরাপত্তা। ছয় সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠেয় এ নির্বাচনকে অনেকে দেখছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শাসনের প্রতি একটি গণভোট হিসেবে। বিচ্ছিন্ন সহিংসতায় সারাদেশে তিনজন নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। বিবিসি, এনডিটিভি ও টাইমস অব ইন্ডিয়া।
ভারতে এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিভিন্ন আঞ্চলিক ইস্যু প্রাধান্য পেলেও এ নির্বাচনকে মোদির শাসনের প্রতি একটি গণভোট হিসেবেই দেখছেন অনেক বিশ্লেষক। হিন্দু জাতীয়বাদের ঢেউ তুলে ২০১৪ সালে মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) ব্যাপক জয় পেয়েছিল। ওই নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কংগ্রেসের ভরাডুবি ঘটে। রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের হাল ধরার পর তার নেতৃত্বে কংগ্রেস এবার নির্বাচনের মাঠে লড়ছে। তাই এবারের নির্বাচনের রাহুলের নেতৃত্বের জন্যও এক রকম পরীক্ষা বলা যায়। এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় সাধারণ নির্বাচন, কারণ গতবারের তুলনায় এবার দেশটিতে ভোটারের সংখ্যা বেড়েছে সাড়ে চার কোটি। পার্লামেন্টের নি¤œকক্ষ সাত ধাপের এই ভোট উৎসব চলবে ১৯ মে পর্যন্ত। ভোট গণনার দিন ২৩ মে। লোকসভার মোট আসন সংখ্যা ৫৪৩। সরকার গঠন করতে কোন দল বা জোটের প্রয়োজন কমপক্ষে ২৭২টি আসন। মোট ১১ লাখ ইভিএমে নিজেদের মতো ভোট দেবেন ভোটাররা।
বিজেপি টানা দ্বিতীয়বারের মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে প্রচার চালালেও তাদের কড়া প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে ফেলছে শক্তিশালী কিছু আঞ্চলিক দল এবং ভগ্নদশা থেকে পুনরুজ্জীবিত হওয়া প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। এ বছর জানুয়ারিতে রাহুলের বোন প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেসে যোগ দেয়ার পর দলটিতে নতুন করে গতি সঞ্চারণ হয়। পর্যবেক্ষকদের অনেকে এই নির্বাচনকে ভারতে কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন হিসেবে আখ্যা দিচ্ছেন। দেশটি অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসরমান হলেও লাগামহীন বেকারত্বের রাম টেনে ধরতে পারেনি মোদির সরকার। সমালোচকরা মনে করেন প্রবৃদ্ধি এবং কর্মসংস্থান তৈরির যে আশ্বাস তিনি দিয়েছিলেন, তা বাস্তবায়িত হয়নি। তার সময়ে দেশটিতে ধর্মের ভিত্তিতে বৈষম্য এবং মেরুকরণের প্রবণতা বেড়েছে বলেও মনে করেন সমালোচকরা। গত নির্বাচনে দলটি একাই পেয়েছিল ২৮২টি আসন। অন্যদিকে কংগ্রেস পেয়েছিল মাত্র ৪৪টি আসন। এরপর পাঁচ বছর দেশ শাসন করেছে বিজেপি। কিন্তু এ সময়টা ঠিক পাঁচ বছর আগের মতো আর নেই, অনেক কিছুই পাল্টেছে। এবার বিজেপি-কংগ্রেসের বাইরে ‘থার্ড ফ্রন্ট’ নামে যোগ হয়েছে অন্য দলগুলো।
এ নির্বাচনে থার্ডফ্রন্টের খুঁটির জোর একেবারে কম নয় বরং বড় দুই দল বিজেপি ও কংগ্রেসকে এ শক্তিকে সমীহ করছে বলে প্রচারাভিযান চালানোর সময় ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। সবচেয়ে বড় হিসাবটি কষতে হচ্ছে, উত্তর প্রদেশকে নিয়ে সেখানে বহুজন সমাজ দল ও সমাজবাদী দল একজোট হয়ে নির্বাচন করছে। সেখানে মায়াবতী ও অখিলেশ যাদব বিজেপি ও কংগ্রেসের বাইরে রাজনৈতিক বলয় গঠনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। রাজ্যটিতে রয়েছে লোকসভার ৮০টি আসন। সবচেয়ে বেশি আসন বিশিষ্ট এ প্রদেশটি তাই বিজেপির পরিষ্কার রাস্তায় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এরপর রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ। সেখানে তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জী নির্বাচনের আগে রাত-দিন মোদিকে তুলাধুনা করেন। গত নির্বাচনে বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ঘরে ঘরে চাকরির ব্যবস্থা করবে। কিন্তু তারা তা করতে পারেনি। সম্প্রতি এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, গত ৭০ বছরের মধ্যে বর্তমানে ভারতে বেকারত্বের হার সবচেয়ে বেশি। এ ছাড়া কংগ্রেসের বিরুদ্ধে যে দুর্নীতির ধোয়া তুলে ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেছিল, সেখানেও বিজেপির উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। তবে দলটি যেটা করেছে তা হলো ভারতের অর্থনীতিকে মজবুত করেছে। বিদেশী বিনিয়োগ বেড়েছে। এটি বিজেপির অন্যতম ভিত। এরপর রয়েছে কট্টর জাতীয়তাবাদী অবস্থান। এবার বিজেপির ইশতেহারেও এটি এক নম্বরে রাখা হয়েছে। এরপরই রয়েছে হিন্দুত্ববাদ। এটিও বিজেপির ক্ষুরধার অস্ত্র।
কংগ্রেসে গত নির্বাচনে ধরাশায়ী হওয়ার পর দলটির প্রবীণ নেতৃবৃন্দ হতাশ হয়েছিলেন। কিন্তু অল্প কিছুদিন যেতেই রাহুল গান্ধী মাঠে নামেন। রাহুল একা নয় এবার মাঠে নেমেছেন বোন প্রিয়াংকাও। প্রিয়াংকাকে দলের সাধারণ সম্পাদক করে উত্তর প্রদেশের একাংশের দায়িত্ব দেয়া হয়। সেখানে কংগ্রেসের অবস্থান আগের চেয়ে ভাল। এছাড়া এবার রাহুল আমেথি ছাড়া কেরালার ওয়ানাডে থেকে প্রার্থী হয়েছেন। লক্ষ্য একটাই দক্ষিণ ভারতে কংগ্রেসের শক্তি বাড়ানো। যে কোন নির্বাচনে শাসকদলের ত্রুটিই পুঁজি করে বিরোধী দল। কংগ্রেস সে সুযোগ কাজে লাগাতে ভুল করেনি। মোদির আমলে বেকার সমস্যা ও দরিদ্রতা কাটেনি। আর কংগ্রেস এবার ঘোষণা দিয়েছে ক্ষমতায় গেলে তারা দরিদ্রদের জন্য ন্যূনতম ভাতা হিসেবে বছরে ৭২ হাজার রুপী দেবে। বিজেপির বাইরে মোদি বিরোধী দলগুলোর আওয়াজ একটাই ‘মোদি ঠেকাও’। উত্তর প্রদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গ মায়াবতী, অখিলেশ যাদব, মমতা সবারই একই স্লোগান- মোদি ঠেকাও। এ থেকে অনুমান করা যায়- মোদি পুনরায় দিল্লীর মসনদে বসতে যাচ্ছেন বাকিরা শুধু ঠেকাতে চাইছে। কিছু জরিপও সেদিকেই ইঙ্গিত করেছে।
এদিকে মোদি বলেছেন, বিজেপি ক্ষমতায় ফিরলে রাজনীতিতে পরিবারতন্ত্রের অবসান ও দুর্নীতির দোকান বন্ধ হবে বুঝেই ভয় পেয়েছেন বিরোধীরা। বিহারের এক নির্বাচনী সভায় তিনি এ কথা বলেন। বিজেপি বিরোধী ঐক্যকে ‘মহামিলাবটি গ্যাং’ বলে কটাক্ষ করার পাশাপাশি বিরোধীরা দেশের জওয়ানদের বিশেষ সুবিধা কেড়ে নিতে চেয়ে সন্ত্রাসবাদীদের মদদ দিচ্ছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন।
বৃহস্পতিবার উপকূলীয় রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশে ভয়াবহ নির্বাচনী সহিংসতায় দুই জনের প্রাণহানি ঘটে। রাজ্যের অনন্তপুর জেলার তাদিপত্রি আসনের বীরাপুরাম গ্রামে দুটি রাজনৈতিক দলের কর্মী-সমর্থকদের মাঝে সংঘর্ষে ওই দুজন মারা যায়। তেলেগু দেশম পার্টির স্থানীয় নেতা সিদ্দা ভাস্কর রেড্ডি ওয়াইএসআর কংগ্রেস পার্টির সমর্থকদের হামলায় মিরাপুরামে নিহত হন।
ভোটার তালিকা থেকে ব্যাপকহারে ভোটারদের নাম মুছে ফেলা, বিভিন্ন জায়গায় ক্ষমতাসীন বিজেপির নামে খাবার, টাকা বিতরণ, সংঘর্ষ, বিক্ষোভ এবং ইভিএম আছড়ে ভেঙ্গে ফেলাসহ নানামুখী অভিযোগ পাওয়া যায়। এ ছাড়া ত্রিপুরায় বিজেপি ও কংগ্রেস সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটেছে। এতে ১২ জন আহত হন। এদের মধ্যে আটজনের অবস্থা গুরুতর। তাদের হাসপাতালে নেয়া হয়। পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে তৃণমূল কংগ্রেসের হামলায় বিজেপির চার সমর্থক আহত হন। মহারাষ্ট্রের গাদচিরলি আসনের একটি ভোটকেন্দ্রের কাছে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে তবে এতে কোন হতাহতের খবর জানা যায়নি। অভিযোগ উঠেছে নকশালপন্থীরা ভোটারদের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করতে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়।
পশ্চিমবঙ্গের কুচবিহারের তুফানগঞ্জে বিজেপি কার্যালয় ভেঙ্গে দেয়ার অভিযোগ উঠেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। তুফানগঞ্জের ধলপলে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। তৃণমূল এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে। কোচবিহারে কেন্দ্রীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে ভোটে নাক গলানোর অভিযোগ তুলেছে তৃণমূল কংগ্রেস। সংবাদমাধ্যমকে তৃণমূল নেতা রবীন্দ্রনাথ ঘোষ জানিয়েছেন, নিয়ম না মেনে বুথের মধ্যে ঢুকে পড়েছেন বিএসএফ জওয়ানরা। পাশাপাশি তিনি ইভিএম কারচুপির অভিযোগও তোলেন।
এদিকে তৃণমূল এবং বিজেপি কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ ঘিরে উত্তপ্ত দিনহাটা। তৃণমূল কর্মীদের বিরুদ্ধে ভোটারদের মারধরের অভিযোগ তুলেছে বিজেপি। তৃণমূল কর্মীদের হামলায় এক বিজেপি সমর্থকের মাথা ফেটেছে বলে জানা যাচ্ছে। বিজেপি সমর্থকদের পাল্টা হামলায় কয়েকজন তৃণমূল কর্মীও আহত হন। প্রথম দিন এবং আলিপুরদুয়ার এবং কোচবিহার পশ্চিমবঙ্গের এই দুটি আসনে ভোট নেয়া হয়। দুই আসনেই মূল লড়াই তৃণমূল এবং বিজেপির মধ্যে। শুধু এই দুই কেন্দ্রে নয় পশ্চিমবঙ্গের অধিকাংশ আসনেই এবার মূল লড়াই রাজ্যের শাসক দল এবং দেশের শাসক দলের মধ্যে।